খতমে নবুয়ত ও শাফায়াতে বিশ্বাস হওয়া না হওয়া; একটি মূল্যায়ন

খতমে নবুয়ত বিশ্বাস হওয়া

ইসলামের মৌলিক আকীদা

তাওহীদ, রিসালাত, আখেরাত, নামায, রোজা, হজ¦, যাকাত, কোরআন, কেবলা ইত্যাদি বিষয় যে পর্যায়ের অকাট্য ও সন্দেহাতীত দলিল দ্বারা সুপ্রতিষ্ঠিত, খতমে নবুওয়াত তথা মুহাম্মদ (স.) এর শেষ নবী হবার আকীদাও অনুরূপ দলিল দ্বারা দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রমাণিত। এজন্যই তাওহীদ, রেসালাত, আখেরাত, নামায, হজ, যাকাত, কুরআন ইত্যাদির অস্বীকারকারী যেমন স্পষ্ট কাফের, তেমনিভাবে খতমে নবুওত অস্বীকারকারী এবং অবিশ্বাসীরাও কাফের। হযরত মুহাম্মাদ (সা.) আল্লাহর রসুল-এ বিশ্বাস যেমন অকাট্য তেমনি তিনি শেষ নবী, তাঁর পরে কিয়ামত পর্যন্ত আর কোনো নবী নেই এ বিশ্বাসও অকাট্য। খতমে নবুওয়াত সরাসরি অস্বীকার করা হোক কিংবা অপব্যাখ্যার অন্তরালে করা হোক সর্বাবস্থায় তা কুফর বলে গণ্য। এজন্য ইসলামের প্রথম খলীফা হযরত আবু বকর (রা.) নবুওতের দাবীদার মুসাইলামা ও তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে অত্যন্ত কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। যদিও তারা মৌলিকভাবে তাওহীদ ও রেসালাতে বিশ্বাসী ছিলো। শুধু নবুওতের দাবী তোলার কারণেই সাহাবায়ে কেরাম তাদের বিরুদ্ধে জেহাদে অবতীর্ণ হয়েছেন এবং তাদেরকে কঠোর হস্তে দমন করেছেন।

বর্তমান যুগে কাদিয়ানীরা আমাদের নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এর পরে ভিন্ন এক নবীর অস্তিত্ব স্বীকার করে। সুতরাং তাদেরকে মুসলমান বলার অর্থ হবে এটা মেনে নেওয়া যে, ইসলামে নতুন নবী আসার এবং তার উপরও ঈমান আনার সুযোগ রয়েছে। কোনো মুমিনের পক্ষে এমন বিভ্রান্তিকর কুফরী আকীদা মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। কেননা, খতমে নবুওতের বিষয়টি যুগপরস্পরায় প্রতিষ্ঠিত ও সর্বজনস্বীকৃত আকীদা এবং ইসলামের মৌলিক বিষয় ।

