বৈদেশিক বিনিময় হার উঠা-নামার কারনগুলো উল্লেখ কর, ইসলামী ব্যাংকের মূলনীতি কী

বৈদেশিক বিনিময় হার উঠা-নামার কারনগুলো উল্লেখ কর

বৈদেশিক বিনিময় বলতে আমরা সাধারণতঃ বৈদেশিক মুদ্রাকে বুঝে থাকি। বিদেশ হতে যে মুদ্রা আহরণ করা হয় বা উপার্জন করা হয়, তা-ই বৈদেশিক মুদ্রা নামে পরিচিত। নিজের দেশের মুদ্রা ছাড়া সব মুদ্রাই বৈদেশিক মুদ্রা। যেমনভারত, পাকিস্তান, যুক্তরাজ্য বা যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা বাংলাদেশের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা।

তবে অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বৈদেশিক বিনিময় বলতে দেশি ও বিদেশী মুদ্রার বিনিময় হারকেও বুঝায়। আমাদের দেশের এক টাকা দিয়ে বিদেশের যে পরিমাণ মুদ্রা ক্রয় করা হয় তাই বিনিময় হার। কোন দেশের মুদ্রার অধিকার অন্য দেশের মুদ্রার অধিকারে রূপান্তরিত করার উপায় ও পদ্ধতি বৈদেশিক বিনিময় নামে অভিহিত।

বনিময় হারের উঠানামার কারণসমূহ

বৈদেশিক বিনিময় হারের উঠানামা বা পরিবর্তনের জন্য নি¤œলিখিত কারণগুলো দায়ী:

১. ব্যবসায়িক অবস্থার পরিবর্তন ঃ আমদানী রপ্তানীর পরিমাণের সাথে বিনিময় হারের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। আমদানী
অপেক্ষা রপ্তানীর পরিমাণ বেশি হলে মুদ্রার চাহিদা বৃদ্ধি পায় এবং বিনিময় হারও সে দেশের অনুক‚লে পরিবর্তিত হয়। আর আমদানীর পরিমাণ রপ্তানীর পরিমাণ অপেক্ষা বেশি হলে বিপরীত ফল ঘটে থাকে। অর্থাৎ মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধি পায়
এবং চাহিদা অপরিবর্তিত থাকলে বিনিময় হার সেদেশের প্রতিক‚লে পরিবর্তিত হয়।

২. মুলধনের গতিবিধি ঃ সম্পদশালী জাতিসমূহ গরীব দেশসমূহকে আর্থিক সাহায্য ও সুবিধাদি প্রদান করে থাকে যা সর্বজনবিদিত। ঋণ ও খয়রাতি সাহায্যের মারফত এক জাতি আরেক জাতিকে সাহায্য করে থাকে। এরূপ সাহায্যের
মাধ্যমে মূলধন স্থানান্তরিত হয়। মূলধনের এরূপ স্থানান্তরের ফলে বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা ও সরবরাহের পরিবর্তন হয়। যে দেশ ঋণ ও খয়রাতি সাহায্য পায়, বিনিময় হার সে দেশের অনুক‚লে এবং সাহায্যকারী দেশের প্রতিক‚প্রতিকূলে যায়।

৩. শেয়ার বাজারের প্রভাব ঃ বিদেশী ঋণ ও তার সুদ পরিশোধকালে এবং বিদেশী সিকিউরিটি খরিদ করার সময় বিনিময় হারের উপর এর প্রভাব পড়ে। সে সময় বিদেশী মুদ্রার চাহিদা বৃদ্ধি পায়। ফলে বিনিময় হারও বিদেশের অনুক‚প্রতিকূলে যায়।

