১৭৬৫-১৭৯৩ সাল পর্যন্ত ভূমি রাজস্ব শাসনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পর্কে আলোচনা কর, ভূমি রাজস্ব শাসনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পর্কে আলোচনা কর

১৭৬৫-১৭৯৩ সাল পর্যন্ত ভূমি রাজস্ব শাসনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পর্কে আলোচনা কর, ভূমি রাজস্ব শাসনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পর্কে আলোচনা কর


১৭৬৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার দেওয় লাভের পর বাংলার জনসাধারণের জীবনে নেমে আসে দুর্ভোগ। এক পর্যায়ে ১৭৬৯-৭ দুর্ভিক্ষের কথা ডাইরেক্টর সভার কাছে পৌঁছলে কোর্ট কোম্পানির শাসনকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ১৭৩ প্রায় পাস করেন। আর এর আগে ১৭৭২ সালে ওয়ারেন হেস্টিংসকে বাংলার গভর্নর নিয়োগ করে। ক্ষমতা গ্রহণ করে রাজস্ব সমস্যা সমাধানের জন্য ১৭৭২ সালে একটি ব্যবস্থা গ্র রাজস্ব সমস্যার সমাধান হয় নি। তাই পরবর্তী রাজস্ব সমস্যা সমাধানের জন্য ১৭ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তিত হয়। এখন প্রশ্ন, এ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কি রাজস্ব সমস্যার সমাধ ১৭৬৫ সাল থেকে ১৭৯৩ সাল পর্যন্ত গৃহীত রাজস্ব নীতি : ১৯০৫ সাল থেকে ১৯৯৩ হাজস্ব ব্যবস্থা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলে নিম্নোক্ত বিষয়াবলি আলোচনায় প্রাধান্য পায় ?


ক. ১৭৬৫ সালের রাজস্ব ব্যবস্থা : ১৬০০ সালে ২১৭ জন বণিকের ব্যবসায় উদ্দেশ্যে ভারত আ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উত্থান হয়। এ কোম্পানি ভারতে দীর্ঘদিন বাণিজ্য করার সুবাদে অবস্থানে ভারতে হস্তক্ষেপ করেন। তাই ১৭৬৫ সালে নবাব আলীবর্দী খানের মৃত্যুর পর নতুন নবাব হিসেবে সিরাজউদ্দৌল ইংরেজদের সাথে নবাবের সম্পর্কের অবনতি হয়। এক পর্যায়ে ১৭৫৭ সালে পলাশীর বিয়োগান্তক ঘটনার মাধ্যমে ব রাজনৈতিক প্রাধান্য কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। এরপর কোম্পানি কিছুকাল আড়ালে থেকে ভারতে নিজ ভিত্তিক মজবুত করার চেষ্টা করেন।

এ উদ্দেশ্যকে সফল করার জন্য কোম্পানি ১৭৫৭-১৭৬৪ সাল পর্যন্ত বাংলার কোম্পানির হাতের পুতুল হিসেবে প্রথমে মীর জাফর ও পরে মীর কাশিমকে বসান। কিন্তু ১৭৬৪ সালে মীর সাথে কোম্পানির পুনরায় সম্পর্কের অবনতি হয়। কিন্তু নবাব মীর কাশিম কোম্পানির সাথে শক্তির পরীক্ষায় ব্যর্থ হন কাশিমের পতনের পর কোম্পানির পক্ষে ক্লাইভ ভারতের শাসন ক্ষেত্রে তথা রাজস্ব আদায়ের জন্য কৌশ করেন। এক পর্যায়ে বাংলার নবাব নাজিউদ্দৌলাও মুঘল সম্রাট শাহ্ আলমের সাথে নাম মাত্র শর্তে দেওয়ানি ক্ষমতা পাত করেন। কোম্পানি বাংলার দেওয়ানি ক্ষমতা লাভ করায় রাজস্ব ক্ষেত্রে একটি নতুন অধ্যায়ের সংযোজন হয়।


খ. ওয়ারেন হেস্টিংস কর্তৃক প্রবর্তিত রাজস্ব নীতি : ওয়ারেন হেস্টিংস রাজস্ব ব্যবস্থার সমান নিম্নোক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করেন :