খতমে নবুওয়াতের দলীল

আল্লাহ তায়ালা মানব জাতির প্রয়োজনানুপাতে কালক্রমে তাদের বিভিন্ন শরীয়ত দিয়েছেন। আর এর পূর্ণতা ও শুভ পরিসমাপ্তি বিধান করেছেন মুহাম্মদ (সা.) এর মাধ্যমে। দ্বীনের পূর্ণাঙ্গতা লাভের পর যেহেতু এতে কোনোরূপ সংযোজন ও বিয়োজনের প্রয়োজন নেই তাই মানবজাতির জন্য নতুন শরীয়তেরও প্রয়োজন নেই। তাই আল্লাহ তায়ালা নবী-রসুল প্রেরণের ধারা চিরতরে বন্ধ করে দিয়েছেন। এটা ইসলামের অন্যতম মৌলিক বিশ্বাস। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেছেন, ‘আজ আমি তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণতা দান করেছি, আর আমি তোমাদের জন্য আমার নেয়ামতকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছি এবং দ্বীন হিসেবে ইসলামকে তোমাদের জন্য মনোনীত করেছি।’ (সূরা মায়েদা : ৩) পবিত্র কুরআনের অন্যত্র বলা হয়েছে, ‘মুহাম্মদ তোমাদের মধ্যকার কোনো পুরুষের পিতা নন, তবে তিনি আল্লাহর রসুল এবং সর্বশেষ নবী।’ (সূরা আহযাব : ৪০)। খতমে নবুওয়াতের ব্যাপারে রসুল (সা.) থেকে অসংখ্য হাদীস বর্ণিত হয়েছে। রসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘আমি এবং পূর্ববর্তী অন্যান্য নবীদের উদাহরণ হল, এক লোক একটি ঘর অত্যন্ত সুন্দর করে তৈরী করল। কিন্তু ঘরের এক কোনে একটা ইট ফাঁকা রেখে দিল। লোকজন চর্তুদিকে ঘুরে ঘরে তার সৌন্দর্য্য দেখে বিমোহিত হচ্ছে কিন্তু বলছে, এ ফাঁকা জায়গায় একটি ইট বসালে কতই না সুন্দর হত! আমি হলাম সেই ইট এবং আমি হলাম সর্বশেষ নবী।’ (বুখারী : ৩২৭১; মুসলিম : ৪২৩৯)। রসুলুল্লাহ (সা.) আরো বলেছেন, ‘অন্যান্য নবীর মুকাবিলায় আমাকে ছয়টি বিষয় দ্বারা বৈশিষ্ট্যমন্ডিত করা হয়েছে,’ তার মধ্যে দুটি বিষয় হলো, ‘আমাকে সমগ্র সৃষ্টি জগতের রসুলরূপে প্রেরণ করা হয়েছে এবং আমার দ্বারা নবীদের সিলসিলার পরিসমাপ্তি ঘটানো হয়েছে।’ (মুসলিম : ৫২৩)। এরূপ অসংখ্য কুরআনের আয়াত ও হাদীস দ্বারা প্রমাণিত ইসলামের অন্যতম মৌলিক আকীদা এই যে, হযরত মুহাম্মাদ (সা.) মানব জাতির হেদায়াতের জন্য প্রেরিত সর্বশেষ নবী। তাঁর পর আর কোনো নবী প্রেরিত হবেন না।

কাদিয়ানীদের আকীদা

কাদিয়ানীদের বই পত্রের মাঝে কাদিয়ানীকে যারা নবী হিসেবে স্বীকার করে না তাদেরকে কাফের আখ্যা দেওয়া হয়েছে। তাদের একটি প্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‘হাকীকাতুন নুবুওয়াহ’ গ্রন্থে বলা হয়েছে, ‘মির্জা গোলাম আহমদ ঐ অর্থে নবী, যে অর্থে পূর্ববর্তী হযরত মুসা ও ঈসা আলাইহিমুস সালাম নবী ছিলেন। যেমনিভাবে কোনো একজন নবীকে অস্বীকারকারী কাফের, তেমনিভাবে মির্জা গোলাম আহমদের নবুওত অস্বীকারকারীও কাফের।’ এভাবে কাদিয়ানী সম্প্রদায় নিজেদের মুসলিম পরিচয় দিয়ে ধোকা ও মিথ্যাচারের মাধ্যমে ইসলামের নামে একটি নতুন ধর্মমতের প্রচারণা চালিয়ে সমাজে অশান্তি ও বিভ্রান্তি ছড়িয়ে দিচ্ছে।

