প্রাচীন গ্রিক দর্শনের উৎপত্তি ব্যাখ্যা করুন,ভারতীয় দর্শনের উৎপত্তির কারণ কী?

প্রাচীন গ্রিক দর্শনের উৎপত্তি ব্যাখ্যা করুন,ভারতীয় দর্শনের উৎপত্তির কারণ কী?

গ্রীক দর্শনের উদ্ভব ব্যাবিলন ও মিশরে নয় : রাহুল সাংস্কৃত্যায়ন গ্রীক দর্শনের পেছনে ব্যাবিলনীয় সভ্যতার প্রভাবের কথা বলেন। গ্রীক বণিকরা বাণিজ্যের মাধ্যমে অত্যন্ত প্রাচীন ও সম্মানীয় কৃষ্টির সাথে পরিচিত হয়। তারপর এই সুপ্রাচীন সভ্যতা থেকে গণিতশাস্ত্র, জ্যোতিশাস্ত্র, প্রকৃতিবিজ্ঞান, চিকিৎসা বিজ্ঞান প্রভৃতি শিক্ষা গ্রহণ করে মেধাবী হন। এই ভাববিনিময়ের ফলে হয়েছিল গ্রীক দর্শনের সবচেয়ে পুরনো শাখা আয়োনীয় সম্প্রদায়ের (থেলিস, অ্যানাক্সিমেন্ডার, অ্যানাক্সিমিনিস) আবির্ভাব। তাই গ্রীক দর্শনের উৎপত্তিকে ব্যবলনীয় ও মিশরীয় সভ্যতা প্রভাবিত বলে মনে করা হয়। তবে এই মত পরিত্যাক্ত হয়েছে। বার্নেট এই প্রসঙ্গে বলেন, গ্রীকদেরকে এখানে যাদের কাছে ঋণী বলা হচ্ছে, আসলে তাদের কোন দর্শনই ছিল না। তাই গ্রীকদের কাছে এদের থেকে গ্রহণ করার মত কিছু ছিলই না। কেউ কেউ বলেন গ্রীকরা তাদের গণিত মিশর ও জ্যোতির্বিজ্ঞান ব্যাবিলন থেকে লাভ করেছে, কিন্তু বার্নেট, কপলস্টোন প্রমুখ এই জাতীয় অভিমত নাকছ করে দেন। বার্নেট বলেন, গ্রীকরা গণিতের জন্য মিশরের কাছে ঋণী হলে, পিথাগোরাস ও তার অনুগামীদের সমতল জ্যামিতির মৌলিক নিয়মগুলো প্রমাণ করার দরকার হত না। আর ব্যাবিলনীয়দের যদি সৌরমণ্ডল সম্পর্কে জ্ঞান থাকত তাহলে গ্রীকরা পৃথিবীর যথার্থ আকার ও চন্দ্র-সূর্য-গ্রহণের ব্যাখ্যার জন্য তৎপর হত না। কপলস্টোন বলেন, মিশরীয়রা যে জ্যামিতির বিকাশসাধন করে তা বিজ্ঞানসম্মত ছিল না, গ্রীকরাই বিজ্ঞানসম্মত জ্যামিতির বিকাশ ঘটান। আর ব্যাবিলনীয় জ্যোতির্বিদ্যা ছিল মূলত জ্যোতিষবিদ্যা বা এস্ট্রোলজি। গ্রীকরাই বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে জ্যোতির্বিদ্যার চর্চা শুরু করে।

প্রাচ্যের সৃষ্টিতত্ত্বগুলো গ্রীক দর্শনের উৎস্য নয় : অনেকে বলেন, প্রাচ্যদেশের সৃষ্টিতত্ত্ব বা কসমোগনিগুলো গ্রীক দর্শনের উৎস্য। তবে বার্নেট বলছেন, সৃষ্টিতত্ত্বগুলো গ্রীক দর্শনের উৎপত্তির উৎস্য হিসেবে অত গুরুত্বপূর্ণ নয়। গ্রীকদের মধ্যেই থেলিসের পূর্বে অনেক সৃষ্টিতত্ত্ব ছিল যেগুলো মিশর ও ব্যাবিলনের সৃষ্টিতত্ত্ব থেকেও প্রাচীন হতে পারে। যেসব জাতি সভ্যতা তৈরি করতে পারেনি, অনুন্নত তাদেরও সৃষ্টিতত্ত্ব থাকতে পারে। এসবের সাথে দর্শনের কোন সম্পর্ক নেই। যেখানে বিচারবুদ্ধিভিত্তিক আলোচনা থাকে না সেখানে দর্শনও থাকে না। এই বিচারবুদ্ধিভিত্তিক বিজ্ঞান গ্রীকদেরই সৃষ্টি।

