চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের গুণাগুণ,চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুফল ব্যাখ্যা কর

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের গুণাগুণ,চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুফল ব্যাখ্যা কর


জন শোরের মতানৈক্যের জন্য কর্নওয়ালিসের পরিকল্পনা কার্যকরী করা সম্ভব হল না। এছাড়া ঐ সময় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করার ক্ষেত্রে দুটি সমস্যাও ছিল।

যথা ঃ ১. নির্ভরযোগ্য তথ্যের অভাব, ২. চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের যৌক্তিকতা সম্পর্কে সরকারি বিশেষজ্ঞ মহলে ঘোরতর মতানৈক্য। এ ধরনের পারিপার্শিক অবস্থায় বোর্ড অব রেভিনিউ এর প্রেসিডেন্ট জন শোর চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পরিবর্তে আপাতত এক বা দুদশকের জন্য একটি পরীক্ষামূলক বন্দোবস্ত করার পক্ষে জোরালো যুক্তি প্রদর্শন করেন। তাই ১৭৯০ সালে দশসালা বন্দোবস্ত করা হয়। এ শর্তে বলা হয় যে, কোর্ট অব ডাইরেক্টরস তৎক্ষণাৎ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করার পক্ষে মতামত প্রকাশ করলে দশসালা বন্দোবস্তকেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বলে ঘোষণা করা হবে।

তাই ১৯৯২ সালের শেষের দিকে কোর্ট অব ডাইরেক্টরস চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করার পক্ষে মতামত দিলে কর্নওয়ালিস ১৭৯৩ সালে ২২ মার্চ দশসালা বন্দোবস্তকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বলে ঘোষণা করেন। ফলে রাজস্ব সমস্যা নিয়ে যে দুদশকের আলোচনা পর্যালোচনা তার অবসান হয়। তবে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কর্নওয়ালিসের শাসনামলে প্রবর্তিত হলেও এককভাবে তাঁর কৃতিত্ব ছিল বলা যায় না। এ ক্ষেত্রে দুদশক ধরে সাধারণ জেলা প্রশাসক, আইনজীবী, অর্থনীতিবিদ, ঐতিহাসিক, পার্লামেন্ট ও কোর্ট অব ডাইরেক্টরস সভার অবদান ছিল।

কর্নওয়ালিস এসবের মধ্যে সমন্বয় করেন মাত্র।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের গুণাগুণ : চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের গুণাগুণ সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হল :

১. রাজস্ব আয় ও বাজেট সম্পর্কে ধারণা : চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সম্ভাব্য দোষ গুণ সম্পর্কে কর্নওয়ালিস বা ডাইরে সভা যে অবহিত ছিলেন না এমন নয়। কোম্পানির ডাইরেক্টরস সভার সাথে কর্নওয়ালিসের পত্রালাপ এবং শোর-কর্নওয়ালিস বিতর্ক হতে একথা প্রমাণিত হবে। কিন্তু কোম্পানির রাজস্ব আয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া এবং বাৎসরিক বাজেট প্রস্তুতের সুবিধার জন্যই প্রধানত চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তিত হয়েছিল এবং এটাই ছিল এ বন্দোবস্তের প্রধান গুণ।

২. প্রজা সাধারণের সার্বিক উন্নতি : জমিদারগণ জমির মালিক হওয়ার ফলে প্রজা সাধারণের উপকার হয়। জমিদারগণ বাংলাদেশের অনেক স্থানে প্রজাবর্গের উপকারার্থে পুষ্করিণী খনন, বিদ্যালয়, চিকিৎসালয় প্রভৃতি স্থাপনের জন্য অকাতরে অর্থ ব্যয় করেন। দুর্ভিক্ষ ও মহামারীর সময় জমিদারগণ প্রজাবর্গকে বাঁচানোর চেষ্টা করেন। যা ইতিহাসে বিরল।

৩. ক্ষুদ্র শিল্পের উন্নতি : এ বন্দোবস্ত প্রবর্তন করার ফলে গ্রামাঞ্চলের ক্ষুদ্র শিল্পগুলোর সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় উন্নতি লাভ করেছিল । তাই এদিক থেকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রয়োজনীয় ছিল।

৪. নতুন জমিদার শ্রেণীর উদ্ভব : চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে নতুন এক জমিদার শ্রেণীর উদ্ভব হয়। এ জমিদার শ্রেণী কোম্পানি শাসনে স্বার্থ হাসিল করার জন্য সমর্থন জানায় । ফলে কোম্পানি শাসন টিকিয়ে রাখতে তারা অবদান রাখেন।

৫. কোম্পানির কর্মচারীদের দক্ষতা বৃদ্ধি : চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কোম্পানির কর্মচারীদের উপর রাজস্ব আদায়ের সাথে সাথে অন্যান্য দায়িত্ব অর্পণ করেছিল।

ফলে কর্মচারীদের দক্ষতা বৃদ্ধি পায় ৷ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের দোষাবলি/অপগুণ : চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের দোষাবলি/অপগুণ সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হল :

১. খাজনা অনাদায়ে জমিদারি নিলাম : এ ব্যবস্থায় সান্ধ্য আইন প্রবর্তিত হওয়ার ফলে অনেক অনাদায়ি রাজস্বের অজুহাতে জমিদার জমিদারি হারান। ফলে দেখা যায়, ২২ বছরে প্রায় অর্ধেক জমিদারি ধ্বংস হয়। যে সকল জমিদার সামন্ত প্রজার অনুকরণে নির্দিষ্ট পরিমাণ খাজনা দেওয়ার শর্তে তালুকদার, ইজারাদার প্রভৃতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জমিদারদের কাছ থেকে বন্দোবস্ত দিতে পেরেছিলেন কেবলমাত্র তারাই জমিদারি টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন।