১. রাজস্ব নীতির উদ্দেশ্য: হেস্টিংস যখন গভর্নর হিসেবে শাসনভার গ্রহণ করেছিলেন তখন ক্লাইভ প্রবর্তিত শাসনব্যবস্থার যাবতীয় ত্রুটি ব্যাপকভাবে প্রকাশ লাভ করেছিল। তাই হেস্টিংস এর উপর চাপ ছিল ক্লাইভ দ্বৈতশাসনের অবসান করে ভারতে একটি চমৎকার রাজস্ব ব্যবস্থা প্রবর্তন করে কোম্পানির রাজস্ব সমস্যার সমাধান করার। তাই হেস্টিংস ১৭৭২ সালে দ্বৈতশাসনের অবসান করে নতুন একটি রাজস্ব ব্যবস্থা প্রবর্তন করার পরিকল্পনা করেন।


২. রেজা খান ও সেতাব রায়ের পদচ্যুতি ঃ পূর্বে কোম্পানির দ্বৈতশাসন নীতিতে বাংলার রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব ছিল রেজা খানের উপর এবং বিহারের রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব ছিল সেভাব রায়ের উপর। হেস্টিংস নতুন রাজস্ব ব্যবস্থা প্রবর্তন করার জন্য প্রথম রেজা খান ও সেতাব রায়কে পদচ্যুত করেন এবং তাদের পদ দুটি উঠিয়ে দেন।


৩. রাজস্ব আদায়ের নতুন ব্যবস্থা: রেজা খান ও সেতাব রায়কে পদচ্যুত করে হেস্টিংস রাজস্ব আদায়ের জন্য ভ্রাম্যমাণ কমিটি নামে একটি ক্ষুদ্র সভা গঠন করেন। এ কমিটিকে প্রত্যেক জেলায় উপস্থিত হয়ে জমিদারদের সাথে বন্দোবস্ত করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। জমিদারগণকে এক সাথে পাঁচ বৎসর বন্দোবস্ত দেওয়ার সিদ্ধান্ত ধির হয়। কোম্পানির রাজস্ব আদায়ের ভারপ্রাপ্ত কর্মচারীগণ পূর্বে সুপারভাইজার বা পরিদর্শক নামে অভিহিত হতেন। হেস্টিংস তাদেরকে কালেক্টর নামকরণ করেন। দেওয়ানির কোষাগার মুর্শিদাবাদ থেকে কলকাতায় স্থানান্তরিত করেন। গভর্নর ও তাঁর কাউন্সিল নিয়ে একটি রেভিনিউ বোর্ড গঠন করেন। দেওয়ানি সংক্রান্ত কার্যাদির সর্বোচ্চ দায়িত্ব এ বোর্ড এর উপর ন্যস্ত হল।


৪. নতুন রাজস্ব নীতির সমালোচনা : ওয়ারেন হেস্টিংসের রাজস্ব নীতি সদিচ্ছা প্রসূত হলেও সাফল্য লাভ করেছিল তা বলা যায় না। কারণ, হেস্টিংস ব্যক্তিগতভাবে পূর্বেকার জমিদারদের সাথে বন্দোবস্তের পক্ষপাতী থাকলেও কার্যক্ষেত্রে যে সকল ব্যক্তি সর্বোচ্চ পরিমাণ রাজস্ব দিতে স্বীকৃত হয়েছিল তাদেরকে জমিদারি বন্দোবস্ত দেওয়া হয়েছিল। ফলে দীর্ঘকালের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন জমিদারগণ যেমন তাদের জমিদারি হারান তেমনি কোম্পানিও অভিজ্ঞ আদায়কারীদের সাহায্য হতে বঞ্চিত হন। হেস্টিংসের পঞ্চবার্ষিক বন্দোবস্তের পূর্বে জমিদারগণ প্রতি বৎসরই নতুন করে বন্দোবস্ত গ্রহণ করতেন বটে, কিন্তু তারা নিজ জমিদারি থেকে কোন কালেই বঞ্চিত হন নি। কিন্তু অভিজ্ঞ জমিদার শ্রেণীর স্থলে অধিক রাজস্বের লোভে যে কোন ব্যক্তির সাথে রাজস্ব বন্দোবস্ত এবং অনভিজ্ঞ ইংরেজ কর্মচারী বর্গের হস্তে রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব অর্পণ হেস্টিংসের রাজস্ব ব্যবস্থার অসাফল্যের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।


