সংবাদ প্রভাকর – Sambad Prabhakar, বাংলার প্রথম দৈনিক ঈশ্বর গুপ্তের ‘সংবাদ প্রভাকর’,সংবাদ প্রভাকর pdf সংবাদ প্রভাকর টিকা, ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক কে ছিলেন?,
সংবাদ প্রভাকর এর গুরুত্ব

বিষয়: সংবাদ প্রভাকর – Sambad Prabhakar, বাংলার প্রথম দৈনিক ঈশ্বর গুপ্তের ‘সংবাদ প্রভাকর’,সংবাদ প্রভাকর pdf সংবাদ প্রভাকর টিকা, ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক কে ছিলেন?,
সংবাদ প্রভাকর এর গুরুত্ব

‘সংবাদ-প্রভাকর’ সংবাদপত্রটি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের সম্পাদনায় ১৮৩৯ সাল থেকে, প্রথম দৈনিক বাংলা সংবাদপত্র হিসেবে পরাধীন ভারতবর্ষের রাজধানী কলকাতা থেকে প্রকাশিত হতে শুরু করে ৷ আজ থেকে ১৭৫ বছর আগে প্রকাশিত এই সংবাদপত্র, বাংলা তথা ভারতের সাংবাদিকতার একটি ব্যতিক্রমী উদাহরণ ৷ কে ছিলেন এই ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত আর কি বা ছিল তার সংবাদপত্র ‘সংবাদ-প্রভাকর’-র পাতায়?

১৭৮০ সালে প্রকাশিত হয় ভারতের প্রথম সংবাদপত্র, জেমস অগাস্টাস্ হিকির ‘বেঙ্গল গেজেট’ ৷ তারপর ১৮১৮ সালে আবার সংবাদপত্র প্রকাশ ৷ ১৭৮০ থেকে ১৮৩১ সাল, এই সময়ের মধ্যে হাতে গোনা বাংলা সংবাদপত্র প্রকাশিত হয় ৷ ভারত তথা বাংলার সাংবাদিকতা চর্চা তখন মূলত বিদেশীদের দখলে৷  সংবাদপত্রের ইতিহাসে বাংলা ভাষার অবস্থা এই সময়ে খুব একটা আশাব্যঞ্জক ছিল না ৷

ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত মাত্র ১০ বছর বয়সে মাতৃবিয়োগের পর, বর্তমান নদীয়া জেলার কাঁচড়াপাড়ার এক দরিদ্র পরিবার থেকে কলকাতায় আসেন ৷ তৎকালীন হিন্দু কলেজ বা ব্রাহ্মসভাপন্থী উচ্চ শিক্ষার আঙিনায় প্রবেশ করার মত শিক্ষাগত যোগ্যতা বা আর্থিক সামর্থ্য কোনটাই তাঁর ছিল না ৷ গ্রাম্য পরিবেশে বড় হয়ে ওঠা ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের কাছে তৎকালীন রামমোহনের ব্রাহ্মসভার অদ্বৈতবাদ, রক্ষণশীল হিন্দুদের ধর্মসভার হিন্দুত্ববাদ কিংবা ডিরোজিও-র নেতৃত্বে নব্যবঙ্গ যুবকদের পাশ্চাত্যমুখী নীতি ও জীবনাদর্শবাদ, খুব একটা সহজবোধ্য ছিল না ৷ আবার তৎকালীন ইংরেজি শিক্ষা আর বাংলা কঠিন পদ্যের মর্মার্থ বোঝার পরিধির অনেকটাই বাইরে ছিল বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ৷ ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের পদ্য রচনায় এবং গদ্যের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক প্রতিভা ছিল অল্প বয়স থেকেই ৷ ছিল তরুণ বয়সে ও সেই সময়ে দাঁড়িয়ে, সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করার মত ঝুঁকি নেওয়ার মানসিক শক্তিও ৷ পরিণত বয়সে আসে দৃষ্টিভঙ্গীতে স্বচ্ছতা ৷ উল্লেখ্য, বাংলায় মুদ্রণ ব্যবসার সার্বিক স্বীকৃতি আসতে সময় লেগেছিল আরও বেশ কিছুটা সময়, ১৮৪০-র পর থেকে ৷


