মৌলিক গণতন্ত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য গুলো কি কি, মৌলিক গণতন্ত্র কে প্রবর্তন করেন?, মৌলিক গণতন্ত্র কয় স্তর বিশিষ্ট?

মৌলিক গণতন্ত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য গুলো কি কি, মৌলিক গণতন্ত্র কে প্রবর্তন করেন?, মৌলিক গণতন্ত্র কয় স্তর বিশিষ্ট?মৌলিক গণতন্ত্রে ইউনিয়ন কাউন্সিল

মৌলিক গণতন্ত্র কি ?

মৌলিক গণতন্ত্র কি ?

মৌলিক গনতন্ত্র হল সীমিত গণতান্ত্রিক সংস্করণ ব্যবস্থা যেখানে সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তির পরিবর্তে নির্দিষ্ট সংখ্যক প্রতিনিধির ভোটাধিকারের ভিত্তিতে জাতীয় নির্বাচন হয়ে থাকে

ইস্কান্দার মির্জা পাকিস্তানের ক্ষমতা গ্রহণ করে ১৯৫৮ সালে পুরো দেশে সামরিক আইন জারি করেন। এসময় তিনি তৎকালিন সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল আইয়ুব খানকে নিযুক্ত করলেন সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে। কিন্তু পরবর্তীতে ২৭ অক্টোবর আইয়ুব খানের চাপে ইস্কান্দার মির্জা বাধ্য হন প্রেসিডেন্টের পদ থেকে সরে দাড়াতে। ইস্কান্দার মির্জাকে উৎখাত করে আইয়ুব খান নতুন করে সামরিক শাসন করার ফন্দি আটেন। তিনি গণতন্ত্রের নামে একপ্রকার পদ্ধতি চালু করেন যা মৌলিক গনতন্ত্র নামে পরিচিত।

মৌলিক গণতন্ত্র ব্যাবস্থাটি খুব একটা পুরোনো ধারণা নয়। এটি ছিলো এক প্রকার স্থানীয় সরকার পদ্ধতি। এই শাসন ব্যাবস্থায় জনগণের স্বতস্ফুর্ত অংশগ্রহনের পরিবর্তে কেবল সুনির্দিষ্ট কিছু প্রতিনিধির মাধ্যমে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব নির্বাচন করা হয়। কর্তৃত্ববাদী পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ ব্যাবস্থা প্রথম চালু হয়েছিলো। ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসক আইয়ুব খান এক সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে পাকিস্তানের ক্ষমাতায় আসেন।

মৌলিক গণতন্ত্র কে প্রবর্তন করেন?

মোহাম্মাদ আইয়ুব খান

মৌলিক গণতন্ত্র প্রবর্তন করেন মোহাম্মদ আইয়ুব খান।

ক্ষমতা গ্রহণের এক বছর পরে অর্থাৎ ১৯৫৯ সালে তিনি এই অভিনব গণতন্ত্র পদ্ধতি ঘোষণা করেন বা আদেশ জারি করেন। আইয়ুব খান তার ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে রাখার জন্য সুনির্দিষ্ট কিছু এজেন্ডা নিয়ে এটি প্রবর্তন করেছিলেন। তাই আইয়ুব খানকে ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ ব্যাবস্থার জনক বলা হয়। তিনি এই ব্যাবস্থা সম্পর্কে বলেছিলেন, “মৌলিক গণতন্ত্র জনগণকে সরকারের সাথে আরও বেশি সম্পৃক্ত করবে এবং সরকারি কর্মকর্তাগণ জনগণের সাথে সম্পৃক্ত হবেন”। কিন্তু তার এই পদ্ধতি প্রণয়ন করার উদ্দেশ্য ছিলো রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করা। আইয়ুব খান মৌলিক গণতন্ত্র ব্যাবস্থাকে দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের জন্য ভিত্তিপ্রস্তর হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “It will be a new foundation stone of the political system in our country’. কিন্তু তার প্রণিত এই পদ্ধতি নিয়ে তৎকালিন রাজনৈতিক দলগুলো একমত হতে পারেনি। আইয়ুব খান ও তার অনুগত শাসক দলের ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করার একটি অপপ্রয়াস হিসেবে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল আখ্যায়িত করেছিলো।


