১৯০৬ সালে কেন মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা হয়েছিল?, মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আলোচনা কর।

Advertisement

১৯০৬ সালে কেন মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা হয়েছিল?, মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আলোচনা কর।


ভূমিকা ঃ ভারতে ব্রিটিশ শাসনকে মুসলমানরা কখনও মনেপ্রাণে গ্রহণ করতে পারেন নি। অন্যদিকে এ সুযোগ গ্রহণ করে হিন্দু সমাজ নিজেদের স্বার্থে, ব্রিটিশ শাসনকে স্বাগত জানান। ফলে হিন্দুরা সকল ক্ষেত্রে স্থান করে নিতে সক্ষম হন।

একপর্যায়ে হিন্দু সংগঠন বলে খ্যাত কংগ্রেস হিন্দু নেতাদের প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠা করা হয়। ফলে হিন্দুদের আরো সুবিধা হয়। যদিও কংগ্রেসকে একেবারে হিন্দু সংগঠন বলা যায় না। তবে কংগ্রেসে দ্বিতীয় পর্যায়ের উগ্রপন্থি নেতাদের আচরণের ফলে মুসলমানরা অতিষ্ঠ হন এবং একপর্যায়ে নিজেদের দাবি আদায়ের জন্য একটি পৃথক সংগঠনের কথা ভাবেন। এর ফলে ১৯০৬ সালে ৩০ ডিসেম্বর সর্ব ভারতীয় মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়।


মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট : ভারতে ব্রিটিশ শাসনের শুরু থেকে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে বিরাট পার্থক্যের একটা দেয়াল লক্ষ করা যায়। আর এ দেয়ালের জন্য একপর্যায়ে মুসলমানরা কংগ্রেস ত্যাগ করে পৃথক একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করার জন্য তৎপর হন।

তবে এজন্য দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত শোষণ দায়ী থাকলেও আরও অনেক কারণ দায়ী ছিল। যথা :


১. রাজনৈতিক কারণ ঃ ভারতে ব্রিটিশ শাসনামলের শুরু থেকে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি হয়। ফলে ধর্মীয় ভিন্নতা সকল ক্ষেত্রে ব্যবধান রচনা করে। ব্রিটিশ শাসনকে হিন্দুরা প্রথম দিকে স্বাগত জানান এবং নিজেরা ইংরেজি শিক্ষাসংস্কৃতি রপ্ত করে নিজেদের সামাজিক অবস্থান মজবুত করে নেন। কিন্তু মুসলমানরা প্রথম থেকে ইংরেজদের সাথে সকল সংশ্রব বর্জন করেন। ফলে সকল ক্ষেত্রে তারা পিছিয়ে পড়েন। এভাবে দু’শ্রেণীর মধ্যে রাজনৈতিক ব্যবধান রচিত হয়। ব্রিটিশ শাসনের সুফলকে কাজে লাগিয়ে হিন্দু নেতারা ধর্মীয় জাতীয়তার ভিত্তিতে হিন্দুদের রাজনৈতিক জাতীয়তার পত্তন করেন। এ সময় অনেক হিন্দু কবি বিশেষত ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, হেমচন্দ্র, নবীন চন্দ্র সেন, রঙ্গলাল বন্দোপাধ্যায়, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রাজনারায়ণ বসু, ননী গোপাল মিত্র প্রমুখ National পত্রিকার মাধ্যমে হিন্দু জাতীয়তাবাদের আদর্শ প্রচার করেন। হিন্দুদের শিক্ষার উন্নতির জন্য কলকাতায় হিন্দু কলেজ ও অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মুসলমানদের শিক্ষা গ্রহণের কোন সুযোগ ছিল না। এছাড়া হিন্দুদের স্বার্থরক্ষার্থে কিছু সমিতিও গড়ে উঠে যথা : Land Holders society, Bengal British India society, British India association ইত্যাদি। এসব সমিতি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করে হিন্দুরা নিজেদের উন্নত করে নেন। ফলে মুসলমানরা এর থেকে পরিত্রাণের পথ খুঁজতে থাকেন, যা ১৯০৬ সালের মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার প্রেরণা যোগায় ।


