১৮৮৫ সালে কংগ্রেস প্রতিষ্ঠায় কার অবদান সবচেয়ে বেশি?,১৮৮৫ সালে কংগ্রেস প্রাথমিক অবস্থায় কংগ্রেসের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কি ছিল?

১৮৮৫ সালে কংগ্রেস প্রতিষ্ঠায় কার অবদান সবচেয়ে বেশি?,১৮৮৫ সালে কংগ্রেস প্রাথমিক অবস্থায় কংগ্রেসের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কি ছিল?,১৮৮৫ সালের কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট, ১৮৮৫ সাল হতে ১৯০৫ সাল পর্যন্ত কংগ্রেসের সাফল্য ও সীমাবদ্ধতা ব্যাখ্যা কর

ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের প্রথম পর্যায় থেকে ভারতীয়রা বিভিন্ন দাবিতে আন্দোলন করে। ব্রিটিশ সরকারও ভারতীয় জনসাধারণকে দমিয়ে রাখার জন্য একের পর এক আইন পাস করেন। কিন্তু এতে দেখা যায়, ভারতবাসীর আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হচ্ছে না; শুধু উলুবনে মুক্তা ছড়ানো হচ্ছে মাত্র। তাই ভারতীয় নেতারা নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে আন্দোলন করা ছাড়া সফল হওয়া যাবে না বলে মতামত ব্যক্ত করেন এবং একপর্যায়ে অবসরপ্রাপ্ত ব্রিটিশ সিভিলিয়ান আল্যান অকটাভিয়ান হিউম ও লর্ড ডাফরিনের যৌথ প্রচেষ্টার ফসল হিসেবে সর্বভারতীয় কংগ্রেস (All India Congress) প্রতিষ্ঠা করেন।


কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতা : জাতীয় কংগ্রেসের উদ্ভব ও প্রতিষ্ঠাতা সম্পর্কে বিভিন্ন মতামত প্রচলিত আছে। বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী জাতীয় ইতিহাস প্রণেতা ডঃ পটভী সীতারামাইয়া এ মত পোষণ করেন যে, অবসরপ্রাপ্ত সিভিলিয়ান অ্যালান অকটাভিয়ান হিউম ও বড়লাট ডাফরিনের আনুকূল্যে কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা হয়। অন্যদিকে, জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম সভাপতি উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় এ মত পোষণ করেন যে, জাতীয় কংগ্রেসের উদ্ভবে বড়লাট ডাফরিনের মুখ্য ভূমিকা ছিল। কারণ, হিউম প্রথমে সামাজিক সংস্কার সম্পর্কে আলোচনা করার জন্য একটি সর্বভারতীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার উপর জোর দেন এবং হিউম ডাফরিনের প্রস্তাব অনুসারে জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা করেন। অপরদিকে, ডাফরিনের চিঠিপত্র ও বিভিন্ন মন্তব্য থেকে সুস্পষ্টভাবে দেখা যায় যে, তাঁর সাথে হিউমের সম্পর্ক মধুর ছিল না, উপরন্তু ডাফরিন হিউমের রাজনৈতিক চিন্তাচেতনার কঠোর সমালোচনাও করেন। এছাড়া প্রথম থেকে ডাফরিন কংগ্রেসকে সন্দেহের চোখে দেখতেন। বোম্বাইয়ের গভর্নরকে লেখা চিঠিতে (১৭ মে ১৮৮৫) দেখা যায় যে, হিউম কংগ্রেস গঠনের পরিকল্পনা নিয়ে যোগাযোগ করেছিলেন সত্য কিন্তু কংগ্রেসের যৌক্তিকতা সম্পর্কে ডাফরিনের ঘোরতর সন্দেহ ছিল। সুতরাং, ডাফরিনকে জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতা বলা যুক্তিযুক্ত নয়। বরং হিউমকে কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে গণ্য করা হয়।


কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পটভূমি : ১৮৮৫ সালে কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হলেও অনেক আগে থেকে তা প্রতিষ্ঠা করার জন্য সমাজের সকল সচেতন মহলে আলোচনা হয়। নিম্নে যে অবস্থার প্রেক্ষাপটে কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হয় তা আলোচনা করা হলঃ


১. শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রেরণা : যদিও কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৮৫ সালে তারপরও ঊনবিংশ শতকের সত্তর দশক থেকেই একটি সর্বভারতীয় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গঠনের তোড়জোড় শুরু হয়। এ সময় ভারতে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত এক শ্রেণির মধ্যবিত্তের উত্থান হয়। যে মধ্যবিত্ত শ্রেণি রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করে। তারা ভারতে প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার বা স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার পক্ষে রয়েছেন। কিন্তু এ ধরনের ব্যবস্থাকে কার্যকরী করার জন্য যে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের দরকার তা ভারতে ছিল না। তাই মধ্যবিত্ত শ্রেণির রাজনৈতিক সচেতনতা থেকে ‘ইন্ডিয়া লীগ’ নামে একটি রাজনৈতিক সংস্থা গঠিত হয়। তবে এ সংস্থা পুরোপুরি সফল হতে পারে নি।


২. I. C. S. পরীক্ষার নিয়ম পরিবর্তনের জন্য আন্দোলন : কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার দিকে রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ভারতীয়দের স্বার্থরক্ষা এবং ভারতীয় জাতীয়তাবাদের বিকাশ সাধনে ‘ভারতসভা’ নামে একটি সংস্থা গঠন করেন। সুরেন্দ্রনাথের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে ভারতসভা ভারতীয় I. C. S. পরীক্ষা সম্পর্কে ব্রিটিশ সরকারের নীতির ঘোরতর বিরোধিতা করে। এতে ব্রিটিশ সরকারের নির্ধারিত বয়ঃসীমা ২১ থেকে কমিয়ে ১৯ বৎসর করার যে চক্রান্ত তার কঠোর সমালোচনা “ভারতসভা’র মাধ্যমে করা হয়। ফলে আন্দোলনের চাপে ব্রিটিশ সরকার বাধ্য হয় পূর্বের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নিতে।


3. Vernacular Press Act ও Arms Act পাসের প্রতিবাদ : ব্রিটিশ সরকারের প্রতিক্রিয়াশীল নীতির জন্য জাতীয় আন্দোলন দ্রুতগতিতে অগ্রসর হয়। এছাড়া গণ অসন্তোষও দেখা দেয়। কারণ, ১৮৭৮ সালে লর্ড লিটন দেশীয় ভাষায় প্রকাশিত সংবাদপত্রকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য Vernacular Press Act পাস করেন। এটি ছিল ভারতবাসীর জন্য সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী। এছাড়া ব্রিটিশ সরকার Arms Act পাস করেন, যার কোন দরকার ছিল না। তাই এ ধরনের আইন পাস হলে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় উঠে। আর প্রতিবাদ করার জন্য যে মাধ্যম /সংগঠন দরকার তা শিক্ষিত ভারতবাসী বুঝতে পারেন ।


৪. ব্রিটিশ ও ভারতীয়দের মধ্যে বৈষম্যের অবসান : ১৮৮৫ সালের কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার সমকালীন সময়ে ব্রিটিশ সরকারের নীতির কারণে জাতিগত বৈষম্য চরম আকার ধারণ করেছিল। এ বৈষম্যমূলক নীতির কারণে ইংরেজ ও ভারতীয়দের মধ্যে সম্পর্কেরও অবনতি হয়। ১৮৮৩ সাল ইলবার্ট বিলকে কেন্দ্র করে ব্রিটিশ সরকারের আচরণ ভারতীয় জনসাধারণের কাছে পরিষ্কার হয়। এ বিলের মাধ্যমে ভারতবাসীর যে আন্দোলন তা ছিল বিচার করার ক্ষেত্রে যে বৈষম্য তার অবসান করার। একপর্যায়ে লর্ড ইলবার্টের নেতৃত্বে একটি আইন প্রণয়ন করা হলেও ইউরোপীয় নেতাদের চাপে তা আবার সংশোধন করা হয়। তাই এ কার্যকলাপের ফলে ব্রিটিশ সরকারের প্রতি ভারতীয়রা আস্থা হারিয়ে ফেলেন। এসব ঘটনাবলির মাধ্যমে তারা একটি স্থায়ী সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, স্থায়ী কোন সংগঠন ছাড়া ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে সফল হওয়া যাবে না। ফলে তারা একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠার জন্য জোর তৎপরতা চালান।