৫. হেস্টিংসের রাজস্ব নীতির পরিবর্তন : পঞ্চশালা বন্দোবস্তে তেমন সুফল পরিলক্ষিত না হওয়ায় ডাইরেক্টর সভা জমি বন্দোবস্ত পরিবর্তনের প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করতে বাধ্য হন। অবশ্য রাজস্ব আদায় সংক্রান্ত কিছু বিষয় পরিবর্তন সে সময়ে একান্ত প্রয়োজন হয়ে দেখা দিয়েছিল। এজন্য বাংলা, বিহার, উড়িষ্যাকে ছয়টি অংশে বিভক্ত করে প্রত্যেক অংশে একটি করে প্রাদেশিক কাউন্সিল স্থাপন করেন এবং প্রত্যেক কাউন্সিলের কার্যে সাহায্য করার জন্য একজন করে দেশীয় দেওয়ান নিযুক্ত করেন। এ ব্যবস্থা কার্যকরী করার সাথে সাথে দেশীয় দেওয়ান পদ উঠিয়ে দেন। ১৭৭২ সালে রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব কেবল ইংরেজ কর্মচারীদের হাতে অর্পণ করা হয়েছিল। কিন্তু ১৭৭৩ সালে ইংরেজ ও দেশীয় উভয় কর্মচারীর হাতে এ দায়িত্ব দেওয়া হয়। রাজস্ব কার্য পর্যবেক্ষণ করার জন্য ‘আমিনী কমিশন’ নামে একটি কমিশন নিযুক্ত করেন । প্রাদেশিক কাউন্সিল উঠিয়ে দিয়ে আবার কালেক্টর নিয়োগ করেন। পূর্বে জমি ইজারা দেওয়ার যে নীতি করেছিলেন তা বাতিল করে দিয়ে সাবেক কালের জমিদারি আবার চালু করেন। কিন্তু এ কাজ ছিল খুবই কষ্টসাধ্য। কারণ-

পূর্বে জমিদারগণ নিজ নিজ এলাকায় যে ক্ষমতা ভোগ করতেন এবং তাদের যে প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল তা ইতোমধ্যে বিনাশপ্রাপ্ত হয়ে গেছে। জমিদারদের অধীন প্রজাবর্গের নিরাপত্তা, তাদের বিচার প্রভৃতি কাজ বা দায়িত্ব এখন আর ছিল না। তারা কেবল রাজস্ব আদায়কারীতে পরিণত হয়েছিলেন। কোম্পানির হাতে শাসনব্যবস্থা চলে যাওয়ার ফলে জমিদারদের পূর্বেকার মর্যাদা আর ছিল না। সর্বোচ্চ পরিমাণ রাজস্ব দেওয়ার শর্তে জমি নির্দিষ্টকালের জন্য অনভিজ্ঞ ব্যক্তিদের হাতে কিছুকাল থাকার ফলে পূর্বেকার জমিদারি প্রথার মূল ভিত্তি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।

iii. কোম্পানি কর্তৃক অত্যধিক পরিমাণ রাজস্ব নির্ধারণের ফলে জমিদারদের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি শোচনীয় হয়ে
পড়েছিল। এর ফলে অনবরত জমিদারি হস্তান্তরিত হয়েছিল ।

iv. চিরাচরিত জমিদারি ব্যবস্থায় জমিদাররা পূর্বে বিদ্বান, শাস্ত্রজ্ঞ প্রভৃতি ব্যক্তিকে জমি দান করে যে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কার্যাদি করতেন তা এখন এক প্রকার বন্ধ হয়ে যায়। রাজস্ব আদায় করাই জমিদারদের একমাত্র কাজ ছিল ।


