একচেটিয়া বাজার কি?, একচেটিয়া বাজারের বৈশিষ্ট্য, মনোপলি বাজার কি?,মনোপলি বাজারের বৈশিষ্ট্য,একচেটিয়া বাজার
একচেটিয়া বাজার (Monopoly)
একক বিক্রেতার বাজারকে একচেটিয়া বাজার বলা হয়। এখানে একজন বিক্রেতা পণ্য উৎপাদন, মূল্য় নির্ধারণ ও বিক্রয় কাজ সম্পাদন করে থাকে। এ বাজারে কোনো নিকট প্রতিদ্ধন্ধী থাকে না। একচেটিয়া ফার্ম সর্বদা মুনাফা সর্বোচ্চ করার চেষ্টা করে। তবে একচেটিয়া কারবারির পক্ষেও সবসময় অস্বাভাবিক মুনাফা অর্জন করা সম্ভব হয় না।
একচেটিয়া বাজারের ইংরেজি প্রতিশব্দ Monopoly। Mono শব্দের অর্থ একক আর Poly শব্দের অর্থ বিক্রেতা। অর্থাৎ একচেটিয়া বাজার হলো একক বিক্রেতার বাজার। একচেটিয়া বাজার এমন এক বাজার যেখানে একজন মাত্র বিক্রেতা দ্রব্যের বাজার নিয়ন্ত্রন করে। অর্থাৎ যে বাজারে একজন মাত্র বিক্রেতা পন্য় উৎপাদন করে, দাম নির্ধারণ করে এবং বিক্রয় নিয়ন্ত্রন করে। এ বাজারে দ্রব্যের কোনো নিকট পরিবর্তক দ্রব্য থাকে না এবং অন্যান্য় বিক্রেতার বাজারে প্রবেশে বাধা থাকে।
একচেটিয়া বাজারের শর্ত বা বৈশিষ্ট্য (Conditions or Characteristics of Monopoly Market)
একচেটিয়া বাজারের ৩টি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত রয়েছে। নিচে এগুলো আলোচনা করা হলো:
১. একচেটিয়া বাজারে উৎপাদনকারী একজন বা একটি প্রতিষ্ঠান। তবে, এই একক উৎপাদক হতে পারে ব্যক্তিগত মালিকানা, আবার হতে পারে অংশীদারী কারবার বা যৌথ মূলধনী কারবার বা কর্পোরেশন।
২. এ বাজারে উৎপন্ন দ্রব্যের কোনো নিকট বিকল্প দ্রব্য অর্থাৎ দ্রব্যের কোনো প্রতিযোগি দ্রব্য থাকবে না।
৩. এ বাজারে একটি ফার্ম দ্রব্য উৎপাদন করে এবং অপরআপর ফার্মকে শিল্পে প্রবেশে বাধা দেয়া হয়। এক্ষেত্রে বিভিন্ন অর্থনৈতিক ও আইনগত বাধা দেয়া থাকে।
একচেটিয়া বাজার উদ্ভবের কারণ
একচেটিয়া কারবারের উদ্ভবের অনেকগুলো কারণ রয়েছে, যা নিচে আলোচনা করা হলো:
১. কম চাহিদার দ্রব্য: এমন এমন দ্রব্য থাকতে পারে যেগুলোর বাজার চাহিদা খুব কম। একটি মাত্র ফার্মের দ্বারাই এই চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হতে পারে। ফলে নতুন বিক্রেতা বাজারে প্রবেশ করতে চায় না। তখন সেইসব দ্রব্যের বাজারে একচেটিয়া আচরন দেখা দিতে পারে।
২. দ্রব্য ও মুনাফা সম্পর্কে প্রতিদ্ধন্ধী ফার্মের অজ্ঞতা: একটি বৃহৎ ফার্ম যখন কোনো দ্রব্য উৎপাদন করে তখন তার উৎপাদন কৌশল ও মুনাফা সম্পর্কে অন্যান্য ফার্ম জ্ঞাত থাকে না। নতুন ফার্ম অবগত না থাকায় বৃহৎ ফার্মটি একচেটিয়া বাজার সুবিধা ভোগ করতে পারে।