৫. প্রথম জাতীয় সম্মেলনের আহ্বান/সিদ্ধান্ত : ১৮৮৩ সালে কলকাতায় সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এক আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। ভারতের বিভিন্ন স্থান থেকে বহু বিশিষ্ট নেতা এ প্রদর্শনী উপলক্ষ্যে কলকাতায় জমায়েত হন। এ সময় কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়ে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতায় এক জাতীয় সম্মেলন আহ্বান করেন। ভারতের বিভিন্ন অংশ থেকে শতাধিক প্রতিনিধি এ সম্মেলনে যোগ দেন। এ সভায় শিল্প ও কারিগরি শিক্ষা, বৃহত্তর কর্মসংস্থান, বিচারব্যবস্থার পৃথকীকরণ ও প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার গঠন বিষয়ে আলোচনা হয়। এ সম্মেলন একপর্যায়ে সফল হয়। এ সম্মেলন সফল হলে ভারতীয়রা একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠার জন্য তৎপর হয়।


৬. দ্বিতীয় জাতীয় সম্মেলনের সিদ্ধান্ত : ১৮৮৩ সালের প্রথম জাতীয় সম্মেলন সফল হলে ১৮৮৫ সালে ডিসেম্বর মাসে কলকাতায় জাতীয় সম্মেলনের দ্বিতীয় অধিবেশন আহ্বান করা হয়। এ সভায় আলোচ্যবিষয় ছিল সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার সংস্কার, একযোগে ইংল্যান্ড ও ভারতে পরীক্ষা গ্রহণ, অস্ত্র আইন রহিতকরণ, বিচার ও শাসন বিভাগের পৃথকীকরণ, সামরিক ও সাধারণ প্রশাসন বিভাগের ব্যয়ভার কমানো ইত্যাদি। এসব বিষয়ে আলোচনার অন্তরালে কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার জন্য ভারতীয় নেতারা চেষ্টা চালান। যার জন্য দেখা যায়, একপর্যায়ে কংগ্রেস গঠন করার মনোভাব নিয়ে ১৮৮৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর দ্বিতীয় অধিবেশন সমাপ্ত হয়।


৭. হিউমের প্রচেষ্টা ও কংগ্রেস গঠন : ভারতের কংগ্রেস গঠন করার ক্ষেত্রে বড় অবদান রাখেন অবসরপ্রাপ্ত ব্রিটিশ সিভিলিয়ান অ্যালান অকটাভিয়ান হিউম। তিনি ভারতীয়দের বিভিন্ন দাবিদাওয়ার কথা অবলোকন করে ভারতীয়দের স্বার্থে নিজেকে জড়িত করেন। তাই তিনি অবস্থা বুঝে ভারতীয়দের অসন্তোষ প্রশমিত করার জন্য চেষ্টা করেন। একপর্যায়ে ১৮৮৩ সালে ১ মার্চ তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকদের উদ্দেশ্যে একটি খোলা চিঠিতে তাদের রাজনৈতিক, সামাজিক, মানসিক ও নৈতিক উৎকর্ষ লাভের জন্য একটি স্থায়ী সংগঠন গঠনের উপদেশ দেন। অনুকূল মনোভাব দেখান। এর প্রমাণ পাওয়া যায় ১৮৮৪ সালে হিউম ডাফরিনের সাথে সাক্ষাৎ কর পরিকল্পনার কথা বলেন। ডাফরিন হিউমের কথা সমর্থন করেন।

একপর্যায়ে ১৮৮৫ गान a জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা হয়। ফলে ভারতের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয় । কংগ্রেসের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য : ১৮৮৫ সালে অ্যালান অকটাভিয়ান হিউম এবং ডারি প্রতিষ্ঠা হলে প্রথম সভাপতি করা হয় বোম্বাইয়ের খ্যাতনামা ব্যারিস্টার উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়কে। তিনি সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের কথা ঘোষণা করেন।

উদ্দেশ্যাবলির মধ্যে নিম্নবর্ণি বলে ঘোষণা করা হয়।

যথা :
১. ভারতীয়দের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন । ১৮৮৫ সালের কংগ্রেসে বলা হয় যে, ভারতের বিভিন্ন অ বসবাসরত ভারতীয়দের মধ্যে যোগসূত্র থাকবে এবং তারা সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখবে। কেননা, সৌহার্দ্যপূর্ণ স স্থাপিত না হলে তাদের মধ্যে জাতীয় চেতনাবোধ জাগ্রত হওয়া সহজ হবে না।