২. রায়তদের ওপর অত্যাচার : লর্ড কর্নওয়ালিস আশা করেছিলেন যে, জমিদারগণ যেমন নির্দিষ্ট পরিমাণ রাজস্ব দেওয়ার শর্তে জমি ভোগ দখলের স্থায়ী অধিকার কোম্পানির কাছ থেকে লাভ করেছিলেন, ঠিক অনুরূপ শর্তে তারা নিজ নিজ রায়তদের জমি বন্দোবস্ত দেবেন। কিন্তু তার এ আশা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছিল। অতি সামান্য কারণে এমনকি বিনা কারণেও জমিদারগণ রায়তদের জমি হতে উচ্ছেদ করতে দ্বিধাবোধ করতেন না ।

৩. রাজস্ব নির্ধারণের ত্রুটি : এ ব্যবস্থার অধীনে কি পরিমাণ জমি নিষ্কর ছিল, কি পরিমাণ জমিতে পশুচারণ ছিল তা খোঁজখবর না দিয়ে রাজস্ব নির্ধারণ করার ফলে রাজস্বের মাত্রা বেশি হয়েছিল। এতে জমিদারদের কাছ থেকে যে ধারণা পাওয়া যায় তাই ছিল একমাত্র ভিত্তি। ফলে রাজস্বকে কেন্দ্র করে অসংখ্য মামলা মোকদ্দমা দেখা দেয় ।

৪. জমির উপর চাপ বৃদ্ধি : এ ব্যবস্থার প্রবর্তনের ফলে জমির মালিকানা চিরস্থায়ী হওয়ার ফলে সকলেই যে কোন উপায়ে জমি ক্রয় করার বা অধিকার করার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠলে জমির উপর ক্রমেই চাপ বৃদ্ধি পেতে থাকে। এছাড়া জমি সংক্রান্ত অসংখ্য মামলা মোকদ্দমা বিচারালয়গুলোতে আসতে থাকে।

৫. রায়তদের দুর্দশা : অতি উচ্চহারে রাজস্ব নির্ধারিত হওয়ায় জমিদারগণ রায়তদের কাছ থেকে উচ্চহারে পা আদায় করতে বাধ্য হন। ফলে রায়তদের আর্থিক দুর্দশা বেড়ে যায়।

৬. সরকারের আর্থিক ক্ষতি : ১৭৯৩ সালে জমির যে মূল্য ছিল এ ব্যবস্থা প্রবর্তিত হওয়ার পর তা দ্বিগুণ বেড়ে যায়। কিন্তু এতে সরকারের রাজস্ব বাড়ার কোন উপায় ছিল না। ফলে সরকার বর্ধিত মৃগাজনিত লাভের অংশ হতে বঞ্চিত হন।

৭. জমির উন্নয়ন ব্যাহত: চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বাংলার অর্থনৈতিক উন্নতি ব্যাহত হয়েছিল। কারণ, জমিদারগণ স্থায়ী জমির মালিক হওয়ায় আর জমির উন্নয়নে কোন ব্যবস্থা করেন নি। অন্যদিকে রায়তদের জমিতে তাদের ফোন অধিকার না থাকায় তারা স্বভাবতই জমি উন্নয়নে মন দেন নি।

৮. নায়েব-গোমস্তাদের অত্যাচার : জমিদারগণ খাজনা আদায় করার জন্য যে সকল করতেন তারা জনসাধারণকে নানা অত্যাচার করতে থাকেন। ফলে জনসাধারণের দুর্ভোগ আরো বেড়ে যায়। गान গোমস্তাগণ নিজ স্বার্থসিদ্ধির জন্য রায়তগণকে উৎপীড়ন করতে থাকেন। অনেকের মতে, এ ব্যবস্থার ফলে এক সামন্ত প্রথার সৃষ্টি করা হয়েছিল।

৯. গ্রামাঞ্চলের অবনতি : এ ব্যবস্থার ফলে গ্রামের কৃষকদের শ্রমে উৎপন্ন আয় হতে খাজনা আদায় করে এনে তা শহর এলাকায় ব্যয় করার ফলে গ্রামের আর্থিক সমৃদ্ধি দিন দিন হ্রাস পেতে থাকে।

উপসংহার ঃ অতএব বলা যায়, কর্নওয়ালিস ১৭৯৩ সালে কোম্পানির রাজস্ব সমস্যার সমাধান এর জন্য যে বন্দোবস্ত প্রবর্তন করেন তা ছিল কোম্পানির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ভারতীয় জনসাধারণের স্বার্থের দিকে गा করার এটা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে বাধ্য হয়। কারণ, এতে কেবল সুবিধা হয় জমিদারদের, লাভ হয় কোম্পানির, অন্যদিকে বাংলার যে অবহেলিত কৃষককুল তাদের কোন উন্নতি হয় নি। তাই এ ব্যবস্থায় কর্নওয়ালিসের ভালো উদ্যোগ থাকলেও প্রায়োগিক দিক থেকে ছিল অনেকটা ত্রুটিপূর্ণ। তাতে সার্বিক দিক বিবেচনায় কর্নওয়ালিস রাজস্ব সমস্যা সম্পর্কে দুদশকের যে সমস্যা তার অবসান করেন। এজন্য তাঁর এটা ভালো উদ্যোগ ছিল।

Leave a Comment