৩. স্বাভাবিক একচেটিয়া বাজার: কিছু কিছু দ্রব্য ও সেবা রয়েছে যেগুলোর অনুমোদিত একটি ফার্ম থাকা যুক্তিযুক্ত হয়। যেমন টেলিফোন সংযোগের ক্ষেওেত্র একটি ফার্ম থাকাই যুক্তিযুক্ত। একের অধিক ফার্ম থাকলে বিশৃঙ্খলা ঘটতে পারে। এজাতীয় একচেটিয়া কারবারকে স্বাভাবিক একচেটিয়া কারবার হিসাবে গণ্য করা হয়।
৪. ব্যয় সংক্রান্ত সুবিধা: উৎপাদন ব্যয়ের ক্ষেত্রে কোনো ফার্মের অভ্যন্তরীন ও বহিঃস্থ সুবিধা থাকতে পারে। উৎপাদন ব্যয়ের ক্ষেত্রে ক্রমহ্রাসমান উৎপাদন বিধি কার্যকর থাকলে ঐ ফার্ম যত খুশী উৎপাদন করতে পারে। তখন অন্য কোনো ফার্ম তার সাথে প্রতিযোগিতা করতে বাজারে প্রবেশ করতে পারে না। ফলে উক্ত ফার্ম একচেটিয়া ফার্মে পরিণত হয়।
৫. সরকারি উদ্যোগ: যেসকল সেবা খাতের মাধ্যমে জনগণ শোষিত হতে পারে সেগুলো সাধারণত সরকার নিজেই পরিচালনা করে । আবার সরকার নিজেও কোনো বিশেষ পণ্য উৎপাদন করে তা বিক্রয় করতে পারে। এভাবে সরকারিভাবে একচেটিয়া কারবার দেখা দেয়।
৬. উপকরণের গতিশীলতার অভাব: অনেক সময় উপকরণ স্থানান্তরযোগ্য না হওয়ায় তা এক শিল্প হতে অন্য শিল্পে যেতে পারে না। ফলে একচেটিয়া বাজারের উদ্ভব হয়।
একচেটিয়া কারবারের সুবিধা ও অসুবিধা
একচেটিয়া বাজারে সুবিধা যেমন রয়েছে তেমনি অসুবিধাও রয়েছে ।
একচেটিয়া কারবারের সুবিধা (Advantages of Monopoly Market)
১. মাত্রাগত সুবিধা: প্রচুর মূলধন বিনিয়োগের প্রয়োজন হয় এমন শিল্পে একচেটিয়া ফার্ম থাকলে তা জনগনের জন্য কল্যাণকর হয়। যেমন – মটর গাড়ী, রাসায়নিক শিল্প ইত্যাদি। এসব শিল্পে একচেটিয়া ব্যবসা পরিচালিত হলে তাতে মাত্রাগত সুবিধা দেখা দেয়। অর্থনৈতিক মিতব্যয়িতার কারণে জনগণ কম দামে এসব শিল্প দ্রব্য ক্রয়ের সুযোগ পায়।
২. উন্নয়নমূলক সুবিধা: একচেটিয়া কারবারি গবেষণা ও উন্নয়ন কাজে প্রচুর অর্থ সরবরাহ করতে পারে। গবেষণার ফলে প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি পেলে উৎপাদন ব্যয় হ্রাস পায় এবং কম দামে দ্রব্য বিক্রয় করা সম্ভব হয়।
৩. ভোগ বৃদ্ধি করা: একচেটিয়া কারবারি অস্বাভাবিক মুনাফা অর্জন করলেও ভবিষ্যতে বিভিন্ন নতুন দ্রব্য উদ্ভাবন করে জনগনের জন্য প্রস্তুত করতে পারে। তাতে সমাজের উপকার হয়।
একচেটিয়া কারবারের অসুবিধা (Disadvantages of Monopoly Market)
১. আয় বৈষম্য সৃষ্টি: একচেটিয়া কারবারি থাকলে সমাজের অল্প সংখ্যক লোকের হাতে বেশির ভাগ অর্থ জমা হয়। ফলে সমাজে আয় বৈষম্য দেখা দেয়।
২. অদক্ষতা: একচেটিয়া কারবারি প্রান্তিক ব্যয়ের চেয়ে বেশি দামে উৎপাদন পরিচালনা করে, তাতে সম্পদ ব্যবহারে অদক্ষতা পরিলক্ষিত হয়। ফলে ভোক্তাপ্রান্তে দ্রব্যের মূল্য বেশি দিতে বাধ্য হয়।