২. জাতিগত বৈষম্যের অবসান । ১৮৮৫ সালের ঘোষণায় বলা হয় যে, যদিও ভারত ভাষাভাষী জনসাধারণের মিলনক্ষেত্র, তথাপিও তাদের মধ্যে কোন ধরনের ধর্ম-বর্ণের ক্ষেত্রে সংকীর্ণতা থাকবে সংকীর্ণতা দূর করতে পারলে জাতীয় ঐক্যের পথ সহজ হবে।


৩. সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যাবলির সমাধান : ১৮৮৫ সালের কংগ্রেসের ঘোষণায় বলা হয় যে, ভারতের সমস্যা তা ভারতীয় শিক্ষিত ব্যক্তিবর্গের মধ্যে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে অবসান ঘটাতে হবে এবং আলোচনাপূর্ণ সমস্যাবলি চিহ্নিত করতে হবে।


৪. রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘোষণা : কংগ্রেসের আগামী এক বছরের জন্য লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও কর্মসূচির কথা ঘোষণা করা হয়। কর্মসূচির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি বিষয়ে সরকারের কাছে পাঠানোর জন্য ১টি সুপারিশ সম্মলিত প্র করে সরকারের কাছে পেশ করা হয়। এগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিল-
ক. ভারতের প্রশাসনের তদন্তের জন্য একটি রাজকীয় সমিতি নিয়োগ করা। ভারত সচিবের পরামর্শ সভার বিলোপ করা।


গ. কেন্দ্রীয় আইনসভায় নির্বাচিত জাতীয় সদস্যদের গ্রহণ করা।
घ. ভারতের সামরিক খাতে ব্যয় হ্রাস করা। উচ্চ রাজকর্মচারী নিয়োগের জন্য একযোগে ভারতে ও ইংল্যান্ডে পরীক্ষা গ্রহণ করা।


কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপটঃ নিম্নে কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে আলোচনা করা হল :

১. হিউমের উদ্যোগের কারণ : ভারতবাসীর প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে অকটাভিয়ান হিউম জাতীয় কংগ্রেসের ন্যায় একটি জাতীয়তাবাদী সংগঠন গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর সত্তরের দশকে দেশব্যাপী তীব্র অসন্তোষ দেখা দেয়। তিনি কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা করে ভারতীয় জনগণের ভারতীয় জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে শান্তিপূর্ণভাবে সাংবিধানিক দিকে প্রবাহিত করতে চান। কংগ্রেসের প্রতি হিউমের অগাধ আস্থা ছিল এবং একে তিনি জাতীয় আন্দোলন বলে আখ্যা দেন। পরবর্তীকালে ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ক্ষেত্রে জাতীয় কংগ্রেস এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এমনকি ভারতবাসীর পরম মিত্র হিউম ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীর শোষণমূলক নীতি ও আচরণের তীব্র প্রতিবাদে জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা করেন।


২. হিউমের সেফটি বালব তত্ত্ব: উইলিয়াম ওয়েডারবার্ন ১৯১৩ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘Allan Octaavian hume, Father of the Indian National Congress’ নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, ভাইসরয় লর্ড লিটনের কার্যকালের শেষদিকে হিউম এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, ভারতবাসীর ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ প্রতিরোধের জন্য নির্দিষ্ট কিছু ব্যবস্থা থাকা দরকার। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের জনসাধারণের আর্থিক দুর্দশা এবং বুদ্ধিজীবীদের সরকার বিরোধী চিন্তাভাবনার ফলে ভারতের ভবিষ্যৎ কল্যাণ সম্পর্কে বিপদের সংকেত পান। এমনকি হিউম নিজে একথা দ্বিধাহীনভাবে স্বীকার করে বলেছেন যে, সে সময় ভারতে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে এক ভয়াবহ ষড়যন্ত্র চলছিল। ভারতের শিক্ষিত সম্প্রদায় যাতে এ সম্ভাব্য বিপ্লবে যোগ না দেয় সেজন্য তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস গঠনের পরিকল্পনা করেন। হিউম কংগ্রেসকে ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থার স্বার্থে একটি সেফটি বালব হিসেবে বর্ণনা করেন। তাঁর মতে, ব্রিটিশ সরকারের শাসননীতির ফলে ভারতে ক্রমবর্ধমান বিরোধী শক্তির উদ্ভব ঘটে। যার নিরাপদ বহির্গমনের জন্য একটি বালবের জরুরি প্রয়োজন। একথা অনস্বীকার্য যে, প্রধানত সাম্রাজ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা পরিচালিত হয়ে হিউম এক সর্বভারতীয় একটি রাজনৈতিক সংস্থা গঠনে ব্রতী হন।


