শিশুর চঞ্চলতা কি এডিএইচডি, শিশুর চঞ্চলতার সঙ্গে এডিএইচডি রোগের সম্পর্ক কী

শিশুর চঞ্চলতা কি এডিএইচডি, শিশুর চঞ্চলতার সঙ্গে এডিএইচডি রোগের সম্পর্ক কী

সুস্থ–স্বাভাবিক শিশু খানিকটা চঞ্চল হবেই। সুস্থ শিশু মানেই হাসিখুশি ও দুরন্তপনা। তবে অতিচঞ্চল শিশুর সমস্যাকে বলা হয় অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপার অ্যাকটিভিটি ডিজঅর্ডার (এডিএইচডি)। বাংলায় এ সমস্যাকে বলে অতিচঞ্চল অমনোযোগিতা। এটি শিশুর একধরনের স্নায়ুবিকাশজনিত সমস্যা। বাবা-মা কিংবা স্কুলের শিক্ষক সবচেয়ে আগে এ সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে পারেন। সাধারণত তিন–চার বছর বয়সে শিশুর এই লক্ষণগুলো প্রকাশ পায়।

স্বাভাবিক চঞ্চল শিশুকেও অনেকে অতিচঞ্চল মনে করেন। কিন্তু প্রকৃত সত্য হচ্ছে, চঞ্চলতা মানেই এডিএইচডি নয়। শিশুমাত্রই কিছুটা দুষ্টুমি করবে, বড়দের মতো মনোযোগ ও ধৈর্য তাদের মধ্যে আশা করা ঠিক নয়।

শুর অতি চঞ্চলতা বা অমনোযোগিতা কি এডিএইচডি?

এডিএইচডি কী? কেন হয়?

এডিএইচডি শিশুর মানসিক বিকাশগত একটি সমস্যা, যার সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ নেই। ধরে নেওয়া হয় এটা জিনগত ও পরিবেশের প্রভাবে হয়। মা অথবা বাবার যে কারও একজনের এডিএইচডি থাকলে শিশুরও এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা ৫০ শতাংশ। এই রোগ সাধারণত মেয়েদের চেয়ে ছেলে শিশুদের বেশি হয় (৪:১)। এছাড়া মস্তিষ্কের রোগ, থাইরয়েড হরমোনের আধিক্য, গর্ভকালীন মানসিক চাপ ও দুশ্চিন্তা, বিষাক্ত রাসায়নিক, কীটনাশক, লোহা ও সীসার সংস্পর্শে আসা, অপুষ্ট ও সময়ের আগে সন্তান হলেও পরবর্তী সময়ে এই রোগ হতে পারে।

সাধারণত, শিশুর চঞ্চলতাকে বয়সের সঙ্গে স্বভাবিক ধরে নেওয়ায় রোগ নির্ণয় করতে অনেকসময় দেরি হয়ে যায়। ৭ থেকে ১২ বছর বয়সের আগে অধিকাংশ বাবা-মা বুঝতেই পারেন না, সময়ে ঠিক হয়ে যাবে মনে করে।

শিশুর চঞ্চলতা কি এডিএইচডি

কী দেখে বুঝবেন  শিশুর এডিএইচডি আছে?

এ রোগের তিনটি ধরন থাকে—

১. শুধুই অমনোযোগিতা;

২.অতিরিক্ত চঞ্চলতা ও অযাচিত আচরণ;

৩. ওপরের দু’টোই একসঙ্গে হওয়া, যা  বেশিরভাগ শিশুদের ক্ষেত্রে দেখা যায়

লক্ষণ

১. নিজের মনমতো কাজ করা ও নিজের ইচ্ছেকে প্রাধান্য দেওয়া

২. কোনো কাজ সুশৃঙ্খলভাবে না করা ও শেষ পর্যন্ত লেগে না থাকা। দ্রুত মনযোগ সরে যাওয়া

৩. কারণ ছাড়াই হঠাৎ করে রেগে যাওয়া, জিদ করা বা বিষণ্ণ হয়ে যাওয়া

৪. এক জায়গায় স্থির হয়ে না বসা, সারাক্ষণই ছুটোছুটি করা

৫. চুপচাপ কোনো কাজ না করা, অযথাই চিৎকার করা, অপ্রয়োজনে ও অপ্রাসঙ্গিক কথা বলা। অন্যের কথার মাঝে কথা বলা ও তাদের কথায় কান না দেওয়া

৬. যেভাবে করতে বলা হয়, তা মেনে না নেয়া, গুছিয়ে কোনো কাজ না করতে পারা, প্রায়ই কাজে ভুল করা যেমন— হোমওয়ার্ক না করা, জিনিসপত্র হারানো

৭. কথা মনযোগ দিয়ে না শোনা, উদাস হয়ে যাওয়া, অবাস্তব কল্পনা করা, অন্যদের এড়িয়ে চলা বা মিশতে না পারা, হঠাৎ মারামুখি হওয়া

শিশুদের অতি চঞ্চলতা

অটিজম আর এডিএইচডি কি একই রোগ?