আরো ও সাজেশন:-

মৌলিক গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্যসমূহ

১৯৪৭ সালের পর থেকে স্বাধীনতার পূর্ব পর্যন্ত বাংলার মানুষকে শাসনক্ষমতা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। ক্ষমতাকে একচেটিয়া করার জন্য ‘মৌলিক গনতন্ত্র’ ছিলো এমনই একটি ব্যাবস্থা। পরোক্ষভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধির সংখ্যা ছিলো আশি হাজার। ১৯৫৯ সালের ২৬ শে অক্টোবর এক আদেশ জারির মাধ্যমে ‘মৌলিক গনতন্ত্র’ চালু করা হয়।

১৯৬০ সালের ১১ জানুয়ারি প্রথম মৌলিক গনতন্ত্রী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং একই বছর ফেব্রুয়ারি মাসে এসব নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির হ্যা-না ভোটের মাধ্যমে আইয়ুব খান প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। অর্থাৎ দেশের সরকার প্রধান বা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সরাসরি জনগণের অংশগ্রহণ বা প্রত্যক্ষ ভোট দেয়া থেকে বঞ্চিত করা হয়। মৌলিক গনতন্ত্র ব্যাবস্থার বিশেষত্ত ছিলো যে, মৌলিক গনতন্ত্রী ৮০০০০ সদস্যগণ কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচন এবং প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভূমিকা রাখতো।আইয়ুব খান ‘মৌলিক গনতন্ত্র’ কে ব্যাবহার করে নির্বাচিত হওয়ার পরে সংবিধান প্রনয়ণ করার ক্ষমতা লাভ করেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৬২ সালের ১লা মার্চ সংবিধান ঘোষণা করা হয়।

সংবিধান প্রনয়নের বৈশিষ্ট্য ছিলো যে, সারা দেশ থেকে মৌলিক গনতন্ত্রের নির্বাচিত ৮০০০০ সদস্যবৃন্দ প্রেসিডেন্ট ও সংসদ সদস্য নির্বাচন করতে পারবেন। আইয়ুব খান তার প্রণিত এই গণতান্ত্রিক মডেলে তিনি সাফল্য লাভ করেন এবং ১৯৬৫ সালে জনগণকে ভোট দান থেকে বঞ্চিত করে এসব ৮০০০০ নির্বাচিত সদস্যের মাধ্যমে পুনরায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন এবং নিজেকে নির্বাচিত শাসক ঘোষণা করেন।

[ বি:দ্র: উত্তর দাতা: রাকিব হোসেন সজল ©সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত (বাংলা নিউজ এক্সপ্রেস)]

মৌলিক গণতন্ত্র কয় স্তর বিশিষ্ট?

মৌলিক গনতন্ত্রকে মোট পাচটি স্তরে বিভক্ত করা হয়েছিলো। স্তরগুলো ছিলো একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ের। পাচ স্তর বিশিষ্ট এই গণতান্ত্রিক ব্যাবস্থায় ছিলো ইউনিয়ন কাউন্সিল, থানা, জেলা, বিভাগীয় এবং প্রাদেশিক কাউন্সিল। স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন কাঠামোর অংশ হিসেবে এটিকে উপস্থাপন করা হয়েছিলো। মৌলিক গনতন্ত্র কাঠামোতে সরাসরি জনগণের স্বতস্ফুর্ত অংশগ্রহনে বাধা সৃষ্টি করেছিলো। আসুন জেনে নেই চার স্তর বিশিষ্ট ‘মৌলিক গনতন্ত্র’ কাঠামো সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য। 

১. ইউনিয়ন কাউন্সিল

মৌলিক গনতন্ত্র কাঠামো একদম তৃণমূল থেকে গড়ে উঠেছিলো। ইউনিয়ন কাউন্সিল হচ্ছে মৌলিক গনতন্ত্রের সবচেয়ে নিচের বা প্রাথমিক স্তর। প্রতিটি ইউনিয়ন কাউন্সিল গঠিত হয়েছিলো প্রায় ৫ থেকে ৮ টি গ্রাম নিয়ে৷ প্রায় দশ হজার থেকে পনেরো হাজার জনগোষ্ঠী নিয়ে এটি গঠিত হতো। পৌর এলাকায় এঈ কাউন্সিলের নাম ছিলো ইউনিয়ন কমিটি এবং শর এলাকায় না ম ছিলো টাউন কমিটি৷ প্রতিটি ইউনিয়ন কাউন্সিল গঠন করা হতো ১৫ জন সদস্যের সমন্বয়ে। এর মধ্যে ১০ জন নির্বাচিত হতেন জনগণের সরাসরি ভোটে। আর বাকি ৫ জনকে মনোনয়ন করা হতো। 