ভারতীয় উপমহাদেশের চিন্তাধারার প্রভাব? : ভারতীয় উপমহাদেশের ধর্ম, পৌরাণিক সাহিত্য, লোকায়ত দর্শন, জৈনদর্শন, বৌদ্ধদর্শন, বেদান্তদর্শন প্রভৃতির কোন কোন মতবাদের সাথে গ্রীক ধর্ম, সাহিত্য ও কোন কোন দার্শনিক মতবাদের যথেষ্ট মিল থাকায় অনেকে গ্রীক দর্শনে ভারতীয় উপমহাদেশের চিন্তাধারায় প্রভাবের কথা বলেন। এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে ভারতীয় চিন্তাধারা গ্রীকদের অগ্রগামী ছিল। প্রাচীনকালের আর্য চিন্তাবিদদের একেশ্বরবাদ ও দেবতাবাদ, লোকায়েতদের জড়বাদ বা উপাদানবাদ, জৈনদের জীববাদ, পরমাণুবাদ, বৌদ্ধদের জন্মান্তরবাদ, অবভাসবাদ, ক্ষণিকবাদ, নীতিবাদ ও ন্যায়তত্ত্ব ও ঔপনিষদদের দার্শনিক মতবাদগুলোর সাথে প্রাচীন গ্রীক দর্শনের অনেক সামঞ্জস্য রয়েছে। ম্যাক্সমূলার, ওয়েবার প্রমুখ এই কথা বলেন। ফরাসী দার্শনিক ফুঁজে বলেন, ভারতীয় উপমহাদেশের দর্শন অবলম্বন করে গ্রীক দর্শনের বিকাশ লাভ ঘটে। পিথাগোরাস সম্প্রদায় ও প্ললেটোর দর্শনে জন্মান্তরবাদ আছে। বিশেষ করে থেলিস, অ্যানাক্সিমিনিস, অ্যানাক্সিমেন্ডার, এম্পিডোকলেস, হেরাক্লিটাস, জেনোফেনিস, পারমেনাইডিস, প্লেটো প্রমুখ দার্শনিকদের সাথে ভারতীয় অভিমতের মিল আছে। এজন্য কেউ কেউ একথা বলেন যে, ভারতীয় দর্শন থেকে গ্রীক দর্শনের উৎপত্তি। তবে দুটি দেশের মধ্যে কোন কোন মতবাদের সাদৃশ্য দেখে বলা যায় না যে, এক দেশ অপর দেশের কাছ থেকে এসব মতবাদ গ্রহণ করেছে। কপলস্টোন বলেন, মানুষের বুদ্ধি সদৃশ অভিজ্ঞতাকে সদৃশভাবে ব্যাখ্যা করার ব্যাপারে যথেষ্ট পরিমাণে সমর্থ, সেটা গ্রীক বা ভারতীয় যার বুদ্ধিই হোক না কেন।

গ্রীক দর্শনের উদ্ভব গ্রীসে : উপরের কারণগুলোর জন্য অনেকে সিদ্ধান্ত নেন যে গ্রীক দর্শনের উদ্ভব গ্রীসেই হয়েছিল। গ্রীক দর্শনের শুরু কখন তা জানা যায়, এর প্রারম্ভিক দিকের প্রতি সচেতন দৃষ্টি দিলে বোঝা যায় যে এই দার্শনিক চিন্তা মৌলিক ও এর উপর অন্য দর্শনের প্রভাব পড়েনি। গ্রীক দর্শনের প্রারম্ভটা এতই সরল যে, এই সামান্য দার্শনিক চিন্তার অধিকারী গ্রিকরা হতে পারেনা তা ভাবা যায়না। খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতকে গ্রীক দর্শনের শুরু। বস্তুজগতের মূলতত্ত্বের স্বরূপ কী, এই প্রশ্নের আলোচনাকে নিয়েই গ্রীক দর্শনের শুরু। তারপর ধীরে ধীরে বাহ্য প্রকৃতি থেকে গ্রীক দর্শনের দৃষ্টি পড়ে মানুষের উপর।