৩. অতিরিক্ত মূল্য আদায়: অনেক সময় একচেটিয়া কারবারি অতি মুনাফার লোভে জনস্বার্থ বিরোধী পণ্য উৎপাদন করতে পারে। একই কারণে ন্যায্য মূল্যের চেয়ে বেশি মূল্য আদায় করতে পারে। আবার অনেক সময় দ্রব্যের মূল্য অস্বাভাবিক থাকায় সমাজের কিছু মানুষ বিশেষ করে দরিদ্র শ্রেনির মানুষ উক্ত দ্রব্যের ভোগ থেকে বঞ্চিত হতে পারে। কারণ তারা বেশি দামে দ্রব্য ক্রয় করতে পারে না।
৪. দ্রব্যের গুনগত মান হ্রাস: একচেটিয়া কারবারি কোনো প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হয় না বলে সে অনেক সময় পণ্যের গুনগত মান রক্ষা না করেই পণ্য বাজারজাত করতে পারে তাতে সমাজ গুনগতমান সম্পন্ন দ্রব্য হতে বঞ্চিত হয়।
একচেটিয়া ফার্মের স্বল্পকালীন ভারসাম্য (Short run equilibrium of Monopoly Firm)
একচেটিয়া বাজারে ফার্মই শিল্প। অর্থাৎ এ বাজারে একক ফার্মের কর্তৃত্ব উপলব্ধ হয়। পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজারে যেমন ফার্মের স্বল্পকালীন ভারসাম্য রয়েছে একচেটিয়া বাজারেও তেমনি ফার্মের স্বল্পকালীন ভারসাম্য রয়েছে।
স্বল্পকাল বলতে সেই সময়কে বুঝায় যে সময়ে ফার্ম কেবল পরিবর্তনশীল ব্যয় পরিবর্তন করতে পারে, স্থির ব্যয় নয়। একচেটিয়া বাজারে যদিও একটি ফার্ম এককভাবে সমগ্র বাজারের নিয়ন্ত্রক তবু সব সময় ফার্মের মুনাফা হবে এমন নয়। একচেটিয়া ফার্মেরও লোকশান হতে পারে। নিম্নে একচেটিয়া ফার্মের স্বল্পকালীন ভারসাম্য বিশ্লেষণ করা হলো:
স্বল্পকালে একচেটিয়া ফার্ম তিনটি অবস্থার সম্মুখীন হতে পারে। যথা: ১. অস্বাভাবিক মুনাফা ২. ক্ষতি ৩. স্বাভাবিক মুনাফা।
ভারসাম্যের শর্ত: পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজারের মতো একচেটিয়া বাজারেও ফার্মের ভারসাম্যের প্রয়োজনীয় ও পর্যাপ্ত শর্ত রয়েছে।
প্রয়োজনীয় শর্ত: প্রান্তিক আয় প্রান্তিক ব্যয়ের সমান হতে হবে। অর্থাৎ MR = MC হতে হবে।
পর্যাপ্ত শর্ত: প্রান্তিক ব্যয় রেখা প্রান্তিক আয় রেখাকে নিচ থেকে ছেদ করে উপরে উঠবে। অর্থাৎ ভারসাম্য বিন্দুতে MC রেখার ঢাল MR রেখার ঢালের চেয়ে বেশি হবে।
ভারসাম্য বিশ্লেষণ: একচেটিয়া ফার্মের ভারসাম্য ব্যাখ্যার জন্য আমাদের একচেটিয়া বিক্রেতার মোট আয় এবং মোট ব্যয় সম্পর্কে ধারণা থাকা দরকার।
বিক্রেতার গড় আয় বা দামকে দ্রব্যের মোট পরিমাণ দ্বারা গুণ করলে মোট আয় পাওয়া যায়। আবার দ্রব্য উৎপাদনে গড় ব্যয়কে দ্রব্যের মোট পরিমাণ দ্বারা গুণ করলে বিক্রেতার মোট ব্যয় পাওয়া যায়। অতপর, মোট আয় থেকে মোট ব্যয় বাদ দিলে ফার্মের মুনাফা পাওয়া যায়। উল্লেখ্য, মোট আয় কেবল মোট ব্যয়ের চেয়ে বেশি হলেই মুনাফা অর্জিত হয়। যদি মোট আয় মোট ব্যয়ের চেয়ে কম হয় তবে ক্ষতি বা লোকশান হয়। আর মোট আয় মোট ব্যয়ের সমান হলে স্বাভাবিক মুনাফা অর্জিত হয়। বিষয়টি নিচের চিত্রের সাহায্যে বিশ্লেষণ করা হলো:
(ক) অস্বাভাবিক মুনাফা (Supernormal Profit) – একচেটিয়া বাজারে ভারসাম্য অবস্থায় পণ্যের মূল্য যদি গড় ব্যয় অপেক্ষা বেশী হয়; অর্থাৎ P>AC হয়, তবে একচেটিয়া কারবারী অস্বাভাবিক মুনাফা অর্জন করবে।
চিত্র-১ অনুযায়ী MC ও AC দ্বারা প্রান্তিক ব্যয় ও গড় ব্যয় রেখা দেখানো হয়েছে এবং MR ও AR দিয়ে প্রান্তিক আয় ও গড় আয় রেখা দেখানো হয়েছে। চিত্রানুযায়ী, MC রেখা MR রেখাকে E বিন্দুতে নিচের দিক হতে ছেদ করেছে। ফলে E বিন্দুতে MC = MR হয় এবং MC রেখার ঢাল> MR রেখার ঢাল হয়। সুতরাং E বিন্দুতে একচেটিয়া কারবারী ভারসাম্যে পৌঁছবে। ভারসাম্য উৎপাদন Q1 হবে।
এখানে,
AC = CQ1
∴ TC = OP1CQ1
আবার,
AR = BQ1
∴ TR= OP0BQ1
অতএব, একচেটিয়া কারবারীর মুনাফা TR-TC = OP0B Q1 – O P1CQ1 = P0P1CB
সুতরাং P1P0CB হবে মনোপলির অস্বাভাবিক মুনাফা।
(খ) স্বাভাবিক মুনাফা (Normal Profit) ভারসাম্য উৎপাদনস্তরে পণ্যের মূল্য ও গড় ব্যয় পরস্পর সমান হলে, অর্থাৎ P= AC হলে একচেটিয়া কারবারী স্বাভাবিক মুনাফা অর্জন করবে। কারণ, স্বভাবিক মুনাফা হলো উৎপাদকের নিজস্ব শ্রমের পারিশ্রমিক।
চিত্র- ২ অনুযায়ী, একচেটিয়া কারবারী E বিন্দুতে ভারসাম্যে পৌছায়। কারণ এ বিন্দুতে MR = MC এবং MC রেখার ঢাল > MR রেখার ঢাল। এখানে ভারসাম্য উৎপাদন Q1 হবে । এই Q1 উৎপাদন স্তরে,
AR = AC = AQ1,
QTR = TC = OP1AQ1
মোট ব্যয় এবং মোট আয় পরস্পর সমান হলে একচেটিয়া কারবারী স্বাভাবিক মুনাফা অর্জন করবে। আর স্বাভাবিক মুনাফার পরিমাণ হচ্ছে OP1AQ1 ।
(গ) লোকসান বা ক্ষতি (Loss): স্বল্পকালে একচেটিয়া কারবারির মোট আয় মোট ব্যয়ের চেয়ে কম হলে ক্ষতি বা লোকশান হয়। বিষয়টি নিচের চিত্রের সাহায্যে ব্যাখ্যা করা হলো:
উপরের চিত্রে E বিন্দুতে একচেটিয়া কারবারির ভারসাম্য অর্জিত হয়েছে। এখানে মোট আয় OQ1tp1 এবং মোট ব্যয় OQ1kp2 । যেহেতু মোট ব্যয় বেশি মোট আয় কম তাই এখানে ক্ষতি হবে। আর ক্ষতির পরিমাণ হবে p1tkp2 । এভাবে স্বল্পকালে একচেটিয়া কারবারির ক্ষতি বা লোকশানের বিষয়টি ব্যাখ্যা করা যায়।
লোকসান অবস্থায় উৎপাদন (Production under Loss): একচেটিয়া কারবারির ভারসাম্য অবস্থায় পণ্যের মূল্য গড় পরিবর্তনীয় ব্যয়ের থেকে বেশী হলে অর্থাৎ P > AVC হলে একচেটিয়া কারবারি লোকসান অবস্থাতেও উৎপাদন চালিয়ে যাবে।
Video Player
00:00
00:05
চিত্র – ৪: একচেটিয়া কারবারির লোকসান অবস্থায় উৎপাদন