৪. ব্যাংক নীতি ঃ ব্যাংক-হার বৃদ্ধির করা হলে রপ্তানী বৃদ্ধি পায়। ফলে বিদেশ হতে মূলধনের আগমন ঘটে। যে দেশের
ব্যাংক-হার বৃদ্ধি পায় সে দেশের মুদ্রার চাহিদাও বিদেশে বৃদ্ধি পায়। ব্যাংক-হার কম হলে আমদানী বৃদ্ধি পায় এবং দেশের ভেতর হতে বিদেশে মূলধন চলে যায়। এর পরিণতিস্বরূপ দেশে মুদ্রার চাহিদা কমে যায় এবং বিনিময় হার প্রতিক‚প্রতিকূলে পরিবর্তিত হয়। ব্যাংক ড্রাফ্ট ক্রয়-বিক্রয় এবং পর্যটক চেক ইস্যুর ফলেও বিনিময় হারের পরিবর্তন ঘটে। কারণ বিদেশে ড্রাফ্ট বা পর্যটক চেক ভাঙ্গানো না হলে বিদেশী মুদ্রার চাহিদা তদনুপাতে বৃদ্ধি পায়। ফলে বিনিময় হার বিদেশের অনুক‚লে এবং নিজ দেশের প্রতিক‚লে যায়। নিজের দেশে বিদেশ থেকে ইস্যুকৃত ড্রাফ্ট বা পর্যটক চেক ভাঙ্গানো হলে বিপরীত অবস্থা ঘটে।

৫. মুদ্রার অবস্থা ঃ মুদ্রার অপচয় ঘটলে তা দেশের বাইরে চলে যেতে পারে এবং এমতাবস্থায় বিদেশ হতে দেশের ভেতরে মূলধনের আগমন ঘটে না। তাই বিনিময় হারের অবনতি ঘটে। মুদ্রার মূল্যের উন্নতি হলে বিপরীত ফল পাওয়া যায়।

৬. আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ঃ দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিপন্ন হলে তা বিনিময় হারের উপর প্রতিক‚ল প্রভাব বিস্তার করে। কারণ রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাব দেখা দিলে বিদেশ হতে পুঁজির আমদানী হ্রাস পায়। উপরন্তু দেশ হতে বিদেশে মূলধন পাচার হয়ে যায়।

৭. সরকারি নীতি ঃ কোন দেশের সরকার প্রয়োজন মনে করলে অন্যান্য দেশের মুদ্রার সাথে নিজ দেশের মুদ্রার বিনিময় হার পরিবর্তন করতে পারে। সরকারি নীতি অনুযায়ী বিনিময় হার বাড়তেও পারে, কমতেও পারে।

৮. বৈদেশিক মুদ্রার ফটকা ব্যবসায় ঃ দেশের অভ্যন্তরে কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বৈদেশিক মুদ্রার অবাঞ্ছিত ফটকা ব্যবসায়ে নিয়োজিত হলে, তাদের এরূপ কার্যকলাপ বৈদেশিক বিনিময় হারের উপর প্রভাব বিস্তার করে। ফটকা ব্যবসায়ের গতি-প্রকৃতির ভিত্তিতে বিনিময় হারের হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটতে পারে।

৯. মূল্যস্তরের তারতম্য ঃ দুটি দেশের অভ্যন্তরীণ মূল্যস্তরে পার্থক্য বিরাজ করলে কিংবা হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটলে উভয় দেশেরই বিনিময় হার প্রভাবিত হয়। মূল্যস্তরের পরিবর্তনের সাথে সাথে বিনিময় হারেরও পরিবর্তন ঘটে।

১০. শিল্পোন্নয়নের পরিবেশ ঃ কোন দেশে শিল্প-কারখানার বৈদেশিক বিনিয়োগের সম্ভাবনা উজ্জ্বল থাকলে বিদেশী পুঁজিপতিরা সেখানে শিল্প প্রতিষ্ঠার জন্য এগিয়ে আসে। ফলে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রার সমাগম হয়। ফলশ্রæতিস্বরূপ, বিনিময় হার দেশের অনুক‚প্রতিকূলে যায়।

১১. প্রাকৃতিক অবস্থা ঃ অর্থনৈতিক কারণ ছাড়াও অনেক দৈব-সৃষ্ট কারণ রয়েছে যার দরুন বিনিময় হার উঠানামা করে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ঝড়-জলোচ্ছ¡াস বা বন্যা-মহামারীর কারণে দেশে অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিলে বিনিময় হার
দেশের প্রতিক‚লে চলে যায়।

১২. আন্তর্জাতিক ঘটনাপ্রবাহ ঃ এক দেশের সাথে অন্য দেশের যুদ্ধ বাধলে কিংবা দু’ দেশের মধ্যে ক‚টনৈতিক সম্পর্কের অবনতি ঘটলে উভয় দেশই ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং তার ফলে বৈদেশিক বিনিময় হারের উপর প্রতিক‚ল প্রভাব পড়ে।
আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ঘোলাটে আবহাওয়ার সৃষ্টি হলেও এরূপ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।