আরো ও সাজেশন:-

সংবাদপত্র তথা সাময়িকপত্র ছাপিয়ে লাভ স্বল্প হলেও সেগুলি বেশিদিন চলত না ৷ অবশ্য এক্ষেত্রে বাণিজ্যিকভাবে বিজ্ঞাপন-চাঁদা তথা আর্থিক আনুকুল্য লাভের সম্ভাবনা স্বল্প হলেও ছিল ৷ তাই বাংলা সমাজে, সাংবাদিক-সম্পাদক-লেখক এবং স্বতাধিকারীর ভূমিকায় স্বাধীন ও সফলভাবে অবতীর্ণ হওয়ার তথা সাংবাদিকতাকে একটা সফল পেশা হিসেবে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের ভূমিকা কিন্তু অগ্রজসমই ছিল ৷ তিনি সংস্পর্শে আসেন তৎকালীন ধনবান পাথুরিয়াঘাটার ঠাকুর পরিবারের যোগেন্দ্রমোহন ঠাকুরের ৷ তাঁরই আর্থিক সহায়তায় ও সমর্থনে, ১৮৩১ সালে প্রকাশিত হয় ‘সংবাদ প্রভাকর’ ৷ এই সময় ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের ‘সংবাদ-প্রভাকর’-র আক্রমণের লক্ষ্য ছিল মূলত নব্যবঙ্গ যুবক বা ‘ইয়ং বেঙ্গল’ দল, হিন্দু কলেজের ছাত্র এবং ব্রাহ্মবাদী বা মডারেটপন্থী-রা ৷ কবির দলে গান বাঁধার ফলে তার লেখায় বিদ্রুপ-শ্লেষ-ব্যঙ্গরসের প্রবণতা ছিল স্বাভাবিক ৷ তৎকালীন সরকারের, হিন্দু কলেজে সবার সমান শিক্ষার অধিকারের সিন্ধান্ত নিয়েও তিনি সমালোচনা করেছিলেন ৷ তরুণ সম্পাদকের ‘সংবাদ প্রভাকর’ সম্পাদনার এই প্রথম পর্বটি কিছুটা সংশয়াচ্ছন্ন ছিল ৷ আসলে একাধিক ধারায় বিভক্ত সেই সময়কার হিন্দু সমাজ ও তার দ্বন্দের মাঝখান থেকে, এক তরুণ দর্শক-সম্পাদকের কাছে রক্ষণশীল পথ বেছে নেওয়াটা স্বাভাবিক তথা নিরাপদও বলেই মনে হয়েছিল  ৷ পরবর্তী সময়ে অবশ্য ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের সাথে-সাথেই ‘সংবাদ প্রভাকর’-ও অনেক পরিণত হয়ে ওঠে ৷ ১৮৩২ থেকে ১৮৩৬ সাল পর্যন্ত, ‘সংবাদ প্রভাকর’ প্রকাশ বন্ধ থাকে ৷ ১৮৩৬ সাল থেকে ‘সংবাদ প্রভাকর’-র পুনঃপ্রকাশের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় পর্যায় শুরু ৷ ততদিনে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের মনোভাব আর চিন্তাধারার অনেকটাই পরিবর্তন ঘটেছে ৷ যার প্রমাণ পাওয়া যায় সেই সময়ে প্রকাশিত-‘ফ্রেণ্ড অফ ইণ্ডিয়া’, ক্যালকাটা ক্রিশ্চিয়ান অবজার্ভার’-প্রভৃতি আরো একাধিক সংবাদপত্রে, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত ও ‘সংবাদ প্রভাকর’ সমন্ধে মূল্যায়ণগুলি থেকেই ৷ বঙ্কিমচন্দ্রের মতেও, এই পর্বে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত ১৮৩১-৩২-র মত আর উগ্র রক্ষণশীল ছিলেন না ৷  এটাও বাস্তবিক সত্য যে, ১৮৩৮ সালে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত তত্ত্ববোধিনী সভায় ভাষণ দেন, যার অনুরুপ লেখা প্রভাকর-এ প্রকাশ পেয়েছিল ৷ সেই সময় থেকেই, তৎকালীন বাংলার বুদ্ধিজীবিদের সঙ্গে উদারপন্থী মানুষদেরও যোগসূত্র গড়ে উঠতে শুরু করে ৷ ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত আর ‘সংবাদ প্রভাকর’–র প্রভাবও সমাজে আরো ছড়িয়ে পড়তে থাকে ৷ জোঁড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবার এবং দ্বারকানাথ ঠাকুরের সাথে ভালো সম্পর্কের সূত্রে ব্রাহ্মধর্ম দ্বারাও তিনি প্রভাবিত হয়েছিলেন ৷ বিভিন্ন সভা-সমিতির, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত  সদস্য ছিলেন ৷ কবিতাও পাঠ করতেন নানা জায়গায় ৷ সমাজের সাথে ভালো জনসংযোগ রক্ষার প্রক্রিয়ায় একজন সম্পাদকের ‘সংবাদ প্রভাকর’-র সার্থক ব্যবহার, পত্রিকটি প্রকাশের অল্প সময়ের মধ্যেই তাকে দৈনিক রুপে পরিচালিত হওয়ার মত সুদৃড় এক সংগঠন ব্যবস্থায় পরিণত করে ৷ লেখকের তালিকায় যুক্ত হয় প্রেমচাঁদ তর্কবাগীশ, রাধানাথ শিরোমণির মত পণ্ডিত বা রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, অক্ষয়কুমার দত্তের মত তৎকালীন প্রতিষ্ঠিত লেখক; নবীন লেখক শ্যামাচরণ বসু, পূর্ণচন্দ্র ঘোষ-প্রভৃতি আরো অনেকেই ৷ গঠনমূলক এবং আধুনিক চিন্তাধারা, ইংরেজী তথা নির্দিষ্ট শ্রেণীর মধ্যে আবদ্ধ না থেকে তা বাংলা ভাষার মাধ্যমে ক্রমশ ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল ৷ কারণ তিনি প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিত্ব ছাড়াও সুযোগ দিয়েছিলেন তরুণ লেখকদের ৷ নবীন লেখকদের লেখার সুযোগ দেওয়া নিঃসন্দেহে পত্রিকাটির সেই সুদৃঢ় পরিচালন ব্যবস্থারই আরেকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল ৷ অবশ্যই এই কৃতিত্বের দাবীদার ছিলেন সম্পাদক ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত ৷ আবার জীবন-জীবিকার জন্য ইংরেজী জানা তথা বিদেশী শক্তির প্রতি আনুগত্যবোধ থাকাটা সেই সময়ের মানুষের কাছে স্বাভাবিক অবস্থানের সাথে-সাথেই, মাধ্যমের একটা নিজস্ব–শক্তি একটা হাল্কা স্বাধীনতাবোধের আশ্বাসও দিয়েছিল ‘সংবাদ প্রভাকর’ ৷ এই সামাজিক ও ধর্মীয় রক্ষণশীলতার সীমাবদ্ধতায় থেকেও ‘সংবাদ প্রভাকর’ স্বল্প কিন্তু নতুন এক জীবিকার সম্ভাবনার দিক দেখিয়েছিল ৷