না, দুটো একই রোগ না। অটিজমে অমনোযোগিতা, সঙ্গবিমুখ হওয়া, নির্দেশনা না মানার মতো কিছু লক্ষণ আছে এডিএইচডি’র মত। তবে এগুলো অটিজমের অংশ নয়।

রোগ নির্ণয়ের উপায়

মাত্রারিক্ত ও ধ্বংসাত্মক চঞ্চলতাকে অবহেলা বা প্রশ্রয় না দিয়ে তার মধ্যে রোগের কোনো লক্ষণ দেখা গেলে নিকটস্থ শিশু বিকাশ কেন্দ্র বা নিউরোলজির বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। বিভিন্ন আচরণগত, ল্যাবরেটরি পরীক্ষা ও বিকাশের ধাপগুলো যাচাই করেই তাকে এডিএইচডি রোগী বলা হবে, এর আগে নয়।

চিকিৎসা না করালে কী ক্ষতি?

বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বড় হলে বাচ্চা ঠিক হয়ে যাবে— এমন আশা করে লাভ নেই। কারণ, ৩০ থেকে ৭০ শতাংশ ক্ষেত্রে এ রোগ বড় হলেও থেকেই যায়। সময়মতো চিকিৎসা না করলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়। এ রোগে আক্রান্তরা পরিবার, সমাজ বা কর্মক্ষেত্র— কোথাওই খাপ খাওয়াতে পারে না।

চিকিৎসা

অতিরিক্ত চঞ্চলতা কমানোর জন্য ওষুধ দেওয়ার আগে কিছু প্রক্রিয়া অনুসরণ করে ফল পাওয়া যেতে পারে। শিশুকে এসব প্রক্রিয়ার মধ্যে আনা গেলে ধীরে ধীরে এডিএইচডি’র লক্ষণগুলো কমতে দেখা যেতে পারে, ধীরে ধীরে সবগুলো লক্ষণ থেকে মুক্ত হয়ে শিশু স্বাভাবিকও হয়ে যেতে পারে। এসব প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে—

১. শিশুর এনার্জিকে ভালো কাজে লাগানো, যেমন— সাঁতার কাটা, সাইক্লিং করা, কারাতে বা মার্শাল আর্ট শেখানো;

২. সহজ ভাষায় ও অল্প কথা শিশুতে কাজ বুঝিয়ে দেওয়া এবং শিশুর মেজাজের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে সহানুভূতি নিয়ে তাকে শেখানো;

৩. ছোট ছোট কাজের তালিকা করে দেওয়া, যেন সে অল্প সময়ে মনে করে সব কাজ করতে পারে। একইসঙ্গে কাজের জন্য সময় বেঁধে দেওয়া;

৪. তালিকা অনুযায়ী কাজ করলে শিশুর প্রশংসা করা ও প্রয়োজনে তার জন্য পুরস্কারের ব্যবস্থা রাখা;

৫. ঘরে টিভি, ল্যাপটপ বা ট্যাবলেট কম্পিউটারের ব্যবহার কমিয়ে দিয়ে বাইরে খোলা মাঠে সবুজ প্রকৃতিতে খেলার সুযোগ করে দেওয়া;

৬. শিশু হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে গেলে মনযোগ সরিয়ে নেওয়া, জোরে জোরে শ্বাস নিতে বলা এবং সহানুভূতি নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলা;

৭. স্কুলের শিক্ষক ও অভিভাবকদের সঙ্গে সমন্বয়  রাখা, যেন যেন ক্লাসেও শিশুটি মনোযোগ পায়। শিশুকে পড়া তৈরি করতে সাহায্য করা, প্রশংসা করা, কোনো কাজ ঠিকমতো করতে পারলে তাকে পুরস্কৃত করা— বাড়ির মতো স্কুলেও এ বিষয়গুলো নিশ্চিত করা;

৮. শান্ত রাখার জন্য মাঝে মাঝে শিশুকে গান শুনতে দেওয়া, বিশ্রামে রাখা ও তার সঙ্গে সহজ ভাষায় গল্প করে তার মনযোগ ধরে রাখা।