শাফায়াতে

সকল ধর্মবিশ্বাসী,বিশেষত সাধারণভাবে সকল মুসলমানই শাফায়াতে বিশ্বাসী অর্থাৎ কিয়ামতের দিন আল্লাহর ওলিগণ একদল গুনাহগার বান্দার জন্য সুপারিশ ও ক্ষমা প্রার্থনা (শাফায়াত) করবেন এবং এর মাধ্যমে তাদেরকে দোযখের আগুন হতে মুক্তি দিবেন। আবার কারো কারো মতে শাফায়াতের অর্থ আল্লাহর ওলিগণ সুপারিশের মাধ্যমে ব্যক্তির মর্যাদা ও অবস্থানের উত্তরণ ঘটাবেন। কিন্তু এই সুপারিশের বৈশিষ্ট্য ও পরিমাণ নিয়ে ধর্মবিশ্বাসীদের মধ্যে মতভেদ রযেছে। যেমন ইহুদীরা তাদের ওলী ও নবীদের ক্ষেত্রে শর্তহীন সুপারিশের অধিকারে বিশ্বাসী। কোরআন এ বিশ্বাসকে সুস্পষ্টভাবে ভিত্তিহীন বলে ঘোষণা করেছে। মুসলমানদের মধ্যে ওয়াহাবীরা বিশ্বাস করে শুধু আল্লাহর নিকট শাফায়াত কামনা করা জায়েয,তিনি ব্যতীত অন্য কোন ব্যক্তির নিকট শাফায়াত কামনা করা শিরক বলে গণ্য। কিন্তু সাধারণভাবে মুসলমানরা বিশ্বাস করেন শাফায়াতের (আল্লাহর নিকট সুপারিশ ও ক্ষমা প্রার্থনা) অধিকার আল্লাহ তাঁর কোন কোন বিশেষ বান্দাকে দিয়েছেন এবং মুসলমানরা সরাসরি তাঁদের নিকট শাফায়াতের আবেদন করতে পারে। তবে এ বিশ্বাস রাখতে হবে যে,সুপারিশ গ্রহণের ও ক্ষমা করার অধিকার প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর এবং তাঁর ওলিগণ তাঁর অনুমতি সাপেক্ষে এই শাফায়াত করবেন অর্থাৎ এক্ষেত্রে তাঁরা স্বাধীন নন;বরং আল্লাহর ইচ্ছার অনুবর্তী। আমরা এখানে এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করব।

মুসলিম উম্মাহর মতৈক্য

ইসলামী উম্মাহর আলেমগণ শাফায়াতের বৈধতা এবং মহানবী (সা.) যে কিয়ামতের দিন শাফায়াতকারীদের অন্যতম এ বিষয়ে একমত,যদিও তাঁদের মধ্যে শাফায়াতের শাখাগত কোন কোন বিষয়ে কিছুটা মতভেদ রয়েছে। প্রথমে আমরা শিয়া ও সুন্নী উভয় মাজহাবের দৃষ্টিকোণ থেকে শাফায়াতের বিষয়টি আলোচনা করব।

১। আবু মনসুর মাতেরিদী (মৃত্যু ৩৩৩ হিজরী) পবিত্র কোরআনের সূরা আম্বিয়ার ২৮ নং আয়াত :

﴿وَلَا يَشْفَعُونَ إِلَّا لِمَنِ ارْتَضَى﴾

“তারা যার প্রতি তিনি (আল্লাহ) সন্তুষ্ট তার জন্য ব্যতীত অন্য কারো জন্য শাফায়াত করবে না” -এর তাফসীরে বলেছেন,এ আয়াতটি ইসলামে শাফায়াত গ্রহণযোগ্য হওয়ার বিষয়টি সমর্থন করে। 

২। তাজুদ্দীন আবু বকর কালাবাজী (মৃত্যু ৩৮০ হি.) বলেছেন,‘আলেমদের মধ্যে এ বিষয়ে মতৈক্য রয়েছে যে,মহান আল্লাহ শাফায়াতের বিষয়ে যা কিছু বলেছেন এবং হাদীসসমূহে এ সম্পর্কে যা এসেছে তার সবকিছু বিশ্বাস করা ওয়াজিব।’

৩। শেখ মুফিদ (৩৩৬-৪১৩ হি.) বলেছেন,‘ইমামীয়া শিয়ারা এ বিষয়ে একমত যে,মহানবী (সা.) কিয়ামতের দিন তাঁর উম্মতের একদল গুনাহগার বান্দার জন্য শাফায়াত করবেন। তেমনি আমীরুল মুমিনীন (আ.) ও তাঁর বংশধারার পবিত্র ইমামগণ তাঁদের অনুসারীদের মধ্য হতে অনেক গুনাহগার বান্দার জন্য সুপারিশ ও ক্ষমা প্রার্থনা করবেন এবং মহান আল্লাহ তাঁদের শাফায়াতের কারণে অনেক গুনাহগার বান্দাকে জাহান্নাম হতে পরিত্রাণ দিবেন।’