কিন্তু ১৯৬২ সালে মনোনয়ন পদ্ধতি বাতিল করে দেওয়া হয়৷ ইউনিয়ন কাউন্সিলের এসব সদস্য থেকে আবার একজন চেয়ারম্যান এবং একজন ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হতেন। এভাবে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে ৮০০০০ হাজার মৌলিক গনতন্ত্রী হয়, যারা প্রাদেশিক এবং জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতো। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় তারা ইলেক্টরাল কলেজের ভূমিকা পালন করতো।

কার্যাবলি হিসেবে কাউন্সিলের সদস্যদের কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য, যোগাযোগ ও খাদ্য উৎপাদন ব্যাবস্থার মতো দায়িত্ব দেয়া হয়। পরবর্তীতে এসব কাউন্সিল সদস্যদের তথা ইউনিয়ন কাউন্সিলকে রাষ্ট্রপতি কিংবা সংসদ সদস্য নির্বাচন করার জন্য ইলেক্টোরাল কলেজের দায়িত্ব দেয়া হয়।

২. থানা কাউন্সিল

থানা কাউন্সিল হচ্ছে তৎকালিন মৌলিক গনতন্ত্রের বা স্থানীয় শাসন কাঠামোর দ্বিতীয় স্তর। থানা কাউন্সিল পর্যায়ে কোনো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতো না। কিছু বেসরকারি সদস্য এবং কিছু প্রাতিষ্ঠানিক সদস্য নিয়ে এটি গঠিত হতো। থানার আওতায় থাকা সকল ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান হচ্ছে বেসরকারি সদস্য এবং সরকারি বা প্রাতিষ্ঠানিক সদস্য হিসেবে গণ্য হতেন থানার অন্তর্ভুক্ত সরকারি কর্মকর্তাগণ। 

প্রাতিষ্ঠানিক ও বেসরকারি সদস্য সংখ্যা সমান ছিলো। মহকুমা প্রশাসককে থানা কাউন্সিলের সভাপতি নিযুক্ত করা হতো। থানা কাউন্সিলের কাজ ছিলো ইউনিয়ন কাউন্সিল এবং জেলা কাউন্সিলের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা। 

৩. জেলা কাউন্সিল

জেলা কাউন্সিলকে থানা কাউন্সিলের উপরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তর বিবেচনা করা হতো। জেলা কাউন্সিল সদস্যবৃন্দও ছিলেন দুইভাগে বিভক্ত। এক ভাগ ছিলেন বেসরকারি সদস্য, যারা ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যানদের দ্বারা নির্বাচিত হতো। আবার সরকারি সদস্যদের মধ্যে ছিলেন ঐ জেলার অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন উচ্চ পদস্থ সরকারি কর্মকর্তাবৃন্দ। জেলা কাউন্সিলের সরকারি সদস্যদের মধ্যে ছিলেন, সিভিল সার্জন, জেলা কৃষি কর্মকর্তা, নির্বাহি প্রকৌশলী, সরকারী রেজিস্ট্রার, বন বিভাগের কর্মকর্তা, জেলা আনসার এডজুটেন্ট, বিদ্যুৎ বিভাগের নির্বাহি প্রকৌশলী প্রমুখ। জেলা কাউন্সিলের সর্বোচ্চ সদস্য সংখ্যা ছিলো ৪০ জন। জেলা কাউন্সিল ছিলো আইয়ুব খান সরকারের শাসনব্যাবস্থার অন্যতম স্তর। তিনি এসব সদস্যদের অনুগত্য ও সমর্থন আদায় করে তার শাসনের বৈধতা আনতে চেয়েছিলেন।

জেলা কাউন্সিলকেও কিছু দায়িত্ব দেয়া হয়েছিলো। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, আর্থিক ও নির্বাহি ক্ষমতা সম্পাদন করা। জেলায় চলমান বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কার্যক্রম করা, কর আরোপ করা প্রভৃতি। জেলা প্রশাসকের কার্যাবলি আবার দুই ভাগে বিভক্ত ছিলো। যেমনঃ ঐচ্ছিক কার্যাবলি এবং বাধ্যতামূলক কার্যাবলি।