খাবারের সঙ্গে এডিএইচডি’র সম্পর্ক

শিশুদের সাধারণত গম, ভুট্টা, চকলেট, টমেটো, আঙ্গুর, সিমজাতীয় খাবার দিতে নিরুৎসাহিত করা হয়। চিনি বা কোনো অ্যালার্জিক খাবারের সঙ্গে এডিএইচডি বাড়ার কোনো সম্পর্ক নেই। তবে মা-বাবার কাছে যদি মনে হয় কোনো খাবারে শিশুর চঞ্চলতা বেড়ে যায়,  তাহলে সে খাবারটি দিয়ে পরীক্ষা করতে হবে সেটি অ্যালার্জির কারণে নাকি অতিচঞ্চলতার কারণে ঘটছে।

তবে অনেক গবেষণায় বলা হয়, ভিটামিন বি, সি, ডি-থ্রি, ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড ও ম্যাগনেশিয়াম জাতীয় ভিটামিন ও খনিজ জাতীয় খাবার এই চিকিৎসায় ভালো কাজ দেয়।

এডিএইচডির পরিণতি

স্বাস্থ্যবিষয়ক একটি ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদনের আলোকে জানানো হলো এডিএইচডি নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারার পরিণতি সম্পর্কে।

মনযোগের অভাব:

এডিএইচডি’তে আক্রান্তদের প্রধান সমস্যা হল মনযোগের অভাব। একটি কাজে তারা শেষ পর্যন্ত মনযোগ রাখতে পারে না। ফলে কোনো কাজেরই সমাপ্তি ঘটে না। অপরদিকে কিছু কাজে অতিরিক্ত মনযোগী হতে দেখা যায় এই রোগীদের।

অন্যমনস্কতা:

এই রোগে আক্রান্ত শিশুরা বিদ্যালয়ে গিয়ে শ্রেণিকক্ষে স্থির হয়ে বসতে পারেনা। ফলে শ্রেণিকক্ষের সবচাইতে চঞ্চল ছাত্রছাত্রী হিসেবে তাদের পরিচিতি থাকে। চঞ্চল থাকলেও তাদের মন কিন্তু পড়াশোনায় থাকে না, দিবাস্বপ্ন আর কল্পনার জগতেই তাদের সদা বিচরণ। এই উপসর্গ ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের মাঝে বেশি দেখা যায়। ফলে শিক্ষাজীবনে তাদের যে বড় ঘাটতি তৈরি হয় তা পরিণত বয়সে বোঝা হয়ে দাঁড়ায়।

বেপরোয়া আচরণ:

বাড়ন্ত বয়সে প্রায় সব শিশুই বেপরোয়া আচরণ করে। তবে এডিএইচডি’তে আক্রান্ত শিশুর বেপরোয়া আচরণ হয় অস্বাভাবিক পর্যায়ে।

হঠাৎ তারা প্রচণ্ড রাগী ও জেদি হয়ে ওঠে, তখন তাদের সামলানো মুশকিল হয়ে পড়ে। নিজেদের আবেগের প্রতি তাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। এসময় তারা যে কাজগুলো করে তা নিজের এবং আশপাশের অনেকের জন্যই ক্ষতির কারণ হয়ে ওঠে।

আপনার শিশু কি অতি চঞ্চল ও অমনোযোগী

সম্পর্ক বজায় রাখতে ব্যর্থতা:

সামাজিক জীবনের যেকোনো সম্পর্ক বজায় রাখতে এই রোগ আক্রান্ত মানুষগুলোর প্রচণ্ড বেগ পেতে হয়। এমন নয় যে তারা মানুষের সঙ্গে আলাপচারিতায় অক্ষম। বরং আলাপচারিতায় তারা অন্যদের থেকেও সুমিষ্ট হতে পারে। তবে আকস্মিক কিছু আচরণের জন্য তাদের সম্পর্কগুলো নষ্ট হয় প্রায়শই।

কর্মক্ষেত্রে অস্থিরতা:

চাকরি বদলানো কর্মজীবনে উন্নয়নের একটি অংশ। তবে এডিএইচডি’তে আক্রান্ত ব্যক্তির চাকরি বদলানোর প্রবণতা এত বেশি যে একসময় সেই অভ্যাসটাই তাদের কর্মজীবনের কাল হয়ে দাঁড়ায়। এর পেছনে কারণ হল এক কাজে মনযোগ হারানো। এতে কাজে যেমন তারা পটু হতে পারে না তেমনি দ্রুত কাজ বদলানোর কারণে কর্মকর্তাদের আস্থাভাজনও হয় না।

পরিশেষে : শিশুর চঞ্চলতা কি এডিএইচডি, শিশুর চঞ্চলতার সঙ্গে এডিএইচডি রোগের সম্পর্ক কী,এডিএইচডি কি

আপনার জন্য স্বাস্থ্য বিষয়ক আরো কিছু পোস্ট

স্বাস্থ্য উদ্ভিদ ও প্রাণী ঔষধি গুন গোপন সমস্যা রূপচর্চা রোগ প্রতিরোধ

Leave a Comment