পাকিস্তানের ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারির কারণ আলোচনা কর
প্রতিক্রিয়াশীল কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর মদদপুষ্ট হয়ে ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা তদানীন্তন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আইয়ুব খানের সহযোগিতায় পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করেন।
অতঃপর তিনি ১৯৫৬ সালে প্রণীত বহু কাঙ্ক্ষিত শাসনতন্ত্র বাতিল ঘোষণা করেন এবং সেনাবাহিনী প্রধান আইয়ুর খানকে সামরিক আইন প্রশাসক (CMLA) নিয়োগ করেন।
এর মাত্র বিশদিন পর আইয়ুব খান উচ্চাভিলাষী ইস্কান্দার মির্জাকে বিদেশে নির্বাসন দিয়ে নিজেকে পাকিস্তানের প্রেসেডিন্ট ঘোষণা করেন। এভাবে শুরু হয় জেনারেল আইয়ুব খানের সামরিক শাসন।
১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারির পটভূমি বা কারণ : নিম্নে ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারির পটভূমি বা কারণ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারির কারণগুলো কী?
১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারির কারণ : ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারির পিছনে বহুবিধ কারণ বিদ্যমান ছিল। যেমন
১. রাজনৈতিক স্থিতিহীনতা সামরিক কর্তৃপক্ষ দাবি করে যে, রাতারাতি ক্ষমতা হাত বদলের ফলে পাকিস্তানের রাজনৈতিক অবস্থা শোচনীয় পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়। এরূপ নাজুক পরিস্থিতিতে সামরিক শাসন জারি
করা অত্যাবশ্যক হয়ে পড়ে।
২. সুসংগঠিত রাজনৈতিক দলের অভাব : ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে এখানে কোনো সুসংগঠিত রাজনৈতিক দল গড়ে উঠতে পারে নি। মুসলিম লীগ ছিল দ্বিধাবিভক্ত, আওয়ামী লীগের অন্তর্দ্বন্দ্বও কম ছিল না। ন্যাপসহ অন্যান্য দলও সমগ্র পাকিস্তানভিত্তিক সংগঠন গড়ে তুলতে পারে নি। সুসংগঠিত বহুদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে না উঠায় সেনাবাহিনী রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের সুযোগ পেয়ে যায়।
৩. দলীয় শৃঙ্খলার অভাব : পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলসমূহের দলীয় শৃঙ্খলার অভাব দলবদলের নীতিহীন খেলা, উপদলীয় কোন্দল প্রভৃতি কারণে ঘন ঘন ক্ষমতার বদল সামরিক শাসনকে উস্কে দেয়।
১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারির কারণ ও ফলাফল আলোচনা কর
৪. সময়মতো নির্বাচনে অনীহা : ১৯৪৯ সালের পর থেকে পাকিস্তানে কখনই সময়মতো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় নি। নির্বাচনে হেরে যাবার ভয়ে মুসলিম লীগ সরকার অনেক শূন্য আসনে উপনির্বাচন অনুষ্ঠান করতেও সাহসী হয় নি। ফলে গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য ভূলুণ্ঠিত হয়। সেনাবাহিনী এর সুযোগ গ্রহণ করে।
৫. গভর্নর জেনারেলের অগণতান্ত্রিক হস্তক্ষেপ : ১৯৪৭ সাল থেকেই গভর্নর জেনারেলগণ অন্যায় ও অযাচিতভাবে মন্ত্রিসভার কাজে হস্তক্ষেপ করতেন। গোলাম মোহাম্মদ ও ইস্কান্দার মির্জার ষড়যন্ত্র, মন্ত্রিসভা ও আইনসভার কাজে অন্যায় হস্তক্ষেপ পাকিস্তানে সংসদীয় গণতন্ত্রকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়। ইস্কান্দার মির্জাকে লেলিয়ে দিয়ে সহজেই সেনাপ্রধান আইয়ুব খান সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন।
৬. রাজনীতিবিদদের অগণতান্ত্রিক আচরণ ও ঘটনাবলি : ১৯৫৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান পরিষদের অধিবেশন চলাকালে পরিষদে মারামারি এবং শেষ পর্যায়ে ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলীর মৃত্যু, প্রাদেশিক পর্যায়ে রাজনৈতিক নেতৃবৃদ্ধের মন্ত্রিত্বের প্রতি সীমাহীন লোভ, দলীয় নেতৃবৃন্দের সীমাহীন দুর্নীতি, ১৯৫৭ সালের ৯ মে আততায়ীর