সত্তা সম্পর্কিত সমস্যা গ্রীক দর্শনে প্রাধান্য লাভ করে : বার্নেট বলেন, সামগ্রিকভাবে দর্শনের দিকে তাকালে দেখা যায় শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত গ্রীক দর্শনে প্রাধান্য লাভ করেছে সত্তা বা রিয়ালিটি সম্পর্কিত সমস্যা। সত্তা কী, এই প্রশ্ন প্লেটো ও এরিস্টোটল যেমন করেছেন, তেমনি থেলিসও করেছেন। থেলিসের উত্তর যেমনই হোক না কেন, তিনি যখন এই প্রশ্ন করেন তখন থেকেই তার দার্শনিক চিন্তার পরিচয় লাভ করা যায়। আর সেই সময়টাই ছিল পাশ্চাত্য দর্শনের সূচনা।

আমরা এর আগেই দেখেছি যে দর্শনশাস্ত্রের উদ্ভব এবং বিকাশ অগ্রগতি এবং অচল অবস্থা এই সবকিছুই নির্ভর করে সমাজের উৎপাদিকা শক্তির ক্রমবিকাশের উপর; উৎপাদন সংগ্রাম, শ্রেণীসংগ্রাম এবং বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার ক্রমবিকাশের উপর। ভারতীয় সমাজ আদিম সাম্যবাদী ব্যবস্থা ও দাসব্যবস্থার যুগ পেরিয়ে এসেছে এবং সামন্ত সমাজে উপনীত হওয়ার পর অচলাবস্থার সম্মুখীন হয়। ঐ একই সামাজিক কাঠামো ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি আসার আগে পর্যন্ত অটুট থেকে গিয়েছিল। এইভাবে আমাদের প্রাচীন সমাজ দুটি উত্তরণ পর্বের মধ্যে দিয়ে গেছে — প্রথমটি হল আদিম সাম্যবাদী ব্যবস্থা থেকে দাসব্যবস্থার যুগে এবং দ্বিতীয়টি হল দাসব্যবস্থা থেকে সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার যুগে। এই দুটি উত্তরণ পর্বে নতুন নতুন উৎপাদিকা শক্তি ও বিজ্ঞানের উন্নতি কয়েকটি দার্শনিক চিন্তাধারার জন্ম দিয়েছিল। এগুলির মধ্যে আমরা এমন কিছু মৌলিক প্রশ্নের ওপর বিতর্ক দেখতে পাই যেগুলি গ্রীক দর্শনেও দেখা গিয়েছিল। তবুও ভারতীয় সমাজব্যবস্থার রূপান্তরের নির্দিষ্ট ধারা তাতে কিছু বৈশিষ্ট্যও যোগ করেছিল।

নতুন উৎপাদিকা শক্তিগুলি অচলাবস্থায় উপনীত হওয়ার পরেও দর্শনের বিভিন্ন ধারাগুলির মধ্যে সংগ্রাম চলতেই থাকল। কিন্তু যে বস্তুগত ভিত্তি পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করতে পারত তার অভাবে এই সংগ্রাম বাস্তব জগত থেকে ক্রমশই দূরে সরে গেল। আর শেষপর্যন্ত “ব্রহ্ম সত্য জগত মিথ্যা” — বলে দুনিয়াটাকেই অস্বীকার করে বসল। এর পরে অনেক আঁকা-বাঁকা পথ, এক কৌতুহলোদ্দীপক পথ পেরিয়ে এসে দর্শন তার আপন গতিকেই রুদ্ধ করে দিল। ১০০০ খ্রিঃ পূঃ থেকে ১০০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ভারতীয় দর্শনের গতি এই প্রশ্নগুলি থেকেই এসেছে : “তখন সদ বা অসদ কিংবা আকাশ বা তার থেকে দূরবর্তী মহাকাশ (ব্যোম)– কিছুই ছিল না। তাহলে কে তাদের ঘিরে রেখেছিল? এবং কোথায়? কে তাদের রক্ষাকর্তা ছিল? তা কি ছিল অগাধ জলরাশি?” (ঋকবেদ, নাসদিয়া সুক্ত ১০/১২৯) – এই থেকে শুরু করে শঙ্করাচার্যের “ব্রহ্ম সত্য জগত মিথ্যা” এই উক্তি পর্যন্ত (শঙ্করাচার্য, ৭৮৫-৮২০ খ্রিস্টাব্দ) বস্তু ও চেতনার মধ্যে কোনটি আদি এবং এদের মধ্যেকার পারস্পরিক সম্পর্ক কী — এই প্রশ্নে সেই সময়ে ভারতীয় দার্শনিকদের বিতর্কের মধ্যেই সমস্ত অাধুনিক দার্শনিক ধারার বীজগুলি স্পষ্ট দেখা যায়।