উপরের চিত্রানুযায়ী, E বিন্দুতে একচেটিয়া কারবারি ভারসাম্যে পৌছবে।
এখানে Q1 ভারসাম্য উৎপাদন স্তরে লোকসানের পরিমাণ হবে P1P0AB।
কিন্তু, এখানে লক্ষ্যনীয় যে,
P= AR= BQ1
∴ TR= OP1BQ1
এবং AVC = CQ1
∴ TVC = OP3CQ1
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, P>AVC এবং TR>TVC অতএব, একচেটিয়া কারবারী স্বল্পকালে লোকসান অবস্থাতেও উৎপাদন চালাবে।
আরো ও সাজেশন:-
পূর্ণ প্রতিযোগিতা ও একচেটিয়া বাজারের তুলনা Difference between Full Competition and Monopoly Market
পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজারে অসংখ্য ক্রেতা ও অসংখ্য বিক্রেতা একটি সমজাতীয় পণ্য নির্দিষ্ট দামে ক্রয়-বিক্রয় করে। আর একচেটিয়া বাজারে একজনমাত্র বিক্রেতা পণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রন করে। পূর্ণ প্রতিযোগিতা ও একচেটিয়া বাজারের মধ্যে অনেকগুলো মৌলিক পার্থক্য এবং কিছু মিলও রয়েছে। নিচে এই দুটো বাজারের মধ্যেকার পার্থক্যগুলো উল্লেখ করা হল
(ক) ক্রেতা ও বিক্রেতার সংখ্যা: পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজারে অসংখ্য ক্রেতা ও বিক্রেতা থাকে। কিন্তু, একচেটিয়া বাজারে একজন বিক্রেতা এবং অসংখ্য ক্রেতা থাকে।
(খ) দ্রব্যের প্রকৃতি: পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজারে সমজাতীয় পণ্য বিদ্যমান। কিন্তু, একচেটিয়া বাজারে পণ্য সমজাতীয় থাকে না। এখানে বিক্রীত পণ্যের ঘনিষ্ঠ পরিবর্তক দ্রব্য়ের অভাব থাকে।
(গ) প্রান্তিক আয় ও গড় আয়: পূর্ণ প্রতিযোগিতা বাজারে প্রান্তিক গড় আয় রেখা বা চাহিদা রেখা ভূমি অক্ষের সাথে সমান্তরাল থাকে। এখানে প্রান্তিক আয় ও গড় আয় পরস্পর সমান হয়। প্রান্তিক আয় রেখা গড় আয় রেখার সাথে মিশে ভূমি অক্ষের সাথে সমান্তরাল হয়। পক্ষান্তরে, একচেটিয়া বাজারে গড় আয় রেখা ও প্রান্তিক আয় রেখা দুটোই ডানদিকে নিম্নগামী হয় এবং প্রান্তিক আয় রেখা গড় আয় রেখার নিচে অবস্থান করে।
(ঘ) মূল্যের উপর প্রভাব: পূর্ণ প্রতিযোগী বাজারে বাজার চাহিদার তুলনায় কোন একজন ক্রেতার চাহিদা অতি নগণ্য। তাই তার পক্ষে এককভাবে বাজার চাহিদা ও মূল্যের উপর প্রভাব বিস্তার করা সম্ভব নয়। একইভাবে বাজারে প্রত্যেক বিক্রেতা পণ্যের মোট যোগানের একটি ক্ষুদ্র অংশ সরবরাহ করে বলে তাদের পক্ষে এককভাবে পণ্যের যোগান ও মূল্যের উপর প্রভাব ফেলা সম্ভব না।
কিন্তু, একচেটিয়া বাজারে বিক্রেতা মূল্য কমিয়ে পণ্য অধিক পরিমাণে এবং মূল্য বাড়িয়ে কম পরিমাণ বিক্রয় করতে পারে। এখানে বিক্রেতার পক্ষে মূল্যের উপর প্রভাব ফেলা খুবই সম্ভব।