হাতে ডা. খান সাহেবের মৃত্যু প্রভৃতি অগণতান্ত্রিক আচরণ পাকিস্তানে সামরিক আইন জারিকে ত্বরান্বিত করে।
১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারির প্রেক্ষাপট ও এর ফলাফল
আলোচনা কর
৭. প্রশাসনিক দুর্নীতি : রাজনৈতিক স্থিতিহীনতার কারণে প্রশাসনের সর্বস্তরে কর্মচারীবৃন্দ অতিমাত্রায় দুর্নীতিপরায়ণ হয়ে উঠলে সেনাবাহিনী এ অবস্থাকে মেনে নিতে পারে নি।
৮. অর্থনৈতিক দেউলিয়াত্ব: রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অস্থিরতার কারণে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পূর্ণরূপে ভেঙে পড়ে। সামরিক কর্তৃপক্ষের মতে এমতাবস্থায় সামরিক শাসনের বিকল্প ছিল না।
৯. পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি : ১৯৫৪ সালে পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তির ফলে পাকিস্তান সেনাবাহিনী প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র লাভ করে। ফলে তারা নিজেদের অপ্রতিরোধ্য মনে করে এবং ক্ষমতা দখলের সুযোগ খুঁজতে থাকে।
১০. বহিঃপ্রভাব : ১৯৫৮ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ব্রহ্মদেশের সেনাপতি জেনারেল নে উইনের ক্ষমতা দখলও ইস্কান্দার মির্জা ও আইয়ুব খানের নিকট পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করে।
১১. নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয়লাভের সম্ভাবনা : আসন্ন ১৯৫৯ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয়লাভের সম্ভাবনা দেখা দেওয়ায় সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখলের পরিকল্পনা করে।
১২. প্রত্যক্ষ কারণ : পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারির প্রত্যক্ষ কারণ ছিল নির্বাচনের প্রাক্কালে সোহরাওয়ার্দী ও গুরমানীর আঁতাত। এতে ইস্কান্দার মীর্জা শঙ্কিত হয়ে উঠেন এবং ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করেন।
সামরিক শাসন জারির ফলাফল : ১৯৫৮ সালে সমগ্র পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারির ফলাফল নিয়ে
উল্লেখ করা হলো :
১.সামরিক একনায়কত্বের সূচনা : ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারির ফলে সেনাবাহিনী দেশের একচ্ছত্র ক্ষমতার মালিক হয়ে যায়। পরবর্তীতে তারা সুযোগ বুঝে ক্ষমতায় হস্তক্ষেপ করতে থাকে।
২. গণতন্ত্রের সমাধি : সামরিক শাসন দেশে গণতন্ত্রের সমাধি রচনা করেছিল।
৩. বহুদলীয় রাজনীতির সমাপ্তি : সামরিক সরকার দেশের সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করায় এখানে বহুদলীয় রাজনৈতিক চর্চা বন্ধ হয়ে যায়।
৪. সংসদীয় গণতন্ত্রের ধারা ব্যাহত : সামরিক শাসন সংসদীয় গণতন্ত্রের ধারাকে ব্যাহত করে।
৫. প্রাসাদ ষড়যন্ত্র বৃদ্ধি : নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক পন্থা বাধাগ্রস্ত হওয়ায় প্রাসাদ ষড়যন্ত্র বৃদ্ধি পায়।
৬. প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন উপেক্ষা: সামরিক শাসকগণ শক্তিশালী কেন্দ্রের স্বপক্ষে এবং প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ করে।
৭.. বাঙালি জাতিয়তাবাদের বিকাশ : সামরিক সরকার পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করায় বাঙালিদের মধ্যে জাতিয়তাবাদী আন্দোলন গড়ে উঠে এবং অবশেষে ১৯৭১ সালে তারা স্বাধীনতা লাভ করে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায়, পাকিস্তানের সামরিক শাসনকে গ্রহণযোগ্য করার জন্য সামরিক কর্তৃপক্ষ সর্বপ্রকার উদ্যোগ নিলেও এটি ছিল চূড়ান্তভাবে ধ্বংসাত্মক। এটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক মূল্যবোধকে ভেঙে দেয়। সংসদীয় রীতিকে বাধাগ্রস্ত করে।