১৯৬২ সালের পাকিস্তান সংবিধানের উপাদান বা বৈশিষ্ট্য কী কী?, ১৯৬২ সালের পাকিস্তান সংবিধানের বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা করুন

১৯৬২ সালের পাকিস্তান সংবিধানের উপাদান বা বৈশিষ্ট্য কী কী?, ১৯৬২ সালের পাকিস্তান সংবিধানের বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা করুন, ১৯৬২ সালের পাকিস্তান সংবিধানের বৈশিষ্ট্য সমূহ


১৯৬২ সালের পাকিস্তান সংবিধানের উপাদান বা বৈশিষ্ট্য কী কী?

সংবিধান হলো যেকোনো রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ দলিল বা আইন। কোনো রাষ্ট্রের শাসন পদ্ধতি কিরূপ তা সংবিধান হতে জানা যায়। তাই সংবিধানকে রাষ্ট্রের প্রতিচ্ছবি বলা হয়। ১৯৬২ সালে প্রণীত পাকিস্তানের সংবিধানও দেশটির তৎকালীন শাসকগোষ্ঠীর বাস্তব রূপায়ণ। এ সংবিধান ছিল পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর কায়েমি স্বার্থ চরিতার্থ করারই হাতিয়ার। ফলে দেশটির গণতান্ত্রিক বিকাশ আরো একবার পর্যুদস্ত হয়। ১৯৬২ সালের সংবিধান জেনারেল
আইয়ুব খানকে পাকিস্তানের লৌহমানবে পরিণত করে।

১৯৬২ সালের পাকিস্তান সংবিধানের বৈশিষ্ট্যসমূহ গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য নিম্নে উল্লেখ করা হলো :

১. লিখিত দলিল : এটা ছিল এক লিখিত দলিল। শাসনব্যবস্থার সকল ধারা এ দলিলে লিপিবদ্ধ ছিল। এ সংবিধান


২. প্রজাতন্ত্রের সংবিধান : এ সংবিধানে পাকিস্তানকে একটি প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সংবিধানের নামকরণ করা হয় ‘পাকিস্তান প্রজাতন্ত্রের সংবিধান’। রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন প্রেসিডেন্ট। মৌলিক গণতন্ত্রের নির্বাচিত সদস্যদের নিয়ে গঠিত নির্বাচকমণ্ডলী কর্তৃক প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতেন।


৩. আইন প্রণয়নের মূলনীতি : পাকিস্তানের এ সংবিধানে কোনো মৌলিক অধিকার সন্নিবেশিত হয় নি। এর পরিবর্তে সংবিধানে ১৬টি আইন প্রণয়নের মূলনীতি লিপিবদ্ধ করা হয়। এগুলোকে নাগরিকদের মৌলিক অধিকাররূপে গ্রহণ করা হয়েছিল।

৪. নীতি নির্ধারক মূলনীতি : ১৯৫৬ সালের সংবিধানের নির্দেশক নীতির ন্যায় ১৯৬২ সালের সংবিধানে ২১টি নীতি নির্ধারক মূলনীতি সন্নিবেশিত হয়। রাষ্ট্রীয় নীতি প্রণয়নে এ নীতিগুলো অনুসৃত হতো, তবে এদের কোনো আইনগত বৈধতা স্বীকৃত হয় নি।

১৯৬২ সালের পাকিস্তান সংবিধানের বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা করুন

৫. ইসলামি আদর্শ : ১৯৬২ সালের পাকিস্তান সংবিধানে ইসলামি নীতির উপর রাষ্ট্রকে প্রতিষ্ঠিত করার প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয়। ইসলামি ব্যবস্থাসমূহ এ সংবিধানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এ সংবিধানে একটি ইসলামি আদর্শ-সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ গঠনের ব্যবস্থা করা হয়।

৬. যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা : এ সংবিধানে যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার প্রবর্তিত হয়। পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান এই
দুই প্রদেশের সমন্বয়ে পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্র গঠিত হয়। প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় এ দুই প্রকার সরকার গঠিত হয়। এ সংবিধানের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকার ও প্রাদেশিক সরকারের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টন সম্পন্ন হয়।

৭. গণভোটের ব্যবস্থা : ১৯৬২ সালের সংবিধানে গণভোট পদ্ধতির প্রবর্তন করা হয়। এটাই এ সংবিধানের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। প্রেসিডেন্ট ও জাতীয় পরিষদের মধ্যে কোনো সময় কোনো বিষয়ে মতানৈক্য দেখা দিলে বিষয়টিকে গণভোটে পেশ করার ব্যবস্থা করা হয়েছিল এবং গণভোটের ফলাফল উভয়ে মেনে নিতে বাধ্য থাকতেন।

