লর্ড উইলিয়াম বেন্টিংকের সামাজিক সংস্কার পর্যালোচনা কর, লর্ড উইলিয়াম বেন্টিংকের সংস্কারসমূহ আলোচনা কর, লর্ড রিপনের সংস্কারসমূহ আলোচনা কর

লর্ড উইলিয়াম বেন্টিংকের সামাজিক সংস্কার পর্যালোচনা কর, লর্ড উইলিয়াম বেন্টিংকের সংস্কারসমূহ আলোচনা কর, লর্ড রিপনের সংস্কারসমূহ আলোচনা কর


ভারতবর্ষের ইতিহাসে দেখা যায়, ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পলাশীর যুদ্ধের মাধ্যমে নিজেদের আধিপত্য কায়েম করেন এবং তা প্রায় বিভিন্ন কৌশল প্রয়োগ করে দুইশত বছর টিকিয়ে রাখেন। তাদের সুদীর্ঘ শাসনামলে অনেক গভর্নর জেনারেল ইংল্যান্ডের ডাইরেক্টর সভা কর্তৃক মনোনীত হয়ে ব্রিটিশ শাসনকে টিকিয়ে রাখার জন্য এসেছিলেন। এদেরই একজন ছিলেন লর্ড উইলিয়াম বেন্টিংক । তিনি ১৮২৮ সালে লর্ড আমহাস্টের পর গভর্নর জেনারেল হয়ে ভারতবর্ষে আসেন। কিন্তু গতানুগতিক অন্যান্য গভর্নর জেনারেলের তুলনায় তিনি ছিলেন ব্যতিক্রম। তিনি পূর্ব অভিজ্ঞতার আলোকে যুদ্ধবিগ্রহ ত্যাগ করে সংস্কার কার্য দ্বারা ভারতবাসীর নৈতিক মঙ্গল সাধন করে শাসনব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে চান ।


লর্ড বেন্টিংকের গভর্নর জেনারেল নিয়োগের পটভূমি :

লর্ড উইলিয়াম বেন্টিংক প্রথম জীবনে (দঃ উইলিয়াম ক্যাভেন্ডিশ বেন্টিংক) প্রথম জীবনে মাদ্রাজের গভর্নর হয়ে ভারতে এসেছিলেন। কিন্তু তার শাসনামলে (১৮০০- ০৭) তোলারে বিদ্রোহ দেখা দিলে তাকে স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের আদেশ দেওয়া হয়। অনেকের মতে, তাকে স্বদেশে ডেকে নিয়ে কর্তৃপক্ষ অনেকটা ভুল করেছিলেন। নেপোলিয়ন পূর্বে নেপোলিয়ন বিজেতা ডিউক অব ওয়েলিংটনের অধীনে সৈনিক হিসেবেও কাজ করেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে কোন সামরিক কূটচাল বা সামরিক প্রতিভার পরিচয় দিতে পারেন নি। তবে তাঁর ভারত সম্পর্কে অভিজ্ঞতা ছিল প্রচুর। তাই দ্বিতীয়বার ভারতে গভর্নর জেনারেল হয়ে আসলে এ অভিজ্ঞতা কাজে লাগান। এছাড়া পূর্বে মাদ্রাজের গভর্নর থাকাকালীন তাঁর শাসনব্যবস্থার যে কোন ত্রুটি ঘটে নি একথা তিনি স্বদেশী কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে তারপর ১৮২৮ সালে লর্ড আমহাস্টের পর ভারতে গভর্নর জেনারেল হয়ে আসেন। তিনি পূর্ব অভিজ্ঞতা দ্বারা বুঝতে পারেন যে, ভারতে ব্রিটিশ শাসনের ভিত্তিকে মজবুত করতে হলে এদেশীয় জনসাধারণের সমর্থনের প্রয়োজন সর্বাগ্রে। তাই তিনি কৌশল হিসেবে সংস্কারকার্যকে বেছে নেন। তাই অনেকে তাঁর প্রশংসা সম্পর্কে মুক্ত মনের অধিকারী, ভিক্টোরিয়ার যুগের মূর্ত প্রতীক, উদার শাসক ও সংস্কারক আখ্যা দেন ।