৪। শেখ তূসী (৩৮৫-৪৬০ হি.) বলেছেন,‘শিয়ারা বিশ্বাস করে রাসূল (সা.),তাঁর অনেক সাহাবী,তাঁর বংশের ইমামগণ এবং মুমিন বান্দাদের অনেকেই শাফায়াত করবেন।’

৫। আবু হাফস নাসাফী (মৃত্যু ৫৩৮ হি.) বলেছেন,‘আল্লাহর নবিগণ মুসলিম উম্মাহর সৎকর্মশীল বান্দাদের কবীরা গুনাহকারীদের জন্য শাফায়াত করার অধিকার রয়েছে যা প্রমাণিত সত্য।’

৬। তাফতাজানী নাসাফীর মতের পর্যালোচনা করতে গিয়ে নির্দ্বিধায় তার মতকে সমর্থন করেছেন।

৭। কাজী আয়াজ ইবনে মূসা (জন্ম ৫৪৪ হি.) বলেছেন,‘আহলে সুন্নাত বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে শাফায়াতকে স্বীকার করে এবং পবিত্র কোরআনের আয়াতসমূহ এবং হাদীস তা ঘটবে বলে সাক্ষ্য প্রদান  ও সত্যায়ন করে।’

৮।

﴿وَاتَّقُوا يَوْمًا لَا تَجْزِي نَفْسٌ عَنْ نَفْسٍ شَيْئًا وَلَا يُقْبَلُ مِنْهَا شَفَاعَةٌ﴾

আয়াতটির তাফসীরে কাজী বাইদ্বাভী বলেছেন,‘অনেকেই এ আয়াতটিকে কবীরা গুনাহকারীদের জন্য শাফায়াতের বিপক্ষে দলিল হিসাবে উপস্থাপন করেছেন। কিন্তু আমাদের জানতে হবে যে,আয়াতটি কাফেরদের সম্পর্কিত। কারণ পবিত্র কোরআনের আয়াতসমূহ ও অসংখ্য রেওয়ায়েত রাসূলের উম্মতের জন্য শাফায়াতের বিষয়টি সত্যায়ন করেছে।’

৯। ফাততাল নিশাবুরী বলেছেন,‘মুসলমানদের মধ্যে এ বিষয়ে কোন মতৈক্য নেই যে,শাফায়াতের বিষয়টি সর্বসিদ্ধ এবং এর ফলশ্রুতিতে গুনাহগার মুমিনদের হতে শাস্তি দূরীভূত হবে।’১০

১০। ইবনে তাইমিয়া হাররানী (জন্ম ৭২৮ হি.) বলেছেন,‘মহানবীর জন্য কিয়ামতের দিন তিন ধরনের শাফায়াত রয়েছে… তৃতীয় প্রকারটি হলো জাহান্নামীদের জন্য।’১১

১১। নিজামুদ্দীন কুশচী (জন্ম ৮৭৯ হি.) বলেছেন, ﴿عَسَى أَنْ يَبْعَثَكَ رَبُّكَ مَقَامًا مَحْمُودًا﴾ আয়াতটির ২৬৬  ভিত্তিতে মুসলমানগণ শাফায়াত অবধারিত হওয়ার ঐকমত্য পোষণ করে।

১২। শারানী হানাফী বলেছেন,‘মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহী ওয়া আলিহী ওয়া সাল্লাম) কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম শাফায়াতকারী হবেন।’১২

১৩। আল্লামা মাজলিসী (জন্ম ১১১০ হি.) বলেছেন,‘শাফায়াতের বিষয়ে মুসলমানদের মধ্যে মতানৈক্য নেই। কারণ বিষয়টি ইসলামের অনস্বীকার্য বিষয়সমূহের অন্তর্ভুক্ত এ অর্থে যে,মহানবী (সা.) কিয়ামতের দিন তাঁর উম্মতের জন্য এমনকি পূর্ববর্তী নবিগণের উম্মতদের জন্যও শাফায়াত করবেন।’১৩