এভাবে হেস্টিংস তার শাসনামলে রাজস্ব সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেন। কিন্তু তা কার্যকরী হয় নি । গ. কর্নওয়ালিস প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত : ১৭৯৩ সালে কর্নওয়ালিস ভারতের শাসনভার গ্রহণ করে কোম্পানির রাজস্ব সমস্যার সমাধানে এক অভিনব নীতি প্রবর্তন করেন। এ ব্যবস্থাই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নামে পরিচিত। নিম্নে এ বিষয়ে আলোচনা করা হল :
1. Pitt India Act (1784 ) পাস : ওয়ারেন হেস্টিংসের পাঁচসালা ও একসালা বন্দোবস্ত যখন রাজস্ব সমস্যার সমাধান করতে ব্যর্থ হয়, তখন ব্রিটিশ সরকার ভারতের শাসনতান্ত্রিক সমস্যা সমাধানের জন্য ১৭৮৪ সালে Pitt India Act পাস করেন। এ Pitt India Act-এর ৩৯ নং ধারায় চিরস্থায়ী জমি বন্দোবস্ত দেওয়ার পক্ষে মত দেওয়া হয় ।


২. চার্লস স্টুয়ার্টের পরিকল্পনা : ১৭৮৪ সালে Pitt India Act কার্যকরী হওয়ার পর গভর্নর জেনারেল কাউন্সিলের সদস্য চার্লস স্টুয়ার্ট চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করার পক্ষে মতামত ব্যক্ত করেন। তিনি Pitt India Act-এর ৩৯ নং ধারা মোতাবেক চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করার জন্য দাবি উত্থাপন করেন। কিন্তু ওয়ারেন হেস্টিংস এ বন্দোবস্তের পক্ষপাতী ছিলেন না। তাই চার্লস স্টুয়ার্ট এর পরিকল্পনা কোর্ট অব ডাইরেক্টরস কর্তৃক প্রশংসিত হলেও গভর্নর জেনারেল পরিকল্পনা কার্যকরী না করে কাউন্সিলরারের পরিকল্পনা কার্যকরী করার পরিবেশ ছিল না।


৩. কর্নওয়ালিসের গভর্নর জেনারেল নিযুক্তি। ইতোমধ্যে ব্রিটিশ সরকার দেখলেন যে, কোম্পানির ভারতে রাজস্ব সমস্যার সমাধানের জন্য একটি মাত্র পথ আছে, তা হল চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করা। তাই ডাইরেক্টর गा ১৭৮৬ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কার্যকরী করার জন্য কর্নওয়ালিসকে গভর্নর জেনারেল নিয়োগ করেন।
৪. কর্নওয়ালিস ও জনশোর বিতর্ক। কর্নওয়ালিস গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত হয়ে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কার্যকরী করার জন্য জোর প্রচেষ্টা চালান। কিন্তু এ কাজে বাধা হয়ে দাঁড়ান তার রাজস্ব উপদেষ্টা ও বোর্ড অব রেভিনিউর প্রেসিডেন্ট জন শোর। জন শোর যুক্তি দেখান যে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কার্যকরী করার পূর্বে জানা দরকার-
1. জমিদার, তালুকদার ও রায়তের বর্তমান আর্থিক অবস্থা। মুঘল শক্তির অবক্ষয়ের আগে জমিদার ও রায়তের অধিকার,
ii. মুঘল শক্তির পতন পর্বে রায়তের খাজনা সংক্রান্ত আইন ও রেওয়াজঃ i. দেওয়ানি লাভের পর জমিদার কর্তৃক আরোপিত নতুন আবওয়াব, মামথ ইত্যাদি;
VI. সাধারণ রায়তের স্বার্থ রক্ষার উপায়; বর্তমান রাজস্ব ধার্থ ব্যবস্থায় ত্রুটিসমূহ ও তা দূর করার উপায়;
vii. ১৭৭২ সাল থেকে প্রত্যেক জমিদারির বিস্তারিত জমা, উত্তল ও বাকি হিসাব সংগ্রহ। ৫. দশসালা বন্দোবস্ত : জন শোর ও কর্নওয়ালিস যখন চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নিয়ে বিতর্ক করছিল তখন ব্রিটিশ সরকার দেখলেন যে, একটি পরীক্ষামূলক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে দেখা দরকার। তাই জন শোরও এ সময় মতামত ব্যক্ত করেন যে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করার আগে পরীক্ষামূলক একটা বন্দোবস্ত করে দেখা দরকার তা কতটুকু কার্যকরী হয়। তাই ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক ১৭৮৯-৯০ সালে দশসালা বন্দোবস্ত ঘোষিত হয় এবং দশসালা বন্দোবস্তের শর্ত দেয়া হয় যে, যদি ডাইরেক্টর হাতা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পক্ষে মতামত ব্যক্ত করে তাহলে দশসালাকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে পরিণত করা হবে।