১৮৩৯ সালে ‘সংবাদ প্রভাকর’ প্রথম বাংলা দৈনিক সংবাদপত্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ৷ সামাজিকভাবে সংবাদপত্রটির প্রভাব বৃদ্ধির সাথে সাথেই, ব্যবসায়িকভাবে লাভের সম্ভাবনার উত্তরোত্তর বৃদ্ধি প্রাপ্তি হয়ত ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তকে হয়ত উৎসাহী করেছিল, তাকে দৈনিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করাতে ৷ এই প্রসঙ্গে আরেকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, সেই সময়ে সংবাদপত্রের সাথে সাময়িকপত্র- এই ধারণার মধ্যে বিশেষ কোন অন্তর ছিল না ৷ সেগুলির আবার অকালমৃত্যু ঘটত পারম্পরিক ধারায় ৷ সংবাদপত্র সম্পর্কে ধারণার বীজ বাংলা সমাজে খুব অল্প সময় আগেই গ্রথিত হয়েছে, সাল ১৭৮০ ৷ এই রকম একটি অনিশ্চয়তার আবর্তে দৈনিক সংবাদপত্র প্রকাশের চিন্তার যুক্তিসিদ্ধ জায়গা ছিল বলেই অনুমান করা যেতে পারে ৷ কারণ, বাজারের স্পন্দন অনুভব না করে শুধুমাত্র ব্যতিক্রম বা চমক দিয়ে দীর্ঘদিন ব্যবসা করা সম্ভব নয় ৷ গর্ববোধ অনুভূত হয় একজন বাঙালীর জন্য, যিনি সেই সময়ে দাঁড়িয়ে সম্পাদকের সাথে প্রকাশক পদের মধ্যে, অন্তরকে বজায় রেখেছিলেন ৷

[ বি:দ্র: নমুনা উত্তর দাতা: রাকিব হোসেন সজল ©সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত (বাংলা নিউজ এক্সপ্রেস)]