১৪। মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল ওয়াহহাব (১১১৫-১২০৬ হি.) বলেছেন,‘রাসূল (সা.),পূর্ববর্তী নবিগণ,ফেরেশতামণ্ডলী,ওলিগণ ও নিষ্পাপ শিশুদের শাফায়াতের অধিকার রয়েছে এ বিষয়টি বর্ণিত সকল হাদীসের ভিত্তিতে প্রমাণিত সত্য।’১৪

পবিত্র কোরআনে শাফায়াত

কোরআনের শাফায়াত সম্পর্কিত আয়াতসমূহকে কয়েক ভাগে ভাগ করা যায়।

১। যে সকল আয়াত শাফায়াতকে প্রত্যাখ্যান করে :

﴿ يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَنْفِقُوا مِمَّا رَزَقْنَاكُمْ مِنْ قَبْلِ أَنْ يَأْتِيَ يَوْمٌ لَا بَيْعٌ فِيهِ وَلَا خُلَّةٌ وَلَا شَفَاعَةٌ وَالْكَافِرُونَ هُمُ الظَّالِمُونَ﴾

“হে ঈমানদারগণ! তোমাদেরকে যে জীবিকা দেয়া হয়েছে তা হতে ব্যয় কর সেদিন আসার পূর্বে যেদিন কোন ক্রয় বিক্রয়,বন্ধুত্ব ও শাফায়াত নেই এবং কাফেররা বুঝতে পারবে তারাই জুলুমকারী ছিল।” (সূরা বাকারা : ২৫৪)

কিন্তু অন্যত্র কোরআনে আল্লাহর অনুমতি ব্যতিরেকে শাফায়াতকে প্রত্যাখ্যান করেছে। সুতরাং উক্ত আয়াতটিতে যে শাফায়াত আল্লাহর অনুমতি ব্যতীত সংঘটিত হবে তাকেই অস্বীকার করা হয়েছে।

২। ইহুদীদের বিশ্বাসের শাফায়াতকে বাতিল ঘোষণা :

﴿يَا بَنِي إِسْرَائِيلَ اذْكُرُوا نِعْمَتِيَ الَّتِي أَنْعَمْتُ عَلَيْكُمْ وَأَنِّي فَضَّلْتُكُمْ عَلَى الْعَالَمِينَ ﴾﴿ وَاتَّقُوا يَوْمًا لَا تَجْزِي نَفْسٌ عَنْ نَفْسٍ شَيْئًا وَلَا يُقْبَلُ مِنْهَا شَفَاعَةٌ وَلَا يُؤْخَذُ مِنْهَا عَدْلٌ وَلَا هُمْ يُنْصَرُونَ﴾

“হে বনি ইসরাঈল (ইসরাঈলের সন্তানগণ)! তোমাদের উপর যে নিয়ামত দিয়েছি তা স্মরণ কর। এবং নিশ্চয়ই আমি তোমাদেরকে বিশ্ববাসীদের উপর প্রাধান্য দিয়েছিলাম। সেদিনকে ভয় কর (সেদিন হতে নিজেকে রক্ষা কর) যেদিন একজনকে অপরের জন্য শাস্তি দেয়া হবে না এবং কারো শাফায়াত (সুপারিশ) গ্রহণ করা হবে না। কোন বিনিময় গৃহীত হবে না এবং তারা সাহায্য প্রাপ্তও হবে না।” ১৫

এ আয়াতে কোরআন বিশেষ ধরনের শাফায়াতকে বাতিল বলে ঘোষণা করা হয়েছে অর্থাৎ ইহুদীরা যে শর্তহীন শাফায়াতে বিশ্বাসী ছিল তা এ আয়াতে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। কারণ এ ধরনের শাফায়াতের ক্ষেত্রে অনুমতির প্রয়োজন নেই ধারণা করা হয়েছে এবং শাফায়াতকারী ও যার জন্য শাফায়াত করা হবে উভয়ের জন্যই কোন শর্ত আরোপ করা হয় নি।

৩। কাফেরদের জন্য শাফায়াতকে প্রত্যাখ্যান :