বিদ্যালয়, পাবলিক রাস্তা, খেলার মাঠ, হাসপাতাল, গ্রন্থাগার নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ করা ছিলো বাধ্যতামূলক কাজের অন্তর্ভুক্ত। সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক কল্যাণমূলক কাজ এবং মাধ্যমিক কিংবা উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার ব্যাবস্থা করা ছিলো ঐচ্ছিক কার্যাবলির অন্তর্ভুক্ত। 

৪. বিভাগীয় কাউন্সিল

কাগজে কলমে মৌলিক গনতন্ত্র ব্যাবস্থার সর্বোচ্চ স্তর ছিলো বিভাগীয় কাউন্সিল। এই কাউন্সিলেরও সদস্যদের মধ্যে ছিলো অর্ধেক সরকারি ও বাকি অর্ধেক বেসরকারি। সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে মোট ৪৫ জন সদস্য সংখ্যা ছিলো। বেসরকারি সদস্যদের মধ্যে ছিলেন জেলা কাউন্সিলের চেয়ারম্যান, ইউনিয়ন কাউন্সিল থেকে নির্বাচিত এবং বিভিন্ন দফতরের প্রতিনিধিগণ।

বিভাগীয় কাউন্সিলের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হতেন বিভাগীয় কমিশনার। তিনি তার পদাধিকার বলে এই কাউন্সিলের চেয়ারম্যান হতেন। বিভিন্ন জেলা কাউন্সিলগুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধন করা ছিলো বিভাগীয় কাউন্সিলের প্রধান কাজ। 

৫. প্রাদেশিক কাউন্সিল

প্রাদেশিক কাউন্সিলের শাসন ক্ষমতা মূলত ছিলনা বললেই চলে। পাকিস্তানের দুই অংশ তথা পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে প্রাদেশিক উন্নয়ন উপদেষ্টা গঠিত হয়। কিন্তু গঠনগত দিক দিয়ে বিবেচনা করলে এটি মুলত বিভাগীয় কাউন্সিলের অনুরূপ ছিলো। এই পরিষদেও ইউনিয়ন কাউন্সিল থেকে সদস্য নেওয়া হতো। যখন পাকিস্তানের দুই অংশে প্রদেশিক পরিষদ গঠিত হয় তখন এ পরিষদ বাতিল ঘোষণা করা হয়৷

মৌলিক গনতন্ত্র অধ্যাদেশ জারি করে যে পাচটি পরিষদ গঠন করা হয় তাদের মধ্যে সকল পরিষদের তেমন কোনো কার্যাবলি ছিলোনা। এই পরিষদগুলোর মধ্যে ইউনিয়ন ও জেলা পরিষদকে শুধুমাত্র সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব দেয়া হয়। বিভাগীয় পরিষদ কিংবা থানা পরিষদ নামে বড় হলেও মুলত তাদের তৃণমুল পর্যায়ে কাজ ছিলোনা। এই দুই পরিষদের মুল কাজ ছলো সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করা। কিন্তু ইউনিয়ন কাউন্সিলের কাজ ছিলো ব্যাপক ও বিস্তৃত। এই পরিষদকে বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত করা হয়৷ খাদ্য উৎপাদন, কৃষি উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প, সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজ প্রভৃতি ছিলো ইউনিয়ন পরিষদের উপর আরোপিত।

ইউনিয়ন পরিষদে গ্রাম পুলিশ বাহিনী ছিলো। যার মাধ্যমে গ্রামের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা হতো। ইউনিয়ন পরিষদের শালিসি কোর্টের মাধ্যমে গ্রামের ছোটখাটো বিচার কাজ, দেওয়ানি মামলা বা ফৌজদারি মামলা গুলোর বিচারকার্য ও মামলা নিষ্পত্তি করা হতো। ইউনিয়নের বিভিন্ন রাস্তাঘাট নির্মাণ ও সংরক্ষণ, ব্রীজ ও কালভার্ট নির্মাণ, বাধ নির্মাণ প্রকল্প সামলানো ও নির্মাণ করা, জমিতে জলসেচের ব্যাবস্থা করা ইত্যাদি কাজের পরিকল্পনা গ্রহণ করে বাস্তবায়নের দায়িত্ব ছিলো ইউনিয়ন পরিষদের কাছে। কর ধার্য করা ও আদায় করা এবং টোল ফি আদায় করার ক্ষমতা ইউনিয়ন কাউন্সিলের ছিলো।