৮. মৌলিক গণতন্ত্র : এ সংবিধানে অসম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। মৌলিক গণতন্ত্রে জাতি ধর্ম-নির্বিশেষে প্রাপ্তবয়স্ক সকল নাগরিক ভোটাধিকার লাভ করে। নির্বাচিত মৌলিক গণতন্ত্রী দ্বারা গঠিত ‘নির্বাচকমণ্ডলী কর্তৃক প্রেসিডেন্ট, জাতীয় পরিষদের সদস্য এবং প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হতেন।

৯.সুপরিবর্তনীয় সংবিধান: ১৯৬২ সালের পাকিস্তান সংবিধান ছিল সুপরিবর্তনীয়। তবে এর সংশোধনের জন্য এক বিশেষ পদ্ধতির প্রয়োজন ছিল। কোনো সংশোধনী প্রস্তাব যদি জাতীয় পরিষদে দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য কর্তৃক গৃহীত হতো, তবেই তা প্রেসিডেন্টের সম্মতি লাভ করে সংশোধিত হতো। প্রেসিডেন্ট অবশ্য উক্ত প্রস্তাবে ভেটো দিতে পারতেন।

১০. কেন্দ্রীয় তালিকা প্রণয়ন: ছাএ সংবিধানে শাসন সংক্রান্ত বিষয়ের একটি তালিকা প্রণয়ন করা হয়। সংবিধানের তৃতীয় তালিকায় আইন প্রণয়ন সম্পর্কে কেন্দ্রীয় সরকারের আওতাভুক্ত এবং জাতীয় স্বার্থ সম্পর্কিত ৪৯টি বিষয়ের উল্লেখ করা হয়, যা কেন্দ্রীয় তালিকারূপে পরিগণিত হয়।

১৯৬২ সালের পাকিস্তান সংবিধানের বৈশিষ্ট্য সমূহ

১১. বিচার বিভাগের স্বাধীনতা: এ সংবিধানে বিচার বিভাগকে শাসন বিভাগ হতে স্বতন্ত্র এবং স্বাধীন করার ব্যবস্থা করা হয়। তাছাড়াও সংবিধানে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষারও যথাযথ ব্যবস্থা গৃহীত হয়।

১২. এলাকা হবে জাতীয়: জাতীয় ও কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধান কেন্দ্র – এ পরিষদের প্রধান কেন্দ্র এবং ইসলামাবাদ রাজধানী এলাকা হবে কেন্দ্রীয় সংবিধানে ঘোষণা করা হয় যে, ঢাকা রাজধানী সরকারের প্রধান কেন্দ্র।

১ ৩. রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার : ১৯৬২ সালে প্রণীত পাকিস্তান সংবিধানে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার। প্রেসিডেন্ট মৌলিক গণতন্ত্রের নির্বাচিত সদস্যের দ্বারা গঠিত ‘নির্বাচকমণ্ডলী’ কর্তৃক পাঁচ বছরের
জন্য নির্বাচিত হতেন। প্রেসিডেন্টই ছিলেন প্রকৃত শাসক। অভিশংসন ব্যতীত তিনি অন্য কোনোভাবে পদচ্যুত হতেন না।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, স্বাধীনতা অর্জনের সুদীর্ঘ ৯ বছর পর ১৯৫৬ সালে প্রণীত পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান মাত্র ২ বছরের মধ্যে সামরিক জান্তার কবলে পড়ে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলে পাকিস্তানের রাজনৈতিক আকাশে কালোমেঘের ঘনঘটা দেখা দেয়। ১৯৬২ সালের প্রণীত সংবিধানের মাধ্যমে রাজনৈতিক উন্নয়নের একটা উদ্যোগ নেওয়া হয় সত্য, কিন্তু তা কোনো সুফল বয়ে আনতে পারে নি। এ সংবিধান প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের হাতে ক্ষমতা এতটাই কেন্দ্রীভূত করে যে, পাকিস্তান নামটিই প্রেসিডেন্টের নামের সঙ্গে উচ্চারিত হতে থাকে। তাই অনেকেই ব্যঙ্গ করে ১৯৬২ সালের পাকিস্তানের সংবিধানকে আইয়ুবের সংবিধান হিসেবেও অভিহিত করে থাকেন।

Leave a Comment