৩. ভারতীয় নেতৃবৃন্দের আকাঙ্ক্ষা : রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন ভারতীয় নেতৃবৃন্দ স্বদেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার দশ বছর পূর্বেই ভারতের বিভিন্ন স্থানে বাজনৈতিক সংগঠন গড়ে উঠতে থাকে এবং এসব প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্য দিয়ে ভারতের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক সচেতনতা প্রকাশ পায় ।


৪. হিউমের অবদান : হিউম যে কেবল ইংরেজ শাসনের নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থার জন্য সচেষ্ট ছিলেন তা নয়। ভারতবর্ষকে তিনি মনেপ্রাণে ভালবাসতেন এবং দরিদ্র ভারতীয় কৃষকদের জন্য তিনি সহানুভূতির মনোভাব পোষণ করতেন। কিন্তু একমাত্র হিউমই একক প্রচেষ্টায় ভারতের জাতীয় কংগ্রেস গঠন করেছিলেন; এ ধারণা পোষণ করলে ঐতিহাসিক বাস্তবতাকে অস্বীকার করা হবে। নিজেদের থেকে অগ্রণী ও সচেতন ভারতীয়গণ একটি জাতীয় সংগঠন প্রতিষ্ঠার জন্য একান্ত আগ্রহী ছিল। হিউম ঐ ঐতিহাসিক পরিস্থিতি যথাযথভাবে অনুধাবনের পর জাতীয় কংগ্রেস গঠনে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন।

৫. লর্ড ডাফরিনের ভূমিকা : জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম সভাপতি উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় এ মত ব্যক্ত করেন যে, জাতীয় কংগ্রেসের উদ্ভবে লর্ড ডাফরিনের মুখ্য ভূমিকা ছিল। ১৮৮৫ সালের প্রথমদিকে হিউম ডাফরিনের কাছে সমস্ত বিষয় উপস্থাপিত করেন। হিউম সামাজিক সংস্কার সম্পর্কে আলোচনা করার জন্য একটি সর্বভারতীয় প্রতিষ্ঠান গঠনের উপর জোর দেন এবং হিউম এ প্রস্তাবে জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা করেন।


৬. ভারতসভার প্রভাব : ১৮৮৩ সালে কলকাতায় সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় কর্তৃক স্থাপিত ভারতসভার আমন্ত্রণে যে জাতীয় সম্মেলনের অধিবেশন হয় তাতে জাতীয় কংগ্রেস গঠনের পরিকল্পনা করা হয়। এক সময় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি এ. সি. মজুমদার এ অভিমত ব্যক্ত করেন যে, জাতীয় সম্মেলনের আদর্শ হতেই ২ বছর পর জাতীয় কংগ্রেস গঠনের পরিকল্পনা করা হয়। ১৮৮২ সালের ২৭ মে সুরেন্দ্রনাথ সম্পাদিত বেঙ্গলি পত্রিকায় National Congress কথাটির প্রথম উল্লেখ করা হয়।


কলকাতায় অনুষ্ঠিত জাতীয় সম্মেলনই যে জাতীয় কংগ্রেসের আদর্শ ছিল সে বিষয়ে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। উপরিউক্ত ঘটনাসমূহের প্রেক্ষিতে ১৮৮৫ সালের ২৮ ডিসেম্বর বোম্বাই শহরে জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা লাভ করে। কংগ্রেসের অধিবেশনে ব্যারিস্টার উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। কংগ্রেসের এ অধিবেশনে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের ৭২ জন প্রতিনিধি যোগদান করেন। জাতীয় কংগ্রেসের লক্ষ্য ও বোম্বাই শহরে কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশনে উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় জাতীয় কংগ্রেসের আদর্শ নীতিমালা ঘোষণা করেন। এ ঘোষণা অনুযায়ী দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন; বর্ণ, ধর্ম ও প্রদেশ নির্বিশেষে জাতীয় ঐক্যের অনুভূতি ও মনোভাবের বিকাশ ও সংহতি সাধন, সরকারের কাছে জনসাধারণের দাবি পেশ, জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি এবং জনমত গঠনে উদ্যোগী করাই হবে কংগ্রেসের লক্ষ্য। এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে নেতৃবৃন্দ কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশনে সরকারের কাছে পাঠানোর জন্য ৪টি সুপারিশ সম্মিলিত একটি প্রস্তাব গ্রহণ করেন। যথা : ভারতের প্রশাসনের তদন্তের জন্য একটি রাজকীয় সমিতি গঠন করা। ভারত সচিবের পরামর্শ সভা বিলোপ করা । কেন্দ্রীয় আইনসভায় নির্ধারিত আইনে ভারতীয় সদস্যদের গ্রহণ করা। ভারতের সামরিক খাতে ব্যয় হ্রাস করা এবং উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী নিয়োগের জন্য ভারতে ও ইংল্যান্ডে একযোগে পরীক্ষা গ্রহণের ব্যবস্থা করা ।


