শিক্ষা ও সামাজিক ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের বৈষম্য কেমন ছিল

শিক্ষা ও সামাজিক ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের বৈষম্য কেমন ছিল

১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হলেও পূর্ব বাংলা লাহোর বৈষম্যের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ২৪ বছর আন্দোলন ও সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হয়েছে। শাসকগোষ্ঠীর এ বৈষম্য ও নিপীড়নমূলক প্রস্তাবভিত্তিক পৃথক রাষ্ট্রের মর্যাদা তো পায়ইনি বরং সামাজিক, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, সামরিক, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক নীতির বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলায় প্রথমে প্রতিবাদী এবং শেষ পর্যন্ত স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলনের সূচনা হয়।

পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তানের উপর ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণ শুরু করে। বিশেষকরে শিক্ষা ও সামাজিক ক্ষেত্রে এই বৈষম্যের চিত্র প্রকট আকার ধারণ করে। নিচে তা ব্যাখ্যা করা হলো।

শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য : শিক্ষা ক্ষেত্রেও বাঙালিরা সুস্পষ্ট বৈষম্যের শিকার হয়েছিল। পশ্চিমা শাসকচক্র বাঙালিদের অশিক্ষিত রেখে তাদের শাসনকে পাকাপোক্ত করতে চেয়েছিলেন। বাঙালিদের শিক্ষাক্ষেত্রেও নিরক্ষতা দূরীকরণে তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গৃহীত হয়নি। নিচে উল্লেখ করা হলো :


১. শিক্ষাক্ষেত্রে আর্থিক বরাদ্দের বৈষম্য : পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পাকিস্তানের শুরু থেকেই পূর্ব বাংলার শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংসের ষড়যন্ত্র শুরু করে। পশ্চিম পাকিস্তানে শিক্ষা প্রসার ঘটানোর জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল। অথচ পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষাবিস্তারের ক্ষেত্রে তা বৈষম্যমূলক নীতি গ্রহণ করেছিল। ১৯৫৫-৫৬ সাল থেকে ১৯৬৬-৬৭ সাল পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তানে শিক্ষাখাতে ২,০৮৪.৪ মিলিয়ন রুপি বরাদ্দ হলেও পূর্ব পাকিস্তানে হয়েছিল মাত্র ৭৯৭. ৬ মিলিয়ন রুপি অর্থাৎ এক-তৃতীয়াংশ মাত্র।


২. সাক্ষরতার হার কম : শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক নীতি গ্রহণ করার ফলে পূর্ব পাকিস্তানে শিক্ষিতের হার ছিল নিম্নমুখী। যার ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষিত লোকের সংখ্যা ছিল কম। তাদের জীবনযাত্রাও ছিল নিম্নমুখী।

শিক্ষা ও সামাজিক ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের শোষণ নীতি আলোচনা কর

৩. বৈজ্ঞানিক গবেষণার ক্ষেত্রে বৈষম্য : বৈজ্ঞানিক গবেষণার ক্ষেত্রে ও পূর্ব পাকিস্তানকে যথাযথ বরাদ্দ প্রদান করা হতো না ১৯৫৪ সাল থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত বৈজ্ঞানিক গবেষণার ক্ষেত্রে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বরাদ্দকৃত অর্থের ব্যয় ছিল যথাক্রমে ২০% ও ৮০%-এ ধরনের বৈষম্যের জন্য পূর্ব পাকিস্তানে গবেষণার ক্ষেত্রে তেমন উন্নতি হয়নি।

যেমন পশ্চিম পাকিস্তানে হয়েছিল বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ১৬টির মধ্যে ১৩টি ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। ১৯৬৩-৬৫ সাল পর্যন্ত শিক্ষা দপ্তর কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত।

সর্বমোট বৃত্তির মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানি ছাত্রদের ৩০টি বৃত্তি দেওয়া হয়েছিল এবং বাকি ৫টি বৃত্তি দেওয়া হয়েছিল বাঙালি ছাত্রদের।


৪. উচ্চশিক্ষার প্রতিবন্ধকতা : উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক নীতির কারণে পূর্ব পাকিস্তান উচ্চশিক্ষায় পিছিয়ে পড়তে থাকে। ১৯৪৭-১৯৪৮ সালের পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে বিশ্ববিদ্যালয় সংখ্যা ছিল পূর্ব পাকিস্তানে ১টি এবং পশ্চিম পাকিস্তানে ২টি ।

বিজ্ঞানীর সংখ্যা পশ্চিম পাকিস্তানে ১৯৪৭-৪৮ সালের তুলনায় ১৯৬৮-৬৯ সালে ২৯ গুণ বৃদ্ধি পায়। আর পূর্ব পাকিস্তানে বৃদ্ধি পায় ৫ গুণ। ১৯৬২-৬৯ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য মোট বরাদ্দ ছিল ১,৩৪৯.৩ কোটি টাকা যার মধ্যে ২০৩.৪ কোটি শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ছিল।

অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তানে ৭৪৫.২ কোটি টাকা যার মাধ্যে ৭৬.৫ কোটি টাকা ছিল শিক্ষাখাতে। উপরের তথ্য থেকে প্রতীয়মান হয় যে শিক্ষাখাতে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্য ছিল চরমে।