৬. চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ১৭৯৩ : ইতোমধ্যে একদিকে কর্নওয়ালিসের প্রচেষ্টা অন্যদিকে ডাইরেক্টর সভার পর্যালোচনা থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে দেখা যায় যে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ছাড়া অন্য কোন পথ ছিল না। তাই দশসালা বন্দোবস্তকে পরে ১৭৯৩ সালে ২২ মার্চ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ঘোষণা করেন। ফলে সুদীর্ঘ দুই দশকের সমস্যার সমাধান হয়।


৭. চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলাফল : চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলাফল সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হল : কোম্পানির রাজস্ব নির্ধারিত : চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে কোম্পানির জন্য রাজস্ব নির্ধারিত হওয়ায় কোম্পানির রাজস্ব আয় নিশ্চিত হয়। ফলে সরকার কোম্পানির জন্য বাজেট প্রণয়ন করতে সুবিধা হয়। পূর্বে কোম্পানির আয়ের কোন নিশ্চয়তা ছিল না। তাই সমস্যা দেখা দেয় ৷
ii. নতুন জমিদার শ্রেণীর সৃষ্টি : চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে পুরাতন জমিদার শ্রেণী ধ্বংস হলেও এক নতুন জমিদার শ্রেণীর সৃষ্টি হয়। এ নতুন জমিদার শ্রেণী কোম্পানির শাসনকে টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করেছিল। এতে দেখা যায়, সূর্যাস্ত আইন করার ফলে নির্দিষ্ট দিনে রাজস্ব দিতে না পারলে রাজস্ব নিলামে দেওয়া হতো।
iii. মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভব : চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট রাজস্ব দিতে না পারলে জমিদারি নিলামে দেওয়া হতো। আ নিলামে দেওয়ার ফলে এক শ্রেণীর মধ্যবিত্ত এ নিলামী জমিদারি উচ্চ অর্থের বিনিময়ে ইজারা দিতেন। এ ইজারা নেওয়ার পর থেকে যে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভব হয় তা কোম্পানির অনুগত শ্রেণীতে পরিণত হয়।
iv. রায়তদের উন্নতি : চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে জমিদাররা জমির স্থায়ী মালিকানা স্বত্ব পায়। তাই তারা জমির উন্নয়নে মনোনিবেশ করে। জমির উন্নয়নে মনোনিবেশ করার ফলে রায়তের উন্নয়ন সাধিত হয়।
v. ক্ষুদ্রশিল্পের উন্নতি: চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে জমিদারগণ শাসনকার্যে মনোযোগী হয়। ফলে দেখা যায়, তাঁরা ক্ষুদ্রশিল্পের উন্নয়নে মনোযোগী হন।


উপসংহার : অতএব বলা যায়, কোম্পানির রাজস্ব সমস্যা সমাধানের জন্য যে রাজস্বনীতি ১৭৭২ সাল থেকে ১৭৯৩ সাল পর্যন্ত সময়ে প্রণয়ন করা হয় তা অনেকটা সহায়ক হয়েছিল। কারণ, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে কোম্পানির রাজস্ব নির্ধারিত হয়। ফলে পূর্বে রাজস্ব নির্ধারণের জন্য কোম্পানির যে ব্যয় হতো তা আর হয় নি। তবে পুরোপুরি এ সাফল্য যে ১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে হয়েছিল তাও নয়। তবে কোম্পানি শাসনের ইতিহাসে দীর্ঘ দু’দশকের পর্যালোচনার শেষ সমাধান হল এ বন্দোবস্ত।

Leave a Comment