১৮৮৫-১৯০৫ সাল পর্যন্ত কংগ্রেসের কার্যাবলি/সীমাবদ্ধতা : ১৮৮৫-১৯০৫ সাল পর্যন্ত জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বে যারা ছিলেন তাদের অধিকাংশই ছিলেন ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের মানুষ। ইংরেজদের ন্যায়পরায়ণতা ও সদিচ্ছা সম্পর্কে গভীর বিশ্বাস নিয়ে তারা তাদের কর্মপন্থা নির্ধারণ করেন আসন্ন স্বর্ণযুগের আশায়। তারা বার্ষিক সম্মেলনে সমবেত হয়ে সমসাময়িক বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কে আলোচনা করতেন,

প্রস্তাব গ্রহণ করতেন এবং সরকারের কাছে তা প্রেরণ করতেন বিবেচনার জন্য। নিম্নে এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হলঃ-


১. শাসনতান্ত্রিক সংস্কার : শাসনতান্ত্রিক ক্ষেত্রে আদিপর্বের নেতারা ধীরগতিতে গণতান্ত্রিক অধিকার, অর্জনের পথে অগ্রসর হয়েছিলেন। সর্বোচ্চ বা কেন্দ্রীয় কাউন্সিল এবং প্রাদেশিক কাউন্সিলে নির্বাচনের মাধ্যমে ভারতীয় প্রতিনিধি গ্রহণ ছাড়া কংগ্রেসিদের দাবি ছিল প্রাদেশিক আইন পরিষদে বাৎসরিক ব্যয়বরাদ্দ পেশ করতে হবে এবং সেখানে প্রশ্ন তোলার অধিকার দিতে হবে। এছাড়া শাসন ক্ষেত্রে ভারতীয়দের অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়ার জন্য আরও বহুতর দাবি পেশ করেন। অন্যান্য বিষয়েও কংগ্রেস নেতারা আরও কয়েক ধাপ অগ্রসর হয়ে স্বায়ত্তশাসনাধিকারের দাবি জানান। ১৯০৫ সালে গোখলে প্রথম এ দাবি উত্থাপন করেন। পরের বছর দাদাভাই নৌরাজী ঐ একই দাবি তুলে ধরেন।


২. অর্থনৈতিক সংস্কার : আদিপর্বে জাতীয় কংগ্রেস নেতৃবর্গ ইংরেজ শাসকদের প্রতি আস্থাশীল থাকলেও ভারতীয় জনসাধারণের আর্থিক দুর্দশার জন্য ইংরেজ সরকারকে দায়ী করেন। ১৮৮৬ সালে দাদা ভাই নৌরাজী ঘোষণা করেন যে, ব্রিটিশ শাসনের ফলে যা কিছু ভাল সংঘটিত হয়েছে এবং যত ভাল পরিকল্পনা আছে তার সবই অর্থহীন প্রতিপন্ন হবে যদি ব্রিটিশ শাসনে ভারত ক্রমান্বয়ে অধিকতর দারিদ্র্যের পথে নিমজ্জিত হয়। ১৮৯১ সালে কংগ্রেস উচ্চহারে রাজস্ব ধার্য করা ও রাজস্ব আদায়ের কঠোর পদ্ধতির প্রতিবাদ জানায়। বিংশ শতকের গোড়ার দিকে কংগ্রেস কৃষি ব্যাংকের দাবি তোলে। পাশাপাশি শিল্পের উন্নতির জন্যও কংগ্রেসের নেতারা উদ্যোগী হন । “