(ঙ) স্বল্পকালীন মুনাফা: ভারসাম্যের দিক থেকে একচেটিয়া কারবারী স্বল্পকালে অসস্বাভাবিক মুনাফা, ক্ষতি, স্বাভাবিক মুনাফার সম্মুখীন হতে পারে। আবার পূর্ণ প্রতিযোগি ফার্মও স্বল্পকালে অসস্বাভাবিক মুনাফা, ক্ষতি, স্বাভাবিক মুনাফার সম্মুখীন হতে পারে। অর্থাৎ, পূর্ণ প্রতিযোগি ফার্ম ও একচেটিয়া ফার্ম এক্ষেত্রে একই রকম আচরন করতে পারে।
(চ) দীর্ঘকালীন মুনাফা: একচেটিয়া কারবারি দীর্ঘকাল অতিরিক্ত মুনাফা অর্জন করতে পারে। কিন্তু, পূর্ণ প্রতিযোগী ফার্মের পক্ষে দীর্ঘমেয়াদে শুধু স্বাভাবিক মুনাফা অর্জন করা সম্ভব।
(ছ) ফার্মের প্রবেশ ও প্রস্থান: একচেটিয়া বাজারে অন্য কোন ফার্মের পক্ষে প্রবেশ করা সম্ভব নয়। কিন্তু, পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজারে অস্বাভাবিক মুনাফার লোভে নতুন নতুন ফার্ম শিল্পে প্রবেশ করতে পারে এবং লোকসানের ভয়ে শিল্প হতে চলে যেতে পারে। অর্থাৎ পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজারে ফার্মের অবাধ প্রবেশ ও প্রস্থানের পূর্ণ অধিকার রয়েছে।
(জ) চাহিদার স্থিতিস্থাপকতা: পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজারে পণ্যের চাহিদা সম্পূর্ণ স্থিতিস্থাপক। অন্যদিকে একচেটিয়া কারবারে পণ্যের চাহিদা সম্পূর্ণ স্থিতিস্থাপক নয়। কারণ একচেটিয়া বাজারে দ্রব্যে দামের ভিন্নতা থাকে। এখানে একই পণ্যের বিভিন্ন দাম আবার বিভিন্ন পণ্যের একই দাম আদায় সম্ভব।
(ঝ) ব্যয় অবস্থা: একচেটিয়া কারবারী স্থির, ক্রমহ্রাসমান এবং ক্রমবর্ধমান ব্যয় অবস্থায় কাজ করতে পারে। অপরদিকে, পূর্ণ প্রতিযোগী ফার্মের ভারসাম্য শুধু ক্রমবর্ধমান ব্যয় অবস্থার সাথে সংগতিপূর্ণ হতে পারে।
[ বি:দ্র: উত্তর দাতা: রাকিব হোসেন সজল ©সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত (বাংলা নিউজ এক্সপ্রেস)]
সুতরাং দেখা যায়, পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজার এবং একচেটিয়া বাজারের মধ্যে কাঠামোগত, মূল্যগত, দ্রব্যগত, আওতাগত অনেক পার্থক্য রয়েছে। পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজারের তুলনায় একচেটিয়া বাজারে পণ্যের উৎপাদন কম দাম বেশি।
ধরা যাক, (১) পূর্ণ প্রতিযোগিতা ও একচেটিয়া বাজারে দ্রব্যের চাহিদা ও ব্যয়ের শর্ত একই, (২) কিছুসংখ্যক ফার্ম সমজাতীয় দ্রব্য উৎপাদন করে যেখানে ফার্ম গুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা থাকে এবং (৩) কোনো ফার্ম একক ভাবে পণ্যের দামের উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। এক্ষেত্রে চাহিদা ও যোগান রেখার ছেদ বিন্দুতে ভারসাম্য মূল্য ও পরিমাণ নির্ধারিত হয়। বিষয়টি চিত্রের সাহায্যে দেখানো হলো:
উপরের চিত্রে চাহিদা রেখা (গড় আয় রেখা) এবং যোগান রেখা (প্রান্তিক ব্যয় রেখা) পরস্পর f বিন্দুতে ছেদ করেছে, তাই এখানে পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজারের ভারসাম্য অর্জিত হয়েছে। চিত্রে ভারসাম্যের উভয় শর্ত মেনে একচেটিয়া বাজারের ভারসাম্য e বিন্দুতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আবার যেখানে একচেটিয়া বাজারে Oq1 পরিমাণ দ্রব্য OP1 দামে বিক্রয় হয় সেখানে পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজারে Oq2 পরিমাণ দ্রব্য OP0 দামে বিক্রয় হয়।
কাজেই বলা যায় একচেটিয়া বাজারে পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজারের তুলনায় দাম বেশি উৎপাদন কম হয়ে থাকে।
বৈষম্যমূলক একচেটিয়া বাজার Discriminative Monopoly Market
মূল্য বৈষম্য Price Discrimination
মূল্য বৈষম্য বলতে একই পণ্যের জন্য বিভিন্ন ক্রেতার কাছ থেকে বিভিন্ন মূল্য গ্রহন বুঝায়। অর্থাৎ, কোনো পণ্যের মূল্য গরিবদের নিকট থেকে কম আর ধনীদের নিকট থেকে বেশি নেয়া হলে তা মূল্য বৈষম্য হবে। একচেটিয়া কারবারি তার পণ্যের মূল্য বৈষম্য করতে পারে। যেমন, বাংলাদেশে ওয়াসা পানি সরবরাহ করে এবং পানির মূল্য নির্ধারণ করে। এক্ষেত্রে ওয়াসা একচেটিয়া কারবারি হিসাবে আবাসিক পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে এক রকম বিল আর কারখানায় পানি ব্য সরবরাহের বিল আলাদা হারে নিতে পারে। এভাবে মূল্য বৈষম্য হতে পারে।
মূল্য বৈষম্যের শর্তাবলী Conditions of Price Discrimination
একচেটিয়া কারবারি পণ্যের মূল্য বৈষম্য করতে পারে আবার নাও করতে পারে। তার পক্ষে সব সময় মূল্য বৈষম্য করা সম্ভব নাও হতে পারে, আর সম্ভব হলেও তা লাভজনক নাও হতে পারে। নিম্নেক্ত কারণে মূল্য বৈষম্য হতে পারে-
(ক) পূর্ণ প্রতিযোগিতা: পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজারে মূল্য বৈষম্য সম্ভব নয়। কারণ প্রতিযোগিতা থাকলে বাজারে পণ্যের মূল্য একই থাকবে। একচেটিয়া কারবারীর পক্ষে মূল্য বৈষম্য করা সম্ভব কারণ সেখানে প্রতিযোগিতা নেই।
(খ) দ্রব্যের প্রকৃতি: কোন ক্রেতা যদি কম মূল্যের বাজার থেকে একটি পণ্য কম মূল্যে কিনে বেশি মূল্যের বাজারে বিক্রয় করতে না পারে তবেই মূল্য বৈষম্য সম্ভব হবে। আবার একচেটিয়া কারবারি তার ইচ্ছামত মূল্য আদায় করতে পারে। যেমন একজন ডাক্তার একই সেবা দিয়ে গরীব রোগীদের কাছ থেকে কম ফি আর ধনী রোগীদের কাছ থেকে বেশী ফি গ্রহণ করতে পারেন। ডাক্তারের সেবা হস্তান্তরযোগ্য নয় বলে তার পক্ষে মূল্য বৈষম্য করা সম্ভব।