উনবিংশ শতকে বাঙালী মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উথ্থান এবং জীবিকা হিসেবে সাংবাদিকতাকে বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রেও ‘সংবাদ প্রভাকর’ একটি সুষ্পষ্ট দিক নির্দেশ করেছিল ৷ কারণ ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত সব ধরণের মানুষকে তাঁর সংবাদপত্রের সাথে যুক্ত করে সেই প্রেক্ষাপটটি তৈরি করেছিলেন; দিয়েছিলেন চিন্তা-ভাবনার অবকাশ ৷ সামাজিক স্তরের ভিন্ন-ভিন্ন প্রতিক্রিয়াশীল স্তরের সাথে একটি মাধ্যম-ব্যবস্থার এই ধরণের পারস্পরিক অথচ উন্মুক্ত সংযোগ-প্রক্রিয়ায় কিন্তু বিশেষভাবে লাভবান হয়েছিল তৎকালীন মধ্যবিত্ত শ্রেণী ৷ যাদের কাছে মাতৃভাষার মাধ্যমেই সৃষ্টিশীল চিন্তাভাবনার এবং বেঁচে থাকার মধ্যে, একটি ভারসাম্যের পরিসর তৈরী হয়েছিল ৷ সংবাদপত্রের সাথে সাময়িকপত্রের অন্তর, ভিন্ন-ভিন্ন স্বাদের লেখনী-শৈলী আর সমাজে তার চাহিদার পারস্পরিক সম্পর্ক, পেশাগত দিক থেকেও সেই সময় সংবাদপত্রের জায়গাকে, ক্রমশ মজবুত করে তুলছিল ৷ তাই পরিচালনার নীতিগত দৃষ্টিভঙ্গী আর বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্য ধরলে, ‘সংবাদ প্রভাকর’ বাংলা সাংবাদিকতার প্রারম্ভিক পর্বে একটি ব্যতিক্রমী ধারার সাংবাদিকতা চর্চার উদাহরণ ৷ প্রকৃতপক্ষে, ‘সংবাদ প্রভাকর’-র সাফল্যের কয়েকটি সংগত কারণ ছিল বলে অনুমান করা যেতে পারে, যা আজকের দিনেও সংবাদ-সংগঠন পরিচালনার ক্ষেত্রে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ৷ প্রথমত-আর্থিক সুনিশ্চিয়তা যেকোনো সংগঠনের কর্মপ্রবাহকেই সুস্থির করে তোলে ৷ কিন্তু তার সাথেই দরকার, পরিচালনায় সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা, দক্ষ ও দৃড়-সাহসী মনোভাব; সময়ের সাথে, আবার কোন-কোন সময় দুরদর্শী ব্যতিক্রমী সিন্ধান্ত ৷