২. সামাজিক কারণ : সামাজিক মর্যাদাবোধ বিষয়ে আলোচনা করলে দেখা যায় যে, ব্রিটিশ শাসনকে মনে প্রাণে নিজ স্বার্থ হাসিল করার স্বার্থে গ্রহণ করে হিন্দুরা সামাজিক ক্ষেত্রে নিজেদের অবস্থান করে নেন। অন্যদিকে মুসলমানরা এ পদ্ধতি অবলম্বন না করায় সকল ক্ষেত্রে তথা সামাজিক ক্ষেত্রে পিছিয়ে যান। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের পর হতে মুসলমানদের মধ্যে আধুনিকতার আদর্শের ভিত্তিতে সামাজিক সংস্কারের ক্ষেত্রে কিছুটা সামাজিক কাজের প্রেরণা পান। মুসলমান সমাজকে আধুনিকতার সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য ১৮৬৩ সালে কলকাতায় নওয়াব আব্দুল লতিফ ‘মুসলমান শিক্ষা বিষয়ক সমিতি’ এবং ১৮৭৭ সালে সৈয়দ আমীর আলী কর্তৃক ‘সেন্ট্রাল মোহামেডান এসোসিয়েশন’ গঠিত হয়। এ সমিতিগুলোতে আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সামাজিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিষয় আলোচনার ব্যবস্থা করা হয় এবং উচ্চ ও মধ্যবিত্ত মুসলমান শ্রেণীকে সমাজে টিকে থাকার জন্য পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণে উৎসাহ দেওয়া হয়। ফলে মুসলমানরা সামাজিক ক্ষেত্রে কিছুটা অগ্রসর হন এবং আরো অগ্রসর হওয়ার জন্য একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠার কথা ভাবেন।


৩. অর্থনৈতিক কারণ : ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের শুরু থেকে দেখা যায়, এক প্রকার অর্থনৈতিক বৈষম্য সৃষ্টি হয়। ব্রিটিশ সরকারের প্রথমাবস্থায় প্রবর্তিত দ্বৈত শাসনব্যবস্থা বাংলার জনসাধারণের জন্য দুঃখ বয়ে আনে। এ ব্যবস্থার মাধ্যমে বাংলার জনসাধারণকে সর্বস্বান্ত করা হয়। দেখা যায়, ব্যবসায় বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এ ছিল এক প্রকারের শোষণ। কলকাতার হিন্দু ব্যবসায়ীরা ব্রিটিশ শাসনকে স্বাগত জানিয়ে ব্যবসায়িক ভিত্তিকে মজবুত করেন। ফলে দেখা যায়, একপর্যায়ে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে আর্থিক ক্ষেত্রে বিরাট ব্যবধান রচিত হয়। কারণ, বড় বড় ব্যবসায়ী, সরকারি চাকরিজীবী বেশির ভাগই ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্য থেকে। মুসলমানরা ছিলেন মূলত অবহেলিত। তাই এ ধরনের অবস্থা থেকে পরিত্রাণ ছিল আবশ্যক। অন্যদিকে ব্রিটিশ সরকারের প্রবর্তিত পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রতি অনীহাও মুসলমানদেরকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত করেছিল। তাই এ অবস্থার উত্তরণের জন্য সংগঠনের যে প্রয়োজন ছিল তা মুসলমান সমাজের নীতি নির্ধারকরা বুঝতে পারেন ।

Advertisement


৪. ধর্মীয় কারণ : ব্রিটিশ শাসনের মাধ্যমে ভারতে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে বিশাল একটা দেয়ালের সৃষ্টি হয়। হিন্দুরা ব্রিটিশদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করায় উত্তরোত্তর উন্নতির শীর্ষে পৌঁছে যায় এবং মুসলমানরা তা থেকে পিছিয়ে পড়েন। ফলে উভয়ের মধ্যে অবজ্ঞা ও বিদ্বেষের বীজ অঙ্কুরিত হয়। ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র তার লেখায় সন্ন্যাসীর মাধ্যমে বলেছেন, “আমরা রাজ্য চাহি না, কেবল মুসলমানরা ভগবানে বিশ্বাসী নয় বলে তাদের সবংশ নিপাত করতে চাহি।” রাজা রামমোহন রায়ের ধর্ম সংস্কার, স্বামী দয়ানন্দের আর্য সমাজ, গোরক্ষিণী সমিতি, হিন্দু মেলা, শিবাজী উৎসব ইত্যাদির মাধ্যমে ধর্মীয় পুনরুজ্জীবনকে কেন্দ্র করে স্বতন্ত্র হিন্দু জাতীয়তাবাদের ভিত্তি রচিত হয়। ফলে মুসলমানরা তাদের ধর্মীয় কৃষ্টি ও স্বাতন্ত্র্য রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ হতে থাকেন। কারণ, H. V. Hudson এর ভাষায় “মুসলমানদের আচার প্রথা অনেক সময় প্রতিবেশী হিন্দুর কাছে অসহ্য আবার হিন্দুদের কিছু আচার প্রথা মুসলমানদের কাছে অসহনীয় ছিল।”