(গ) ক্রেতার ধরণ: যখন বিভিন্ন শ্রেণীর ক্রেতা একই পণ্য ক্রয় করে তখন মূল্য বৈষম্য হয়। যেমন- রেলওয়ে বিভাগ একই ট্রেনে ভ্রমণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন শ্রেণীর যাত্রীর জন্য ভিন্ন ভিন্ন হারে ভাড়া ধার্য করে।
(ঘ) ভৌগোলিক দূরত্ব: ভৌগোলিক দূরত্বের ব্যবধান বেশি হলে মূল্য বৈষম্য সম্ভব হতে পারে। ভৌগোলিক দূরত্ব বেশি হলে কম মূল্যের বাজার থেকে বেশি মূল্যের বাজারে পণ্যের স্থানান্তর সম্ভব হয় না। ফলে এরূপ পণ্যের ক্ষেত্রে মূল্য বৈষম্য করা সম্ভব।
(ঙ) দ্রব্য পৃথকীকরণ: দ্রব্য পৃথকীকরণের মাধ্যমে একজন বিক্রেতা মূল্য বৈষম্য সৃষ্টি করতে পারে। একই দ্রব্য বিভিন্ন নাম বা লেভেল লাগিয়ে কিছুটা পার্থক্য তৈরী করে ক্রেতাদের মধ্যে অতিরিক্ত পছন্দনীয়তা সৃষ্টি করা যেতে পারে। এর ফলে বিক্রেতা মূল্য বৈষম্য তৈরি করে।
(চ) কর বা শুল্ক: অনেক সময় বিক্রেতা আভ্যন্তরীণ বাজারে বেশী মূল্যে এবং বিদেশী বাজারে কম মূল্যে পণ্য বিক্রয় করে। একে ডাম্পিং (Dumping) বলা হয়। পণ্যের উপর সরকার কর্তৃক আমদানি বা রপ্তানি শুল্ক ধার্য করা হলে দেশী ও বিদেশী বাজারে মূল্যের তারতম্য হতে পারে। একচেটিয়া কারবারি ডাম্পিং-এর মাধ্যমে মূল্য বৈষম্য করে থাকে।
(ছ) পণ্যের চাহিদা: পণ্যের চাহিদার স্থিতিস্থাপকতার বিভিন্নতার কারণে বিক্রেতার পক্ষে কোনো নির্দিষ্ট পণ্যে মূল্য বৈষম্য করা সম্ভব। যেসব ক্রেতার কাছে পণ্যের চাহিদা বেশী স্থিতিস্থাপক তাদের কাছ থেকে বিক্রেতা বেশী মূল্য আদায় করতে পারে না। আবার যদি পণ্যের চাহিদার স্থিতিস্থাপকতা কম হয়, তাহলে বিক্রেতা ক্রেতার কাছ থেকে বেশী দাম আদায়ের চেষ্টা করে।
(জ) ক্রেতার অজ্ঞতা এবং অলসতা: ক্রেতাদের অজ্ঞতা এবং অলসতার সুযোগেও বিক্রেতা মূল্য বৈষম্য করতে পারে। দ্রব্যের দাম সম্পর্কে যদি ক্রেতার ধারণা না থাকে তাহলে মূল্য বৈষম্য হতে পারে। অন্যদিকে ক্রেতা পণ্যের দাম সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হওয়া সত্ত্বেও সে আলস্যবশতঃ কম মূল্যের বাজারে না যেয়ে উচ্চ মূল্যের বাজারে যেতে পারে।
(ঝ) আইনগত ভিত্তি: অনেক সময় আইনগত ভিত্তির জন্যও মূল্য বৈষম্য হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বাংলাদেশ তিতাস গ্যাস কোম্পানীর কথা বলা যেতে পারে। এ কোম্পানী আবাসিক ব্যবহারের জন্য কম দামে এবং কল-কারখানায় বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য বেশী দামে গ্যাস সরবরাহ করে থাকে।
(ঞ) ক্রেতারা সামাজিক মর্যাদা: অনেক সময় দেখা যায়, ক্রেতারা সামাজিক মর্যাদার জন্য অভিজাত জায়গা থেকে পণ্য ক্রয় করে থাকে। একজন ধনী ক্রেতা সাধারণ বাজার থেকে কম দামে না কিনে সুপারশপ থেকে একই দ্রব্য বেশি দামে ক্রয় করে।