পরে পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীতে ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনের যুগে এই দার্শনিক প্রশ্নগুলি অাবার মাথাচাড়া দিয়েছিল, কিন্তু নতুন উৎপাদিকা শক্তিগুলি যে বস্তুগত ভিত্তি সৃষ্টি করে তার অভাবের দরুণ দর্শনের আধুনিক যুগে প্রবেশের দরজা ছিল বন্ধ। আরবীয়দের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য (বিশেষ করে আরবীয় জ্ঞান, বিজ্ঞান ও ইসলাম), কৃষক বিদ্রোহগুলি এবং কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রশক্তির অভাব ভারতবাসীর মনকে প্রভূত পরিমাণে প্রভাবিত করেছিল, এর ফলে বিভিন্ন নতুন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ও চর্চার উদ্ভব ঘটে। ব্রিটিশ শাসনের সময় পশ্চিমী দর্শনের প্রভাব, সারা দেশে জাতীয় চেতনার জাগরণ, আধুনিক শিল্পের পত্তন ও সর্বহারা শ্রেণীর উদ্ভব, দেশব্যাপী প্রচণ্ড বৈপ্লবিক অভ্যুত্থান এবং মহান অক্টোবর বিপ্লবের ফলে ভারতের বুকে মার্কসবাদ লেনিনবাদের প্রবেশ ভারতীয় দর্শনে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করল।

সমগ্র ভারতীয় দর্শনকে মোটামুটি দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। (১) বৈদিক, (২) অবৈদিক। আবার বৈদিক দর্শনের (যে শাখাগুলি বেদকে ভিত্তি করে আছে) মধ্যে ছয়টি ধারা আছে, (ক) মীমাংসা (আদি), (খ) বেদান্ত (উপনিষদ বা উত্তর মীমাংসা), (গ) ন্যায়, (ঘ) বৈশেষিক, (ঙ) যোগ এবং (চ) সাংখ্য। অবৈদিক দর্শনকেও মোটামুটি তিনভাগে ভাগ করা যায়, (ক) লোকায়ত বা চার্বাকীয় বস্তুবাদের ধারা, (খ) জৈনীয় নিরীশ্বরবাদ (বহুত্ববাদ) এবং (গ) বৌদ্ধ দর্শন ভৌত – অনাত্মাবাদী অনিত্যবাদী অভৌতিকবাদ। বৈদিক দর্শনের এই ছয় এবং অবৈদিক দর্শনের এই তিন ধারার মধ্যে আমরা দ্বন্দ্বতত্ত্ব বস্তুবাদের বীজ বিক্ষিপ্ত অবস্থায় দেখতে পাই।

ভারতীয় দর্শন অধ্যয়নে একটি বিরাট বাধা হল লিখিত ইতিহাসের অভাব ও লিখিত উপাদানের অভাব। বৈদিক, লোকায়ত বা বৌদ্ধ যাই হেকা না কেন, সমস্ত দর্শনেই সামগ্রিক বিষয়বস্তুগুলি মুখস্ত করা হত ও এইভাবে বংশ পরম্পরায় বহন করা হত এবং এগুলি লিখিত হতে শুরু করে বহু পরে। উপরন্তু বিভিন্ন সম্প্রদায় বিভিন্নভাবে এগুলি লেখার ফলে বহু বিভ্রান্তির সুযোগও থেকে গেছে। স্পষ্টতই আদি ভাষ্যগুলি আলাদা করা এবং ঐতিহাসিক পর্ব ধরে সেগুলি সাজানো একটি জটিল ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবশ্য আধুনিককালে দর্শনের পণ্ডিতেরা এই বিষয়ের উপর কিছু মূল্যবান কাজ করেছেন। তথাপি ভারতীয় দর্শনের বৈজ্ঞানিক মূল্যায়ন আজও অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে।

একাডেমিক শিক্ষা বিষয়ক লিখিত প্রশ্ন সমাধান পেতে ক্লিক করুন।

আর্টিকেলের শেষ কথাঃ প্রাচীন গ্রিক দর্শনের উৎপত্তি ব্যাখ্যা করুন,ভারতীয় দর্শনের উৎপত্তির কারণ কী?

Leave a Comment