৫. সৈয়দ আহমদ খানের আলীগড় আন্দোলন : ভারতে মুসলমান সম্প্রদায়ের অবস্থার উন্নয়নের জন্য প্রথম আশার আলো নিয়ে অগ্রসর হন মুসলিম জাগরণের অগ্রদূত সৈয়দ আহমদ খান। তিনি উপলব্ধি করেন যে, মুসলমানদের অনগ্রসরতার প্রধান কারণ হল ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাব ও অসহযোগিতা। তাই তিনি এ অবস্থার অবসান করার জন্য চেষ্টা করেন। তিনি মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে পাশ্চাত্য শিক্ষা ও পাশ্চাত্য ভাবধারা প্রসারের লক্ষ্যে ১৮৭৭ সালে অক্সফোর্ড ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুকরণে আলীগড়ে এ্যাংলো ওরিয়েন্টাল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। মুসলমান ছাত্রদের মধ্যে প্রগতিমূলক মনোভাবের উন্মেষ ঘটাতে এ কলেজের অবদান ছিল অপরিসীম। প্রথম দিকে সৈয়দ আহমদ রাজনীতির ক্ষেত্রে হিন্দুদের সাথে সহযোগিতার নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু ১৮৮০ দশকে তিনি প্রচার করতে থাকেন যে, মুসলমানরা একটি আলাদা জাতি এবং হিন্দু ও মুসলমানদের রাজনৈতিক স্বার্থও এক নয় বরং পরস্পর বিরোধী। তাই ১৮৮৫ সালে কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা হলে তিনি মুসলমানদেরকে কংগ্রেস থেকে দূরে থাকার আহ্বান জানান। তিনি মনে করতেন, ভারতে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হলে সংখ্যাগুরু হিন্দুদের শাসন মুসলমানদের উপর স্থাপিত হবে। তাই এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য মুসলমানদের সংগঠিত হওয়া প্রয়োজন ছিল।


৬. কংগ্রেসের বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন : বঙ্গভঙ্গ ছিল ভারতের জন্য একটি বহুল আলোচিত ঘটনা। পূর্ব বাংলার মুসলমান সমাজ বঙ্গভঙ্গকে একটা বিজয় বলে মনে করেন। অন্যদিকে ভারতের হিন্দু জাতীয়তাবাদী নেতারা বঙ্গভঙ্গকে বঙ্গ মাতার অঙ্গচ্ছেদ বলে প্রচারণা চালিয়ে জনমত গঠনের চেষ্টা করেন। তারা প্রচার চালান যে, এটা ছিল হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার বীজ ছড়িয়ে দিয়ে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদকে ধ্বংস করার চক্রান্ত। তাই তারা বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন জোরালোভাবে গড়ে তোলেন। কংগ্রেস মডারেট নেতারাও তা সমর্থন করেন। তারা একপর্যায়ে স্বদেশী আন্দোলনের ডাক দেন। স্বদেশী আন্দোলন একপর্যায়ে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনে পরিণত হয়। ফলে একপর্যায়ে ব্রিটিশ সরকার আন্দোলনে ভীত হয়ে বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করেন। হিন্দু সম্প্রদায়ের কংগ্রেসের নেতৃত্বে এ বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনকে মুসলমানরা মেনে নিতে পারেন নি ।