﴿وَكُنَّا نُكَذِّبُ بِيَوْمِ الدِّينِ ﴿٤٦﴾ حَتَّىٰ أَتَانَا الْيَقِينُ ﴿٤٧﴾ فَمَا تَنفَعُهُمْ شَفَاعَةُ الشَّافِعِينَ﴾

“(কাফেররা বলবে) আমরা প্রতিদান দিবসকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করতাম। এমতাবস্থায় (মৃত্যুর মাধ্যমে) কিয়ামতের বিষয়ে দৃঢ় বিশ্বাস লাভ করলাম। সেদিন শাফায়াতকারীদের শাফায়াত তাদের কোন কল্যাণ বয়ে আনবে না।” ১৬

৪। মূর্তিদের শাফায়াতের অধিকার প্রত্যাখ্যান

﴿ وَيَعْبُدُونَ مِن دُونِ اللَّـهِ مَا لَا يَضُرُّ‌هُمْ وَلَا يَنفَعُهُمْ وَيَقُولُونَ هَـٰؤُلَاءِ شُفَعَاؤُنَا عِندَ اللَّـهِ ۚ قُلْ أَتُنَبِّئُونَ اللَّـهَ بِمَا لَا يَعْلَمُ فِي السَّمَاوَاتِ وَلَا فِي الْأَرْ‌ضِ ۚ سُبْحَانَهُ وَتَعَالَىٰ عَمَّا يُشْرِ‌كُونَ ﴾

“তারা (মুশরিকরা) আল্লাহর পরিবর্তে এমন কিছুর উপাসনা করে যা তাদের কোন অকল্যাণ ও কল্যাণই করতে পারে ন। তারা বলে এই মূর্তিগুলো আমাদের জন্য আল্লাহর নিকট শাফায়াতকারী,তাদেরকে বল তোমরা কি আল্লাহকে এমন এমন বিষয়ে জানাতে চাও আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে যে বিষয়ে তিনি অবহিত নন। তোমরা যাকে তাঁর শরীক কর তিনি তা হতে পবিত্র ও ঊর্ধ্বে।” ১৭

৫। শাফায়াত কেবল আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট :

﴿قُل لِّلَّـهِ الشَّفَاعَةُ جَمِيعًا لَّهُ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْ‌ضِ ثُمَّ إِلَيْهِ تُرْ‌جَعُونَ﴾ 

“শাফায়াত আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট। তিনিই আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর অধিপতি। অতঃপর তোমরা তার দিকেই প্রত্যাবর্তন করবে।” ১৮

৬। শাফায়াত আল্লাহ ব্যতীত অন্যদের জন্য শর্তাধীন :

﴿مَا مِن شَفِيعٍ إِلَّا مِن بَعْدِ إِذْنِهِ﴾

“তাঁর অনুমতি ব্যতীত কোন শাফায়াতকারী নেই।” ১৯

﴿وَلَا تَنفَعُ الشَّفَاعَةُ عِندَهُ إِلَّا لِمَنْ أَذِنَ لَهُ﴾

“কারো জন্য তার নিকট শাফায়াত তাঁর নিকট ফলপ্রসূ হবে না সেই ব্যক্তির জন্য ব্যতীত যাকে অনুমতি দেয়া হয়েছে।” ২০

উপরিউক্ত আয়াতসমূহকে সমন্বিত করে নিম্নোক্ত ফল পাওয়া যায় : যেহেতু কর্মের ক্ষেত্রে একত্ববাদের নীতির (তাওহীদে আফআলী) ভিত্তিতে বিশ্বে সকল কর্মের প্রকৃত প্রভাবক ও কর্তা হলেন… এবং কোন কর্মই তাঁর ইচ্ছা ও অনুমতি ব্যতিরেকে সম্পন্ন হয় না সেহেতু কোন কোন আয়াতে শাফায়াতকে নিরঙ্কুশভাবে আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট ঘোষিত হয়েছে। কিন্তু এ বিষয়টির সঙ্গে যে সকল আয়াতে তাঁর অনুমতি সাপেক্ষে অন্যদের শাফায়াতের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে কোন বৈপরীত্য নেই। কারণ তিনিই তাঁর অনুমতি সাপেক্ষে বিশেষ শর্তাধীনে অন্যদের তা করার অধিকার দিয়েছেন যেমন নবী ও তাঁর ওলীদের এমনটি দিয়েছেন।

