শরিকানা (ভাগা) কুরবানি প্রসঙ্গে কিছু কথা। পাঠ -৪

কেউ কেউ বলেন, সফর ছাড়া শরিক কুরবানির বর্ণনা শুধুমাত্র একটি হাদীসে রয়েছে। সেটা হলো সুনানু আবী দাউদের ২৮০৮ নং হাদীস। তাই তারা এই হাদীসকে “ব্যাখ্যাশূন্য হাদীস” বলে সফরের হাদীসগুলো দিয়ে ব্যাখ্যা করে থাকেন যে, শরিক কুরবানি কেবলমাত্র সফরের সাথে খাস! তাঁরা যেন আরেকবার ভালো করে বাকি হাদীসগুলো দেখে নেন! আল্লাহ তাঁদেরকে হক বুঝার তাওফীক্ব দান করুন। আমীন।

·
চতুর্থত, শরিক কুরবানি সফরে সংঘটিত হওয়ার জন্য সেটাকে সফরের সাথেই খাস করলে, যত কিছু নাবী ﷺ ও সাহাবীগণ কর্তৃক সফরে ঘটেছে তার সবগুলোকেই ওই সফরের সাথে খাস করা জরুরি হয়ে যাবে। আর এ অবস্থায় শরিয়তের বহু মাসআলাহ আমল থেকে বাদ পড়ে যাবে। অথবা যে সমস্ত দলিল বাহ্যিকভাবে কোনো কারণের সাথে জড়িত, কিংবা কোনো গুণ বা বৈশিষ্ট্য দ্বারা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত—সেগুলোকেও সেই কারণ ও গুণ বা বৈশিষ্ট্যের সাথে খাস করে দেওয়া অপরিহার্য হয়ে দাঁড়াবে। যেমন—

তায়াম্মুমের বিধান অবতীর্ণ হয়েছে সফরে। আম্মিজান ‘আইশাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহা) বলেছেন যে, আমরা রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সঙ্গে এক সফরে বের হলাম, বাইদা কিংবা যাতুল জাইশ নামক স্থানে পৌঁছার পর আমার গলার হার হারিয়ে গেল। তা খোঁজার জন্যে রাসূল ﷺ সেখানে অবস্থান করলেন এবং লোকেরাও তাঁর সঙ্গে অবস্থান করল। সেখানে কোনো পানি ছিল না এবং তাদের সঙ্গেও পানি ছিল না। এরপর লোকেরা আবূ বাকর আস-সিদ্দীক্ব (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু)’র কাছে আসল এবং বলল, ‘আয়িশাহ যা করেছেন, আপনি তা দেখেছেন কি? তিনি রাসূলকে ﷺ এবং সকল লোককে আটকে রেখেছেন; অথচ সেই জায়গায় পানি নেই, আবার তাদের সঙ্গেও পানি নেই।

রাসূল ﷺ আমার ঊরুতে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছিলেন। এমতাবস্থায় আবূ বাকর (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) এলেন এবং বললেন, তুমি রাসূল ﷺ কে এবং সকল লোককে আটকে রেখেছো; অথচ সেই জায়গায় পানি নেই, আবার তাদের সঙ্গেও পানি নেই। ‘আইশাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহা) বলেন, আবূ বাকর (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) আমাকে ভর্ৎসনা করলেন এবং আল্লাহ যা চেয়েছেন তা বললেন। তারপর তাঁর হাত দিয়ে আমার কোমরে আঘাত করতে লাগলেন। আমার কোলে রাসূল ﷺ এর অবস্থানই কেবল আমাকে নড়াচড়া করতে বাধা দিল। পানিবিহীন অবস্থায় ভোরে রাসূল ﷺ ঘুম থেকে উঠলেন। তখন আল্লাহ তা‘আলা তায়াম্মুমের আয়াত অবতীর্ণ করলেন, এরপর সবাই তায়াম্মুম করল। তখন উসাইদ ইবনু হুদ্বাইর বললেন, ‘হে আবূ বাকরের বংশধর, এটাই আপনাদের কারণে পাওয়া প্রথম বরকত নয়!’

