সাজেক ভ্যালি ইতিহাস, অজানা একটি গল্প

সাজেকের ইতিহাস
১৯ মে১৯৯৬, ঐতিহাসিক দিন।

সেনাবাহিনীর আমার ইউনিটের (১৭ ইষ্ট বেঙ্গল) এর ৭ জন সাহসী বীর সাজেক এ হেলীকপ্টার ক্রাশ এ শহীদ হয় ও ২৩ জন আহত হয়, ধব্ংস হয় একটা MI 17 হেলীকপ্টার।

আমার জানামতে পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসে ও স্বাধিনতার পর এটাই ছিলো সবচেয়ে বড় আর দু্র্ধরষ অপারেশন।৯৬ এর ১২ মে ১৭ বেংগল এর দুঃসাহসী টহল ঐ এলাকায় সন্ত্রাস বিরোধী অপারেশন করে এবং ৯ দিন ক্রমাগত অপারেশন করে ২১ মে এলাকা পরিস্কার করে। এই অপারেশন এ মোট ৩১ টা টহল অংশ নেয়, যার মধ্যে ছিলেন মেজর মোমিন, মেজর আনোয়ার ( পরবর্তীতে জেনারেল) মেজর জিহাদ, ক্যাপ্টেন খায়ের ও লেঃ ফেরদৌস অংশ‌ নেন।

এই অপারেশন এ ১৭ বেংগলের ৭ জন শহীদ হন, ২৩ জন আহত হয় ও একটা হেলিকপ্টার ক্রাশ হয়। কৌশলগত কারনে আমতলী জুম্মল্যান্ড খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিলো, ঐ অপারেশন এর ফলে ঐ এলাকা শান্ত হয় এবং পরে সাজেক টুরিস্ট এলাকা হয়।

এটা সেনাবাহিনীর একটা গর্বের অপারেশন।
হিল এর সবচেয়ে কস্টলি অপারেশন এই ব্যটালিয়ন করেছে, সাজেক ঢুকার পর এত এনকাউন্টার ছিলো, যে গুলি শেষ হয়ে যায়। সাজেক নদী বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্ত দিয়ে বয়ে পরবর্তীতে শিশক নদী নাম হয়ে কাসালং নদীতে মিলেছে। সাজেক নদীর পারে ছিলো আমতলী যা ৯৬ পূর্ববর্তী তে শান্তি বাহিনী জুমমল্যান্ড নামে একটি ক্যামপ বানায়। পাশে নিউ লংকর , ওলড লংকর পাংকু পাড়া। মাঝে টিপরা পাড়া, আর দেবাছড়া।১২ মে ১৯৯৬, লেঃ ফেরদৌস সহ ৪ জন টহল কমান্ডার ৪ টা বিশেষ টহল নিয়ে বের হয়, উদ্দেশ্য সাজেক এলাকায় সন্ত্রাসী ক‌্যম্প ধ্বংস করা।

১২ থেকে ১৮ মে ১৯৯৬ পর্যন্ত এই ৪ টা দল অনেক এনকাউন্টার করে। ১৮ মে ভ্যান প্যাট্রল লেঃ ফেরদৌস সাজেকের কাছে দেবাছড়া পৌঁছে। কষ্টের এই পাহাড়ে ৪ টহলের মাঝে ৪ টা এমবুশ তাদের পরস্পর থেকে আলাদা করে ফেলে, গুলি শেষের পথে, খাবার শেষ, আর ৬ দিন ক্রমাগত টহলের ফলে ৪ টহলের ১২০ জনের সবাই প্রচন্ড ক্লান্ত, ৮/১০ জন ম্যালেরিয়া নিয়েও টহল দিচ্ছে।

রিইনফোর্সড টহল নিয়ে আসে মেজর আনোয়ার, মাঝরাস্তায় এম্বুশে আটক তার দল,শাহ আলম শহীদ হয়, কাদের আহত। মেজর জিহাদ এর টহল হেলী ক্রেশ করে, ৭ শহীদ ও ২৩ আহত। লেঃ এর টহল জুম্মলেন্ড এ রেইড করে গুলি ছাড়া ট্রেন্চ করে রি-অর্গ করে পজিশন ধরে আছে। মেজর মোমিন মাঝের টহল লিংক আপ করছে, বিডিআর টহল সাপ্লাই দিয়েছে।

আকাশ পথে হেলিতে করে আনানো হয় আর একটা টহল, সাথে রশদ আর ঐ সময়ের সবচেয়ে দরকারি জিনিস – গোলাবারুদ। আসার সময় নিউলংকর হেলীপ্যাড এ ক্রাশ করে হেলী, জায়গায় শহীদ হয় ৭ জন, ২৩ জন আহত, দিনটা ১৯ মে ১৯৯৬.

এই ধারাবাহিকতায় পাহাড়ের এই অপারেশন ওই ১২০ জন অনেক পিছনে পড়ে যায়। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই ঐ সময়ে পাহাড় অপারেটিভ ৪ টি টহলের ১২০ জন এর রিইনফোর্সমেন্ট এর কথা রয়ে যায় less priority হিসাবে। একটা Bell 212 দিয়ে শুধুমাত্র ঐ হেলী আহত নিহতদের হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য সাজেক চ্টগ্রাম ট্রিপ চলে।

৪ টা টহল তাদের এই বিশাল দায়িত্ব সফলভাবে শেষ করে, পার্বত্য চট্টগ্রামের মাটিতে দীর্ঘ ১১ দিন একনাগাড়ে প্রতিদিন এনকাউন্টার করে ২৩ মে বেজ এ আসে কোন খতি ছাড়া। ১৮ মে এমবুশে একটা উপড়ে পড়ে থাকা চাঁপালিশ গাছের আড়ে থেকে সন্ত্রাসী দের মোকাবেলা করেছিলাম, ঐ মরা গাছে ১৬ টা বুলেটের হিট ছিলো।

অনেক বন্ধু আমাকে যখন জিজ্ঞেস করে, আমি কেন এত রেক লেস চলি, উত্তর না দিয়ে নীরবে ১৬ টা বুলেটবিদ্ধ উপড়ে পড়া চাপালিশ গাছের কথা মনে পড়ে আর ভাবি ” ১৯৯৬ থেকে ২০২১ পর্যন্ত ২৫ বছর, ভালোই বোনাস দিয়েছেন আল্লাহ”।

চাঁপালিশ গাছের আড়ালে থাকায় ২৫ বছর বোনাস পেলাম, এভাবেই শেষ দিন আসবে হয়তো , এভাবেই দিন চলুক, এভাবেই শেষ মুহূর্ত আসুক !!! এই সাজেক এ সহস্র পর্যটক যাচ্ছে, কেউই সেনাবাহিনীর এই সাফল্য জানে না।সাজেক অপারেশন পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস এ সবচেয়ে কস্টলি ও মূল্যবান অপারেশন।সাজেক এর মতো রিমোট এলাকা এখন টুরিস্ট স্পট। অথচ কোন হাই লাইট নাই এই ব্যটালিয়ন এর।
১৯ মে ১৯৯৬ এর শহীদদের প্রতি থাকলো অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
পরিশ্রমী মানুষের শ্রম সফল হোক।
সাহসের জয় হোক।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দীর্ঘ জীবি হোক।
©Defenders of BD

    1 thought on “সাজেক ভ্যালি ইতিহাস, অজানা একটি গল্প”

    1. সাজেক ভ্যালি সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো তুলে ধরার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।

      Reply

    Leave a Comment