যে বৈষম্যের কারণে বাঙালিরা পাকিস্তান থেকে মুখ ফিরিয়ে নে


সামাজিক বৈষম্য : পাকিস্তানি শাসনামলে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানিদের মধ্যে সামাজিক ক্ ষেত্রে চরম বৈষম্যমূলক নীতি পরিলক্ষিত হয়। নিচে তা বর্ণনা করা হলো :


১. ধর্মীয় ক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গি : পাকিস্তানকে একটি ইসলামি প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করা হলেও পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানদের মধ্যে ধর্মীয় বৈষম্য ছিল ব্যাপক। পশ্চিম পাকিস্তানিরা ছিল ধর্মীয় রক্ষণশীল ও গোড়া, অন্যাদিকে পূর্ব পাকিস্তানের ধর্মীয় জীবন ছিল উদারনৈতিক ও মানবতাবাদী। পূর্ব পাকিস্তানের উদারনৈতিক ইসলামকে পশ্চিম পাকিস্তানের লোকেরা সন্দেহের চোখে দেখত এবং পূর্ব পাকিস্তানের লোকদের কম গুরুত্ব দিতেন।


২. জাতি-বর্ণ বৈষম্য : পাকিস্তানে জাতি-বর্ণ বৈষম্য ছিল চরম। পশ্চিম পাকিস্তানিরা পূর্ব পাকিস্তানিদের সমান মনে করতো না তারা এদেরকে নিম্ন শ্রেণি মনে করতো। উভয় অঞ্চল ছিল স্বতন্ত্র পোশাক পরিচ্ছদ তাদের আহার্য ও বাসস্থান ছিল ভিন্ন প্রকৃতির।


৩. রাজনৈতিক সংস্কৃতি বৈপরীত্যতা : পাকিস্তানের রাজনৈতিক আদর্শে ছিল ভিন্নতা। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ সংসদীয় ও উদারনৈতিক গণতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিল। অন্যদিকে, পশ্চিম পাকিস্তানি জনগণ ধর্মীয় মূল্যবোধকে রাজনীতিতে প্রবেশ করায় বেশি। তারা ইসলামি আদর্শের সাথে রাজনৈতিক আদর্শ একাকার করে ফেলে।


৪. প্রশাসনে পশ্চিম পাকিস্তানিদের প্রাধান্য : ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর পশ্চিম পাকিস্তান অংশে পুরাতন প্রশাসন বিভাগ ব্যবস্থা মূলত অপরিবর্তনীয় থেকে যায়। অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তানে প্রশাসনিক ব্যবস্থা ছিল দুর্বল প্রকৃতির। ফলে পূর্ব-পাকিস্তানের প্রশাসনে অধিকমাত্রায় পশ্চিম পাকিস্তানিরা নিয়োগ পেত।

শিক্ষা ও সামাজিক ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের শোষণ নীতি আলোচনা কর


৫. পশ্চিম পাকিস্তানি পুঁজিপতিদের প্রাধান্য : পুঁজিপতিদের মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানিরা এগিয়ে ছিলেন। ষাটের দশকের শেষের দিকে দেশের শিল্পের ৬৬% বিমা ব্যবসায়ের, ৯৭% ব্যাংক ডিপোজিটের ৮০% ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি পুঁজিপতিদের ২২ পরিবারের দখলে।


৬. সামাজিক অবকাঠামোমূলক বৈষম্য : পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় পূর্ব পাকিস্তানের সামাজিক অবকাঠামো ছিল পশ্চাৎপদ। গবেষণা, উন্নয়ন, কৃষি, চিকিৎসা, বিজ্ঞান, শিল্প, গবেষণার জন্য প্রতিষ্ঠিত কেন্দ্রের সিংহভাগ ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। তাই গবেষষণা উন্নয়ন, কৃষি, চিকিৎসা, বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণার ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানিরা পিছিয়ে ছিল।


৭. ভোগ্যপণ্যের ব্যবহারে পার্থক্য : পাকিস্তানের খাবার ও দৈনন্দিন ব্যবহারের পণ্যের সরবরাহ ক্ষেত্রে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে বৈষম্য ছিল । পূর্ব পাকিস্তানের তুলনায় পশ্চিম পাকিস্তানিরা চর্বি, উদ্ভিদ ও দুধ জাতীয় পণ্য বেশি ভোগ করতো।

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, পাকিস্তান রাষ্ট্র গড়ে উঠার সূচনালগ্ন থেকেই পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী পূর্ব বাংলাকে তাদের উপনিবেশ হিসেবে বিবেচনা করে।

এ অঞ্চলের মানুষকে রাজনৈতিক, সামরিক, প্রশাসনিক, সামাজিক, শিক্ষা ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করার কৌশল অনুসরণ করতে থাকে।

বাঙালিদের শিক্ষা ও সামাজিক বৈষম্য সৃষ্টি করে পাকিস্তান সরকার দমন নির্যাতন ও নিপীড়ন চালায় দীর্ঘ ২৪ বছর ধরে।

আর্টিকেলের শেষ কথাঃশিক্ষা ও সামাজিক ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের বৈষম্য কেমন ছিল

Leave a Comment