‘আইশাহ (রদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহা) বললেন, ‘যে উটের উপর আমি ছিলাম, তাকে আমরা উঠালাম, তখন দেখি হারটি তার নিচে।’ [সাহীহ বুখারী, হা/৪৬০৭]

তাদের ঠুনকো যুক্তি অনুযায়ী তায়াম্মুমের বিধান সফরের সাথে খাস হয়ে যাবে, মুক্বীম অবস্থায় তা বিধিসম্মত হবে না! আল-‘ইয়াযু বিল্লাহ। শরিয়তে এরকম আরও অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে। সুতরাং, ‘উলামাদের অনুসরণ না করে নিজেরা দুএকটি আয়াত ও হাদীসকে সামনে রেখে তার বাহ্যিক অর্থ দ্বারা দলিল পেশ করলে, সত্য পর্যন্ত পৌঁছা যাবে না; চিরদিন বাতিলের সাথেই থাকতে হবে। আল্লাহ আমাদেরকে হেফাজত করুন। আমীন।

·
পঞ্চমত, বিশুদ্ধ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে যে, একটি উট দশটি ছাগলের সমান। বিধায় শরিক কুরবানি মুক্বীম-মুসাফির সর্বাবস্থায় বৈধ। দলিল—

রাফি‘ বিন খাদীজ (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, “তিহামার অন্তর্গত যুল হুলাইফাহ নামক স্থানে আমরা নাবী ﷺ এর সাথে অবস্থান করছিলাম। সে সময় আমরা (যুদ্ধলব্ধ সম্পদের অংশ হিসেবে) কিছু বকরি ও উট পেয়ে গেলাম। সাহাবীগণ (অনুমতির অপেক্ষা না করেই) তাড়াহুড়া করে পাত্রে গোশত চড়িয়ে দিলেন। পরে রাসূলুল্লাহ ﷺ এসে পাত্রগুলো উল্টিয়ে ফেলার নির্দেশ দিলেন। আর (বণ্টনকালে) প্রতি দশটি বকরিকে তিনি একটি উটের সমান ধার্য করলেন (ثُمَّ عَدَلَ عَشْرًا مِنْ الْغَنَمِ بِجَزُور)।” [সাহীহ বুখারী, হা/২৫০৭]

এই হাদীসকে কোনো কোনো ‘আলিম শরিক কুরবানির বৈধতার স্বপক্ষে দলিল হিসেবে পেশ করেছেন।

·
ষষ্ঠত, হাদীসের শারিহ তথা ভাষ্যকারগণের কেউই ওপরে উল্লিখিত হাদীসগুলোকে সফরের সাথে খাস করেননি। এমনকি বিশ্ববরেণ্য ‘আলিমগণও এই হাদীসগুলোকে সফরের সাথে নির্দিষ্ট করেননি। বরং হাদীসগুলো যে মুক্বীম-মুসাফির সর্বাবস্থায় শরিক কুরবানির বৈধতার ফাইদাহ (অবগতি) দেয়; তারা এটাই বুঝেছেন। এখন আমরা কয়েকজন জগদ্বিখ্যাত ‘আলিমে দ্বীনের ফাতওয়া সরল বাংলায় উপস্থাপন করার প্রয়াস পাব, ইনশাআল্লাহ।

·

❏ ‘আলিমগণের ফাতাওয়া:

১ম ফাত‌ওয়া:

হাম্বালী মাযহাবের প্রখ্যাত ফাক্বীহ, শাইখুল ইসলাম, ইমাম ‘আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ বিন কুদামাহ আল-মাক্বদিসী আল-হাম্বালী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬২০ হি.] বলেছেন,