পবিত্র কোরআনে শাফায়াত

কয়েকটি কারণে মানব জাতির জন্য শাফায়াতের অপরিহার্যতা দেখা দেয়।

১। মানব জাতির গুনাহে পতিত হওয়া : কেউ কেউ বলেন,‘কিয়ামত দিবসে মানুষের একমাত্র মুক্তির উপকরণ হলো সৎকর্ম’। যেমন পবিত্র কোরআনে এসেছে :

﴿وَأَمَّا مَنْ آمَنَ وَعَمِلَ صَالِحًا فَلَهُ جَزَاءً الْحُسْنَىٰ ﴾

“এবং যে ব্যক্তি ঈমান আনবে ও সৎকর্ম করবে তার জন্য উত্তম প্রতিদান রয়েছে।” ২১

যদিও সাফল্য,সৌভাগ্য ও প্রতিদান লাভের বিষয়টি সৎকর্মের উপর অনেকটাই নির্ভর করে,কিন্তু অন্যান্য আয়াত হতে বোঝা যায়,শুধু সৎকর্মের মাধ্যমে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয় যদি না মহান আল্লাহর অপরিসীম রহমত তার সঙ্গে যুক্ত না হয়। যেমন,

﴿فَلَوْلَا فَضْلُ اللَّـهِ عَلَيْكُمْ وَرَ‌حْمَتُهُ لَكُنتُم مِّنَ الْخَاسِرِ‌ينَ﴾

“যদি আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমত তোমাদের উপর না থাকত,তবে অবশ্যই তোমরা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হতে।” ২২

﴿وَلَوْ يُؤَاخِذُ اللَّـهُ النَّاسَ بِظُلْمِهِم مَّا تَرَ‌كَ عَلَيْهَا مِن دَابَّةٍ﴾

“যদি আল্লাহ মানব জাতিকে তাদের অন্যায়ের জন্য ধরতেন তবে পৃথিবীর উপর বিচরণশীল কোন প্রাণীকেই ছাড়তেন না।” ২৩

﴿وَلَوْ يُؤَاخِذُ اللَّـهُ النَّاسَ بِمَا كَسَبُوا مَا تَرَ‌كَ عَلَىٰ ظَهْرِ‌هَا مِن دَابَّةٍ﴾

“যদি আল্লাহ মানুষকে তার কৃতকর্মের জন্য পাকড়াও করতেন তবে ভূপৃষ্ঠের উপর চলমান কাউকে ছেড়ে দিতেন না।” 

২। আল্লাহর রহমতের ব্যাপকতা :

﴿رَ‌بَّنَا وَسِعْتَ كُلَّ شَيْءٍ رَّ‌حْمَةً وَعِلْمًا ﴾

অর্থাৎ “হে আমাদের পালনকর্তা!আপনার রহমত ও জ্ঞান সকল কিছুকে পরিবেষ্টন করে আছে।” ২৫

فَإِن كَذَّبُوكَ فَقُل رَّ‌بُّكُمْ ذُو رَ‌حْمَةٍ وَاسِعَةٍ

“যদি তারা তোমার প্রতিপালককে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে,তবে বল তোমাদের প্রভু অসীম রহমতের অধিকারী।” ২৬

শাফায়াত আল্লাহর ওলীদের রহমতের অন্যতম দৃষ্টান্ত।

৩। মানুষের অন্যতম মৌল আকাঙ্ক্ষা হলো মুক্তি। বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তি ও অভিজ্ঞতার আলোকে এটি প্রমাণিত যে,মানুষের অন্যতম মৌল আকাঙ্ক্ষা হলো পৃথিবী ও আখেরাতের শাস্তি হতে মুক্তি লাভ। যেহেতু মানুষের অন্যতম অভ্যন্তরীণ মৌল দিক এটি,সেহেতু মৃত্যুর পর বারজাখ (কবরের জীবন) হতে শুরু করে কিয়ামতের দিবস ও জাহান্নামে (সীমিত সময়ের জন্য) শাস্তি দানের মাধ্যমে তাকে পবিত্র করে তার সত্তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্যই শাফায়াত।