‘সংবাদ প্রভাকর’ প্রকাশের মধ্যবর্তী দ্বিতীয় পর্যায়টি, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের রক্ষণশীল মানসিকতার সাথে তার সাংবাদিকতা চর্চারও একটি ভাঙা-গড়ার সময় ৷ যে সময়ে বাংলার সামাজিক অবস্থাও ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে খুঁজে নিচ্ছে ঠিক আর ভুলকে ৷ সংকীর্ণতার বেড়াজাল ভেঙে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টায় বাংলার সমাজজীবন বারবার ‘সংবাদ প্রভাকর’-এ এই সময়ে উঠে এলেও, তা কোন সুদৃড় মতবাদ হিসেবে তখনও প্রতিষ্ঠিত হয়নি ৷ ‘সংবাদ প্রভাকর’-র মধ্য দিয়ে কবি-সম্পাদক ও লেখকের, পাঠক তথা বাংলার সমাজজীবনে রেখাপাত করার মত কাজের সূত্রপাত, এই দ্বিতীয় পর্যায়ের শেষদিক থেকেই ৷ আর ১৮৪৮ থেকে ১৮৫৯ সাল, এই সময়কালে প্রকাশিত ‘সংবাদ প্রভাকর’-র সংখ্যাগুলি পাওয়া যায় বলে এই সময়টি তৃতীয় ও শেষ পর্যায় হিসেবে চিন্হিত ৷ মূলত এই সময়ের সংস্করণগুলির প্রামাণ্যস্বরুপ বিশ্লেষণ ওপর ভিত্তি করেই এই সিন্ধান্তে পৌঁছানো অনেক সহজ হয় যে, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত এবং ‘সংবাদ প্রভাকর’-র সময় থেকেই বাংলা সাহিত্যে আধুনিক যুগের সূচনা ৷ আরো পরিস্কার হয়, সাহিত্যের সাথে সাংবাদিকতার কোন বিরোধ নেই, যদি উভয়ের স্ব-ভরকেন্দ্র এবং নিরপেক্ষতা বজায় থাকে ৷ তাই আমরা দেখতে পাই, ‘সংবাদ প্রভাকর’-এ কিভাবে দৈনন্দিন জীবনের ঘটনা থেকে ধর্মতত্ত্ব সবই ফুটে উঠেছে ৷ প্রথম পর্বে যেখানে পদ্য ছিল সমালোচনার হাতিয়ার, পরে সেই সাহিত্যই হল সমালোচনার বাহক ৷ বিষয়বস্তু নির্বাচন তথা সমালোচনার বৈচিত্র্যেও ছিল সম্পাদকের নিজস্ব চিন্তাভাবনার অভিনবত্বের প্রকাশ ৷ ‘সংবাদ প্রভাকর’-র মধ্য দিয়ে উপস্থাপনায়- ইংরেজী শিক্ষার বিস্তার, যন্ত্রশিল্পের উন্নতি, সেই সময়ের মধ্যবিত্ত সমাজের দৈনন্দিন সমস্যা, জীবন ও জীবিকা, নীলকরদের অত্যাচার ও কৃষকদের সহানুভূতি-সব বিষয়েই ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের অবাধ যাতায়াত ছিল ৷ পত্রিকার আরেকটি বৈশিষ্ট্য ছিল, বাংলা সাহিত্যের মধ্য দিয়ে বাংলা সংবাদপত্রে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা বর্ণন ৷ ১৮৪৮ সাল থেকে, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত দেশ ভ্রমণে বেরোন ৷ ধারাবাহিকভাবে একজন সম্পাদকের ভ্রমণ-অভিজ্ঞতার মুদ্রণ প্রকাশ, আজকের যুগে যতটা শুনতে স্বাভাবিক বলে মনে হয়, ১০০-১৫০ বছর আগে তা ছিল ঠিক ততটাই ব্যতিক্রমী ৷ বলা বাহুল্য, এই ধরণের নতুনত্বের আস্বাদে কিন্তু সংবাদপত্রটির জনপ্রিয়তাও বৃদ্ধি পেয়েছিল ৷ ব্যতিক্রমের উদাহরণ আছে আরো অনেক ৷ যেমন-গ্রাম বাংলার সাধারণ মানুষের নানা সমস্যা-জিজ্ঞাসা-সমালোচনামূলকপত্র প্রকাশের মধ্য দিয়ে গ্রামবাংলার সাথে ‘সংবাদ প্রভাকর’-র একটি নাড়ীর যোগসূত্র গড়ে ওঠে ৷ জনসংযোগ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সংবাদপত্রের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির এই দৃষ্টান্ত পেশাদারী চিন্তাভাবনার উদাহরণ তো বটেই, ‘সংবাদ প্রভাকর’ সেই সময়কারও একটি অন্যতম দলিলস্বরুপ ৷ যদিও সম্পাদক হিসেবে তাঁর সম্পাদকীয় রচনায় উপরোক্ত উদারপন্থী পদক্ষেপ গ্রহণের সাথে কিছু বিষয়ে স্ব-বিরোধীতাও লক্ষ্য করা গেছে ৷ যেমন-হিন্দু ধর্ম, বিধবা বিবাহ কিংবা স্ত্রী শিক্ষার প্রসার, সিপাহী বিদ্রোহ-প্রভৃতি বিষয়ের ক্ষেত্রে তাঁর মনোভাব ছিল রক্ষণশীল ৷ কিন্তু একজন সম্পাদক হিসেবে নিজ বিশ্বাসে অটুট থেকে স্বাধীনভাবে অভিমত প্রকাশ, তৎকালীন পাঠকদেরকে দিয়েছিল একটি সুষ্পষ্ট নিশ্চয়তা ৷ আবার একইসাথে সমসাময়িক অবস্থাকে এড়িয়ে না যাওয়ায়, ১৮৪৮ থেকে ১৮৫৯ সাল পর্যন্ত ‘সংবাদ প্রভাকর’ নিজ বৈশিষ্ট্যে হয়ে উঠেছিল অনন্য ৷ এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা উচিত, ‘সংবাদ প্রভাকর’ ছাড়াও ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত কিন্তু আরো একাধিক ক্ষণস্থায়ী সংবাদপত্রের সম্পাদক এবং প্রকাশনার কাজও করেছেন ৷ তাঁর সুনির্দিষ্ট চিন্তা-ভাবনার প্রকাশ কিন্তু সবক্ষেত্রেই কম-বেশী পরিলক্ষিত হয়েছিল ৷ যেমন, মূলত সাহিত্যভিত্তিক লেখাগুলিকে নিয়ে তিনি ‘মাসিক প্রভাকর’ শুরু করেছিলেন ৷ দৈনিক একটি সংবাদপত্রে বিষয়গত প্রাধান্যতার সীমাবদ্ধতার সাথেই সময় ও সমাজে নতুন একটি চিন্তাধারার সমান্তরাল দাবী যে থাকতে পারে, তা একজন সচেতন পরিচালনা-ব্যবস্থাপকের নজর এড়ায়নি ৷ ‘সংবাদ প্রভাকর’-র আয়ু অল্প ছিল, কিন্তু সাহিত্যিক-সম্পাদক-কবি-প্রকাশক ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের এই ব্যতিক্রমী প্রয়াস বাংলা সাহিত্য আর সাংবাদিকতা উভয়ক্ষেত্রেই দীর্ঘস্থায়ী একটি জায়গা করে নিয়েছে ৷