১৩. অন্যান্য কারণ ঃ উপরে উল্লিখিত কারণগুলো ছাড়াও আরও অনেক আর্থিক কিংবা অনার্থিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে যাকে বিনিময় হারের উঠানামার জন্য দায়ী করা যায়। বর্তমানে বাংলাদেশে বিনিময় হার অধিক হওয়ার কারণসমূহের মধ্যে মুদ্রা সরবরাহের মারাত্মক আধিক্য, বিদেশে রপ্তানীর পরিমাণ হ্রাস ও আমদানী বৃদ্ধি, বাংলাদেশী মুদ্রার চাহিদায় ঘাটতি ও বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা বৃদ্ধি এবং রাজনৈতিক গোলযোগ ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাব অন্যতম।

ইসলামী ব্যাংকের মূলনীতি কী

ইসলামি ব্যাংকিং (আরবি: مصرفية إسلامية‎‎) বলতে ইসলামী শরিয়ত মোতাবেক আর্থিক ব্যবস্থার উপর নির্ভর করে গড়ে উঠা ব্যাংক ব্যবস্থাকে বুঝায়। ইসলামি ব্যাংক দুটি মূলনীতির উপর প্রতিষ্টিত; যথাঃ লাভ ও লোকসানের ভাগ নেওয়া এবং সুদ লেনদেন নিষিদ্ধ।

আমাদের ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনায় নিন্মের মৌলিক ইসলামী ব্যাংকিং নীতিমালা অনুসরণ করা হয়:

রিবা বা সুদ নিষিদ্ধকরণ: ইসলামী ব্যাংকিংয়ে রিবা তথা সুদ আদান-প্রদান সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ।

টাকা হলো প্রচ্ছন্ন মূলধন: টাকা কোন পণ্য নয়, বরং বিনিয়োগের একটি মাধ্যম, মূল্যের ধারক ও পরিমাপের একক। টাকা ক্রয় করার ক্ষমতাকে প্রতিনিধিত্ব করে। কোনো উৎপাদনশীল কার্যক্রম ব্যতিত এর ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি করা সম্ভব নয়। ইসলামী অর্থায়ণ প্রকৃত অর্থনৈতিক কার্যক্রমের মাধ্যমে সম্পদ সৃষ্টির পক্ষপাতি।

ঝুঁকি বন্টণ: যেহেতু সুদ নিষিদ্ধ, তাই তহ্বিল সরবরাবকারীগণ ঋণদাতা না হয়ে বিনিয়োগকারী হিসেবে গণ্য হন। বিধায়, ব্যবসায় সংশ্লিষ্ট পক্ষসমূহ ব্যবসায়িক ঝুঁকি ভাগ করে নেয়।

ফটকাবাজী নিষিদ্ধকরণ: ইসলামী অর্থায়ন মজুদদারীকে নিরূৎসাহিত করে; পাশাপাশি চরম অনিশ্চয়তা (গারার) ও জুয়ার (মায়সির) সংমিশ্রণ আছে, এমন লেনদেনকে নিষিদ্ধ করে।

চুক্তির মর্যাদা রক্ষা : ইসলামী অর্থায়ন গ্রাহকের সাথে চুক্তির বাধ্য বাধকতা ও তার হিসাব সংশ্লিষ্ট সকল তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষা করাকে পবিত্র দায়িত্ব মনে করে। এই বৈশিষ্ট্যটি দ্যার্থ-বোধক তথ্য ও নৈতিক বিপত্তির ঝুঁকি কমায়।

শরীয়াহ্ অনুমোদিত কার্যক্রম : শারীয়াহর নীতি লংঘন করে না এমন ব্যবসায়িক খাতসমূহেই কেবল বিনিয়োগ করা হয়। উদাহরনস্বরূপ, মদ, জুয়া, তামাকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট খাতসমূহে বিনিয়োগ নিষিদ্ধ।

সামাজিক ন্যায়বিচার : যে কোন লেন-দেন, যা অবিচার ও শোষণের দিকে ধাবিত করে তা নিষিদ্ধ।

H.S.C

1 thought on “বৈদেশিক বিনিময় হার উঠা-নামার কারনগুলো উল্লেখ কর, ইসলামী ব্যাংকের মূলনীতি কী”

Leave a Comment