শাফায়াতের প্রভাব

শাফায়াতের প্রভাব ও ফলাফল সম্পর্কে দু’টি দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে

(১) শাফায়াত গুনাহকে মুছে দেয় ও শাস্তিকে লাঘব করে;(২) শাফায়াতের মাধ্যমে পুণ্য বৃদ্ধি পায় ও মর্যাদার উত্তরণ ঘটে। অধিকাংশ মুসলমান প্রথম অর্থে শাফায়াত গ্রহণ করেন। কিন্তু মুতাজিলাগণ দ্বিতীয় অর্থকে স্বীকার করে ও প্রথম অর্থকে গ্রহণযোগ্য মনে করে না। আমাদের মতে প্রথম অর্থ অধিকতর উপযুক্ত। এ যুক্তিতে :

১। শাফায়াতের বিষয়টি ইসলাম পূর্ব ইহুদী ও মুশরিকদের বিশ্বাসের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ইসলাম শাফায়াতের বিষয়ে তাদের মধ্যে প্রচলিত কসংস্কার মূলক বিশ্বাসসমূহকে পরিশুদ্ধ করে সঠিক ধারণাটি ইসলামী সমাজে উপস্থাপন করেন। ইসলাম পূর্ব ইহুদী ও মুশরিকদের শাফায়াত সম্পর্কিত বিশ্বাসের বিষয়ে যাদের ধারণা রয়েছে তারা জানেন যে,তারা যে ধরনের শাফায়াতে বিশ্বাসী ছিল এবং তাদের নবীদের ও পূর্ব পুরুষদের অধিকার বলে জানত,তা তাদের গুনাহসমূহের ক্ষমার জন্যই ছিল। কিন্তু তাদের এ বিশ্বাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে সমস্যা ছিল তা হলো তারা শাফায়াতের অধিকারকে শর্তহীন মনে করত। তাই ইসলাম শাফায়াতের প্রতি বিশ্বাসকে আল্লাহর অনুমতির শর্তাধীন বলে ঘোষণা করে বলে:

﴿مَن ذَا الَّذِي يَشْفَعُ عِندَهُ إِلَّا بِإِذْنِهِ﴾

“কে আছে এমন যে সুপারিশ (শাফায়াত) করবে তাঁর নিকট তাঁর অনুমতি ছাড়া”২৭  এবং

﴿وَلَا يَشْفَعُونَ إِلَّا لِمَنِ ارْ‌تَضَىٰ ﴾

“যার প্রতি তিনি সন্তুষ্ট তার জন্য ব্যতীত অন্য কারো জন্য শাফায়াতকারীরা শাফায়াত করতে পারে না।” (সূরা আম্বিয়া : ২৮)

২। শিয়া ও সুন্নী উভয়সূত্রে বর্ণিত হাদীসসমূহ শাফায়াতের সর্বজনীনতার প্রতিই ইঙ্গিত করে,যেমন মহানবী (সা.) বলেছেন :

اذّخرتُ شفاعتی لأهل الکبائر من امّتی

‘আমার সুপারিশকে আমার উম্মতের কবীরা গুনাহকারীদের জন্য সঞ্চিত রেখেছি।’২৮

৩। কোন কোন আয়াতের ইশারা হতে বোঝা যায় আল্লাহ কোন কোন ক্ষেত্রে তওবা ও ক্ষমা প্রার্থনা ব্যতীতই গুনাহকে ক্ষমা করেন। এই সকল আয়াত গুনাহ মোচনের সাথেই অধিক সংগতিশীল। যেমন আল্লাহ বলেছেন :

﴿وَهُوَ الَّذِي يَقْبَلُ التَّوْبَةَ عَنْ عِبَادِهِ وَيَعْفُو عَنِ السَّيِّئَاتِ﴾

 “তিনি আল্লাহ বান্দাদের তওবাকে গ্রহণ করেন ও গুনাহসমূহকে ক্ষমা করেন।” ২৯

J.S.C