Advertisement 2


৭. সিমলা ডেপুটেশন : ভারতে যখন একদিকে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন তখন ভারতে মুসলমানরা নিজেদের অধিকার নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েন। ইতোমধ্যে ১৮৯২ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ভারতীয় কাউন্সিল আইন পাস হয় এবং এ আইনে পরোক্ষ নির্বাচন নীতি ঘোষিত হয়। এছাড়া ১৯০৬ সালে ভারত সবিচ লর্ড মর্লি ভারতে আসন্ন শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের কথা বলেন। এতে মুসলিম নেতারা শঙ্কিত হয়ে পড়েন এই ভেবে যে, ভারতে নির্বাচনের মাধ্যমে আইনসভা গঠিত হলে হিন্দুরাই সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করবেন। ফলে নতুন শাসনতন্ত্রে মুসলমান নেতারা স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য বড়লাট লর্ড মিন্টোর কাছে আগা খানের নেতৃত্বে এক উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। এ প্রতিনিধি দল সিমলায় বড়লাটের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং মুসলমানদের জন্য পৃথক নির্বাচনের দাবি করেন। মুসলমানদের পৃথক নির্বাচনের দাবির প্রতি লর্ড/লেডি মিন্টো আশ্বাস দেন। এছাড়া তিনি বলেছেন যে, পৃথক সম্প্রদায় হিসেবে মুসলমানদের রাজনৈতিক অধিকার ও স্বার্থ রক্ষা করা হবে। সিমলায় পরে মুসলমান নেতারা এক ঘরোয়া বৈঠকে মিলিত হন। সিমলা বৈঠকের সফলতা উপলব্ধি করে মুসলমান নেতারা আনন্দে উদ্বেলিত হন এবং মুসলমানদের রাজনৈতিক স্বার্থ প্রতিষ্ঠার জন্য একটি রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠার সংকল্প করেন। আর এ সংকল্পের ফল হল সর্ব ভারতীয় মুসলিম লীগ ।


৮. মুসলিম লীগ গঠন : সিমলার বৈঠকের খসড়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মুসলমান প্রতিনিধিরা ১৯০৬ সালে ৩০ ডিসেম্বর ঢাকায় সুর্ব ভারতীয় মুসলিম শিক্ষা সম্মেলনের (All India Muslim Education Conference) অধিবেশন আহ্বান করেন। ভারতের সকল অংশ থেকে মুসলমানরা এ অধিবেশনে যোগ দেন। এ অধিবেসনে শাহবাগে নবাব সলিমুল্লাহর বাগান বাড়িতে নবাব ভিখারুলমূলক এর সভাপতিত্বে একটি রাজনৈতিক সভা অনুষ্ঠিত হয়। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগত মুসলমান প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে নবাব সলিমুল্লাহ সর্বভারতীয় মুসলিম সংঘ নামে একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গঠনের প্রস্তাব করেন। প্রস্তাবটি সভায় সর্ব সম্মতিক্রমে গৃহীত হয় এবং ঐদিনই ১৯০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর ঢাকায় সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ গঠিত হয়।


মুসলিম লীগের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য : ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ গঠন করার পর নবাব মুহসিন-উল-মূলক নবাব ভিখারুল মূলক এ সংস্থার যুগ্ম সম্পাদক হন। গঠনতন্ত্র প্রণয়নের জন্য ৬০ জন সদস্য বিশিষ্ট একটি কার্যনির্বাহী কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটির কোন কোন সদস্যের অপছন্দের কারণে সংঘ শব্দটি বাদ দিয়ে All India Muslim league কর হয়। এতে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনকে নিন্দা করা হয় এবং সদর দপ্তর স্থাপন করা হয় লক্ষ্ণৌতে। ১৯০৮ সালে আলীগড় অধিবেসনে মুসলিম লীগের গঠনতন্ত্র অনুমোদন করা হয়। একই বছরে সৈয়দ আমীর আলীর সভাপতিত্বে এর শাখা গঠিত হয়। ১৯১৩ সালে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ মুসলিম লীগের অধিবেসনে যোগদান করেন।

১৯০৬ সালে মুসলিম লীগের যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের কথা বলা হয় তা ছিল নিম্নরূপ ঃ


১. ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ : ১৯০৬ সালের মুসলিম লীগের অধিবেসনে ব্রিটিশ সরকারের প্রতি ভারতীয় মুসলমানদের আনুগত্য সুনিশ্চিত করার ব্যবস্থা করা হয় এবং সরকারের কোন ব্যবস্থা সম্পর্কে মুসলমানদের মধ্যে ভুল ধারণা জন্মিলে তা দূর করার ব্যবস্থা করা হয়। কারণ, তারা মত প্রকাশ করেন যে, সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ না করলে নিজেদের দাবি আদায় করা সহজ হবে না।


২. মুসলমানদের অধিকার ও স্বার্থ রক্ষা ও ১৯০৬ সালে গঠিত মুসলিম লীগের অধিবেসনে মুসলমানদের রাজনৈতিক অধিকার ও স্বার্থ রক্ষা করা এবং তাদের দাবিদাওয়াসমূহ সরকারের কাছে উপস্থাপন করার ব্যবস্থা করা হয় । ৩. ধর্মীয় স্বাধীনতা বজায় : মুসলিম লীগের লক্ষ্য উদ্দেশ্য ঘোষণার সময় অন্য সম্প্রদায়ের প্রতি যাতে মুসলমানদের বিদ্বেষ না দেখা দেয়, তার ব্যবস্থা করা হবে বলে বলা হয়।

এগুলো ছাড়া মুসলিম লীগের লক্ষ্যে আরো বলা হয় যে, মুসলমানদের জন্য পৃথক নির্বাচনের দাবি, হাইকোর্ট ও অন্যান্য আদালতে মুসলমান বিচারপতি নিয়োগ, সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে মুসলমানদের সংখ্যানুপাতে নিয়োগ, বঙ্গভঙ্গ রদ না করা প্রভৃতি।
মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার ফলাফল : মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার ফলাফল ছিল সুদূর প্রসারী।

ব্রিটিশ সরকারের Divide and Rule নীতির ফলে মুসলিম লীগ একটি শক্তিশালী দলে পরিণত হয়। ক্রমে এ সংগঠনে মুসলিম সম্ভ্রান্ত ও অভিজাত শ্রেণীর পাশাপাশি মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকে আগত নেতৃবৃন্দের আবির্ভাব ঘটে। যখন মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এ রাজনৈতিক সংগঠনে যোগ দেন তখন মুসলিম লীগ একটি জনপ্রিয় ও শক্তিশালী দলে পরিণত হয়। এ মুসলিম লীগ পরবর্তীতে মুসলমানদের স্বার্থ সংরক্ষণে বিভিন্ন পরিকল্পনার মাধ্যমে দাবি আদায়ের চেষ্টা করেন।

যথা : ১৯২৯ সালে জিন্নাহর ১৪ দফা, ১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাব ও দ্বিজাতিতত্ত্ব ইত্যাদি। আর এসবের প্রেক্ষিতে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়। সুতরাং বলা যায়, ১৯০৬ সালের মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত যে শোষণ ও অত্যাচার তা কিছুটা হলেও কমে এসেছিল বলা যায়।


উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার আলোকে বলা যায় যে, ভারতে ব্রিটিশ সরকারের কাছে দাবিদাওয়া পেশ করার জন্য যেমন ১৮৮৫ সালে সর্ব ভারতীয় কংগ্রেস গঠিত হয়। ফলে ভারতীয় জনসাধারণ কিছুটা হলেও তাদের প্রতিবাদের ভাষা খুঁজে পান। অন্যদিকে কংগ্রেস যখন নিরপেক্ষ চরিত্র বজায় রাখতে ব্যর্থ হয় তখন কংগ্রেস গঠনের শিক্ষা থেকেই মুসলমানরা আলাদা জাতি হিসেবে টিকে থাকার জন্য, দাবি আদায়ের জন্য ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ গঠন করার প্রেরণা পান। তাই মুসলমান নেতারা মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার জন্য সচেষ্ট হন। একপর্যায়ে ১৯০৬ সালে সর্বভারতীয় মুসলিম শিক্ষা সম্মেলনে All India Muslim liague গঠিত হয়। ফলে বাংলার মুসলমানরা প্রতিবাদের ভাষা প্রকাশের মাধ্যম খুঁজে পান।

Advertisement 5

Advertisement 2

Advertisement 3

Leave a Comment