গুরুত্ব


সংবাদ প্রভাকর উনিশ শতকের একটি প্রথম শ্রেণির পত্রিকা, যাতে ভারতবর্ষসহ বহির্বিশ্বের সংবাদের পাশাপাশি ধর্ম, সমাজ ও সাহিত্যের বিভিন্ন বিষয় নিয়েও রচনা প্রকাশিত হতো। পত্রিকাটিতে তৎকালীন বহু বিখ্যাত পন্ডিত ও উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি তাঁদের রচনা প্রকাশ করতেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন রাজা রাধাকান্ত দেব, জয়গোপাল তর্কালংকার, প্রসন্নকুমার ঠাকুর এবং রামকমল সেন। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং দীনবন্ধু মিত্রের লেখক জীবনের প্রথম পর্যায়ের অনেক রচনাই সংবাদ প্রভাকরে প্রকাশিত হয়। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা লেখকদল পরবর্তীকালে বাংলা সাহিত্যে প্রাধান্য বিস্তার করেছিলেন এবং পত্রিকাটির প্রাথমিক রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গি পরবর্তীকালে কিছুটা নমনীয় ও উদার হয়েছিল। 

১৮৪০ ও ১৮৫০-এর দশকে পত্রিকাটি নারীশিক্ষা ও বিধবা-বিবাহের প্রতি সমর্থন প্রদান করা ছাড়াও কৌলীন্য প্রথার বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জমিদারদের সহায়তার কারণে পত্রিকাটি ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ততটা জোরালোভাবে সমালোচনা না করে বরং শাসকদের পক্ষেই অবস্থান নেয়। তবে, নীলচাষের বিরুদ্ধে জনমত গঠনে সংবাদ প্রভাকর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। সংক্ষেপে বলা যায় যে, পত্রিকাটিতে উনিশ শতকের বাংলা রেনেসাঁর ভাবধারার প্রতিফলন ঘটেছিল। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, পত্রিকাটির প্রকাশিত সবগুলি সংখ্যা কোন গ্রন্থাগারেই সংরক্ষিত হয়নি। তবে, কলকাতার বঙ্গীঁয় সাহিত্য পরিষদ ও জাতীয় গ্রন্থাগারে এর কয়েকটি সংখ্যা সংরক্ষিত রয়েছে।

[ বি:দ্র: নমুনা উত্তর দাতা: রাকিব হোসেন সজল ©সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত (বাংলা নিউজ এক্সপ্রেস)]

Paragraph & Composition/Application/Emali উত্তর লিংক ভাবসম্প্রসারণ উত্তর লিংক
আবেদন পত্র/প্রতিবেদন/ চিঠি ও ইমেল উত্তর লিংক প্রবন্ধ, অনুচ্ছেদ রচনা উত্তর লিংক

এখানে সকল প্রকাশ শিক্ষা বিষয় তথ্য ও সাজেশন পেতে আমাদের সাথে থাকুন ।

প্রশ্ন ও মতামত জানাতে পারেন আমাদের কে ইমেল : info@banglanewsexpress.com

Leave a Comment