ﻭﺗﺠﺰﺉ ﺍﻟﺒﺪﻧﺔ ﻋﻦ ﺳﺒﻌﺔ، ﻭﻛﺬﻟﻚ ﺍﻟﺒﻘﺮﺓ ﻭﻫﺬﺍ ﻗﻮﻝ ﺃﻛﺜﺮ ﺃﻫﻞ ﺍﻟﻌﻠﻢ . ﺭﻭﻱ ﺫﻟﻚ ﻋﻦ ﻋﻠﻲ ﻭﺍﺑﻦ ﻋﻤﺮ ﻭﺍﺑﻦ ﻣﺴﻌﻮﺩ ﻭﺍﺑﻦ ﻋﺒﺎﺱ ﻭﻋﺎﺋﺸﺔ ﺭﺿﻲ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻨﻬﻢ، ﻭﺑﻪ ﻗﺎﻝ ﻋﻄﺎﺀ ﻭﻃﺎﻭﺱ ﻭﺳﺎﻟﻢ ﻭﺍﻟﺤﺴﻦ ﻭﻋﻤﺮﻭ ﺑﻦ ﺩﻳﻨﺎﺭ ﻭﺍﻟﺜﻮﺭﻱ ﻭﺍﻷﻭﺯﺍﻋﻲ ﻭﺍﻟﺸﺎﻓﻌﻲ ﻭﺃﺑﻮ ﺛﻮﺭ، ﻭﺃﺻﺤﺎﺏ ﺍﻟﺮﺃﻱ.

“একটি উট সাত ভাগে, অনুরূপভাবে একটি গরুও সাত ভাগে কুরবানি দেওয়া জায়েজ। এটা অধিকাংশ ‘আলিমের বক্তব্য। এমনটি বর্ণিত হয়েছে—সাহাবী আলী, ইবনু ‘উমার, ইবনু মাস‘ঊদ, ইবনু ‘আব্বাস, ‘আইশাহ প্রমুখ (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহুম) থেকে। আর এই কথাই বলেছেন—তাবি‘ঈ ‘আত্বা, ত্বাঊস, সালিম, হাসান বাসরী, ‘আমর বিন দীনার, সুফইয়ান সাওরী, আওযা‘ঈ, শাফি‘ঈ, আবূ সাওর, আবূ হানীফাহ ও তাঁর ছাত্রবর্গ।” [ইমাম ইবনু কুদামাহ (রাহিমাহুল্লাহ), আল-মুগনী; খণ্ড: ১৩; পৃষ্ঠা: ৩৬৩-৩৬৪; মাসআলাহ নং: ১৭৫০; দারু ‘আলামিল কুতুব, রিয়াদ কর্তৃক প্রকাশিত; সন: ১৪১৭ হি./১৯৯৭ খ্রি. (৩য় প্রকাশ)]

·
২য় ফাতওয়া:

শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নাওয়াউয়ী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] বলেছেন,

يجوز أن يشترك سبعة في بدنة أو بقرة للتضحية، سواء كانوا كلهم أهل بيت واحد أو متفرقين، أو بعضهم يريد اللحم فيجزئ عن المتقرب، و سواء كان أضحية منذورة أو تطوعا، هذا مذهبنا و به قال أحمد و داود و جماهير العلماء.

“কুরবানির উদ্দেশ্যে সাত ব্যক্তির একটি উটে কিংবা গরুতে শরিক হওয়া জায়েজ। চাই তারা সকলে এক পরিবারের হোক বা বিভিন্ন পরিবারের। কিংবা কারও গোশত খাওয়ার উদ্দেশ্য থাক (আর অন্যদের নৈকট্য উদ্দেশ্য); এমতাবস্থায় নৈকট্য কামনাকারীর পক্ষ থেকে তা (কুরবানি হিসেবে) যথেষ্ট হবে। আর চাই সে কুরবানিটা মানতের হোক কিংবা নফল কুরবানি (সর্বাবস্থায় শরিক কুরবানি জায়েজ)। এটাই আমাদের মাযহাব এবং এটাই আহমাদ, দাঊদ ও অধিকাংশ ‘উলামার কথা।” [ইমাম নাওয়াউয়ী (রাহিমাহুল্লাহ), কিতাবুল মাজমূ‘ শারহুল মুহাযযাব লিশ শীরাযী; খণ্ড: ৮; পৃষ্ঠা: ৩৭১; মাকতাবাতুল ইরশাদ, জেদ্দা কর্তৃক প্রকাশিত (সন-তারিখ বিহীন)]

Leave a Comment