থানা পরিষদ তার কাজের জন্য জেলা পরিষদের উপর দায়ি থাকতো। থানা পরিষদ মুলত ছিলো সমন্বয়কারী সংগঠন। থানার অধীনে যে সকল ইউনিয়ন ও শহর কমিটি ছিলো তাদের কাজের দেখভাল করা ও সমন্বয় করা ছিলো থানা কাউন্সিলের প্রধান কাজ। ইউনিয়ন কাউন্সিল অথবা শহর কমিটির হাতে নেয়া উন্নয়ন প্রকল্প ও কার্যাবলির তত্ত্বাবধায়ক ছিলো থানা কাউন্সিল। থানা কাউন্সিল আবার জেলা কাউন্সিলের নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করতো।

জেলা পরিষদ কৃষি, শিল্প ও সমাজের উন্নয়ন, সমবায় উন্নয়ন প্রভৃতি কাজ করতো। যেসব স্থানীয় পরিষদ জেলার মধ্যে ছিলো তাদের মধ্যে সমন্বয় সাধন করতো জেলা কাউন্সিল। এছাড়া জাতি গঠনমূলক সেবা কার্যক্রম ও বিভাগসমূহের মধ্যে উন্নয়ন ও উৎকর্ষ সাধনা করা, বিভাগীয় পরিষদ ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট তাদের কার্যাবলির প্রস্তাব পেশ করা ছিলো জেলা পরিষদের দায়িত্ব। জেলা পরিষদের কাজের ব্যাপকতার তুলনায় বিভাগীয় কাউন্সিলের কাজ ছিলো খুবই কম। বিভাগীয় পরিষদ মুলত উপদেষ্টার মতো কাজ করেছিলো।

মৌলিক গণতন্ত্রে জনগণের ভূমিকা কেমন ছিল ?

১৯৪৭ সালে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরেও পাকিস্তানের পূর্ব অংশ তথা বাঙ্গালি সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ স্বাধীনতার প্রকৃত স্বাদ আস্বাদন করতে পারেনি। ‘৪৭ এর পর থেকেই শাসনক্ষমতা পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী তাদের কাছে কেন্দ্রীভূত করে রেখেছে। দীর্ঘ ২৩ বছরের মধ্যে অধিকাংশ সময় সামরিক শাসনের কবলে পড়ে ছিলো দেশের গনতন্ত্র। বাঙ্গালী ও সাধারণ জনগণের ন্যায্য অধিকার থেকে বারংবার বঞ্চিত করা হয়েছে। ইস্কান্দার মির্জাকে হটিয়ে জেনারেল আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করেও সামরিক সৈরাচারীতার পরিচয় দেন। 

তিনি গণতন্ত্রের নামে অপকৌশল হাতে নেন। এক্সাতে তার ক্ষমতা পাকাপোক্ত ও বৈধ হয়। মৌলিক গণতন্ত্র ছিলো এই অপকৌশলের হাতিয়ার স্বরূপ। এই পদ্ধতিতে তিনি সাধারণ জনগণকে মুল ধারার গনতন্ত্র থেকে বঞ্চিত করেন। মানুষ তার ভোটাধিকার হারিয়ে ফেলে। মৌলিক গনতন্ত্র চালুর ফলে মানুষের মনে ধীরে ধীরে ক্ষোভ বাড়তে থাকে। আইয়ুব খানের এই অভিনব কৌশল সাধারণ জনগণ বুঝে গিয়েছিলো। দেশকে প্রকৃত গনতন্ত্র ফিরিয়ে দিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালে ঐতিহাসিক ৬ দফা ঘোষণা করেন। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করতে ছয় দফা ছিলো মুক্তির সনদ স্বরুপ। তাই দীর্ঘদিনের জমে থাকা ক্ষোভ নিয়ে সাধারণ জনগণ মৌলিক গনতন্ত্রের বিরুদ্ধে দূর্বার আন্দোলন গড়ে তুলেছিলো। 