৩. প্রশাসনিক সংস্কার : প্রশাসনিক ব্যয়বহুলতা হ্রাস করা এবং ভারতীয়দের প্রশাসনিক কার্যে নিয়োগ করার সরকারি নীতি গ্রহণের পক্ষে কংগ্রেস মতামত দেয়। ইউরোপীয় কর্মচারীদের উচ্চহারে বেতন দেওয়ার ফলে যে অর্থের ক্ষতি হয় তার জন্য সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এছাড়া ভারতীয়দের জন্য শিক্ষাবিস্তার ও স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাদি গ্রহণের জন্যও কংগ্রেসের নেতৃবর্গ সরকারের কাছে আবেদন জানান।


৪. অসামরিক অধিকার : ভারতীয়দের অসামরিক অধিকারের সুরক্ষার জন্য কংগ্রেস নেতারা গুরুত্ব দিয়েছিলেন বাকস্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতার উপর। ইংরেজ সরকার যে কোন অজুহাতে জাতীয় নেতাদের যে কারাবদ্ধ করতে থাকে এর বিরুদ্ধে কংগ্রেসিরা তীব্র প্রতিবাদ জানায়। ১৮৯৭ সালে তিলকের বক্তৃতা এবং প্রবন্ধকে দেশদ্রোহী আখ্যা দিয়ে তাঁকে কারাবদ্ধ করলে কেবল কংগ্রেস নেতারাই নয়, সমগ্র দেশ এর প্রতিবাদে সোচ্চার হয়। এছাড়া অন্যান্য বিষয়েও কংগ্রেস নেতারা সোচ্চার ছিলেন।


৫. কংগ্রেসের সফলতা : সমসাময়িক কংগ্রেসের নেতারা সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে তা সমাধান করার জন্য চেষ্টা করেছিলেন। যথাঃ ক. কংগ্রেসিরা অত্যন্ত স্পষ্টতার সাথে ইংরেজ শাসনের অর্থনৈতিক শোষণের দিকটি তুলে ধরে ভারতবাসীকে এ ব্যাপারে সচেতন করে তোলেন।
খ. নরমপন্থি নামে অভিহিত আদিপর্বের কংগ্রেস নেতৃবর্গ তাদের দাবিদাওয়ার মধ্য দিয়ে যে রাজনৈতিক চেতনার জাগরণ ঘটান তা ব্যর্থ হয় নি ।
গ. নরমপন্থি নেতৃবর্গ যে নিয়মতান্ত্রিক পথে আন্দোলন পরিচালনা করেছিলেন তাতে প্রমাণিত হয় যে, ইংরেজদের তুলনায় ভারতীয় নেতৃবর্গ কোন অংশে খাটো নয়। ঘ. জাতীয় কংগ্রেস নেতৃবর্গ ইংরেজ শাসনের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে প্রশ্ন তুলে তাদের সমালোচনা করে ঐ শাসনের নৈতিক ভিত্তিকে দুর্বল করেছেন।


প্রথম পর্বের জাতীয় নেতারাই সর্বপ্রথম ভারতবাসীকে সম্পূর্ণ এক নতুন রাজনৈতিক আন্দোলনের সাথে পরিচিত করে দিতে সক্ষম হয় ।
তবে আদিপর্বের জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃবর্গের কর্মপন্থার বিরুদ্ধে ক্রমে এক চরমপন্থি ভাবধারার সৃষ্টি হয়। যে কারণে পরে কংগ্রেস চরমপন্থি ও নরমপন্থি এ দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে যায় ।


উপসংহার : অতএব বলা যায় যে, দীর্ঘ পথ পরিক্রমার পরিপ্রেক্ষিতে ভারতীয় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে যে জাতীয়তাবাদী চেতনার সঞ্চার হয় তার ফলস্বরূপ হল কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা। তবে যদিও কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতা ছিল একজন অবসরপ্রাপ্ত ইংরেজ সিভিলিয়ান, কিন্তু তিনি ভারতীয়দের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। আর এজন্যই ভারতীয়দের কথা বলার বলিষ্ঠ মাধ্যম সর্বভারতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা করে। এ কংগ্রেস ১৮৮৫ সালে প্রতিষ্ঠা থেকে ১৯০৫/১৯০৭ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনেক অবদান রাখে। যদিও আবেদনগুলো পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয় নি তথাপিও তা ভারতবাসীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল বলা যায়।

Leave a Comment