বাংলার আপামর জনতা ছয় দফাতে সমর্থন জানায়। আইয়ুব খানের অপকৌশলের বিরুদ্ধে শুরু হয় তীব্র আন্দোলন যা শেষ পর্যন্ত গণ অভ্যুত্থানে রূপ নেয়। ১৯৬৯ সালে সেই গণ অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আইয়ুব খানের পতন ঘটে। মৌলিক গনতন্ত্র ছিলো মুলত সাধারণ জনগণের সাথে ধোকাবাজি। তাই জনতা এটিকে গ্রহণ না করে প্রত্যাখ্যান করেছে। কারণ মৌলিক গনতন্ত্র কায়েমের ফলে পাকিস্তানের দুই অংশে তীব্র রাজনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য ফুটে উঠেছিলো।

মৌলিক গণতন্ত্রের উদ্দেশ্য

মৌলিক গনতন্ত্র স্থানীয় সরকারের ভূমিকা পালন করতো এবং জনগণের সমর্থন আদায় ও সরকারের বৈধতা দানের উদ্দেশ্য নিয়ে এই ব্যাবস্থা প্রনয়ণ করা হয়েছিলো। অর্থাৎ সরকারের রাজনৈতিক ও নির্বাচনী দায়িত্ব একসাথে পালন করতে মৌলিক গনতন্ত্র কায়েম করা হয়েছিলো। ১৯৬০ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করার যে ব্যাবস্থা করা হয়েছিলো তাতে মৌলিক গনতন্ত্রী সদস্যরা আইয়ুব খানের পক্ষে সমর্থন দিয়েছিলেন। প্রশাসনের সকল স্তরে গনতন্ত্রের নাম করে নিজের অবস্থান শক্তিশালী করাই ছিলো আইয়ুব খানের মৌলিক গনতন্ত্র প্রবর্তন করার আসল উদ্দেশ্য। প্রায় এক দশকেরও বেশি সময় ধরে আইয়ুব খান এই মৌলিক গনতন্ত্রকে ঢাল হিসেবে ব্যাবহার করে শাসন ক্ষমতায় টিকে ছিলো। তিনি ক্ষমতা গ্রহণ করেই দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। দেশের বরেণ্য রাজনিতিবীদ ও উচ্চপদস্থ বক্সাক্তিদের কারারুদ্ধ করে আন্দোলনের পথ বন্ধ করে দিতে চেয়েছিলেন। মৌলিক গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পরে কখনই জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটেনি। এর ফলে সরকারের সাথে জনগণের দূরত্ব বেড়ে গেলেও মৌলিক গনতন্ত্রীদের ক্ষমতা বহুগুণে বেড়ে গিয়েছিলো। 

কিন্তু গ্রামের এবং শহরের আপামর জনগণ এই একচেটিয়া নির্বাচনী ব্যাবস্থার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছিলো। মৌলিক গনতন্ত্র গঠন করে আইয়ুব সরকার যে বৈধতা পেতে চেয়েছিলো তা তো ভূলন্ঠিত হয়েই যায়, এছাড়া ১৯৬৯ সালের গণ অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এই গনতন্ত্র ব্যাবস্থা তার বৈধতা হারিয়ে বাতিল হয়ে যায়। 

উপসংহার

প্রাচীন গ্রীসে যখন গণতন্ত্রের যাত্রা হয়, তখন থেকে কালের বিবর্তনে গণতন্ত্র আজ এমন আধুনিক রূপ লাভ করেছে। যেখানে জনগণই শেষ কথা। জনগণ তাদের ইচ্ছামতো শাসক নির্বাচন করবে। তাদের ক্ষমতা প্রয়োগ করবে। কিন্তু পাকিস্তান জান্তা শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানের মানুষকে দীর্ঘ ২৩ বছর তাদের পদানত করে রেখেছে। তাদের ইচ্ছামতো শাসনতন্ত্র কায়েম করেছে। মৌলিক গনতন্ত্র ব্যাবস্থা ছিলো তেমনি একটি ব্যাবস্থা। ক্ষমতাকে ধরে রাখা ও বাংলার মানুষকে বঞ্চিত করাই ছিলো এর মূল উদ্দেশ্য। আমাদের গনতন্ত্র পুনরুদ্ধার করার জন্য অনেক জীবন বিসর্জন দিতে হয়েছে। বাঙ্গালির স্বাধীকার আন্দোলন ও গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় মৌলিক গনতন্ত্র নামক নীলনকশা টিকতে পারেনি।

Leave a Comment