লর্ড বেন্টিংকের সংস্কার :

লর্ড উইলিয়াম বেন্টিংক-এর সংস্কার ভারত ইতিহাসে বিখ্যাত। তাঁর সংস্কার কার্যের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিল সামাজিক ক্ষেত্রে সমকালে যে অন্যায় অবিচার বিরাজিত ছিল তা দূর করা। তবে তিনি শাসন, বিচার, শিক্ষা ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও উদার মনোভাবের প্রমাণ দেন।

নিম্নে তাঁর শাসনামলের গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারকার্য-সামাজিক সংস্কার সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া হল ঃ

১. সামাজিক সংস্কার : বেন্টিংকের সামাজিক সংস্কার ছিল ভারত ইতিহাসে প্রশংসনীয়। তাঁর সামাজিক সংস্কারের বিভিন্ন বিষয়ের বর্ণনা নিচে দেওয়া হল ঃ


ক. সতীদাহ প্রথার বিলোপ সাধন : ভারতবর্ষে পূর্ব থেকে সতীদাহ প্রথা প্রচলিত ছিল। সতীদাহ প্রথার মূল বিষয় হল যে, স্বামী মারা গেলে একই চিতায় স্ত্রীকেও ইচ্ছা বা অনিচ্ছা সত্ত্বেও পুড়িয়ে মারা। এ সতীদাহ প্রথা আবার দু ধরনের ছিল যথা : হমরণ প্রথা : যদি স্বামী-স্ত্রী বসবাস করাকালীন কোন সময় স্বামী আগে মারা যায় তাহলে ঐ একই চিতায় স্ত্রীকেও সামাজিক বিধান অনুসারে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছা সত্ত্বেও পুড়িয়ে মারা হতো। এ প্রথা ছিল একেবারে অমানবিক ।


i. ii. অনুসরণ প্রথা : এ প্রথার মূল বিষয় ছিল যে, স্বামী দূর দেশে বা অন্য কোন অজ্ঞাত স্থানে মারা গেলে এবং সে সংবাদ প্রচারিত হলে বিধবা স্ত্রীকে একাকী ইচ্ছা বা অনিচ্ছা সত্ত্বেও পুড়িয়ে মারা হতো। এ প্রথা ছিল ন্যক্কারজনক। তাই বেন্টিংকের শাসনামলে তা বন্ধ করার ব্যবস্থা করা হয় । ভারতের প্রগতিশীল ব্যক্তি মাত্রই এ বীভৎস ও অমানুষিক প্রথা অনুষ্ঠানের বিরোধিতা করতে লাগলেন। লর্ড কর্নওয়ালিসের শাসনকাল থেকে কোম্পানি সতীদাহ প্রথা উঠে দেওয়ার জন্য সচেষ্ট ছিলেন। এজন্য ইংরেজ কর্মচারীগণকে এ বিষয়ে মনোযোগী হতে বলা হয়েছিল। লর্ড ওয়েলেসলি সতীদাহ প্রথা নিবারণার্থে সদর নিয়ামত আদালতের জজদের অভিমত এ ব্যাপারে জানতে চান। তারা এ প্রথা একেবারে উঠিয়ে না দিয়ে কতকগুলো কঠোর নিয়মকানুন দ্বারা নিয়ন্ত্রণের সুপারিশ করেন।

লর্ড মিন্টোর শাসনকালে এ সুপারিশ কার্যকরী করার উদ্দেশ্যে কোন ম্যাজিস্ট্রেট বা পুলিশ কর্মচারীর বিনা অনুমতিতে সতীদাহ নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করা হয়েছিল। লর্ড হেস্টিংসের শাসনামলে ডাইরেক্টর সভা এ অমানুষিক প্ৰথা বিলোপের নির্দেশ প্রেরণ করেছিলেন। কিন্তু ভারতীয়দের ধর্মে আঘাত দেওয়া সমীচীন হবে না মনে করে লর্ড আমহার্স্ট সতীদাহ নিবারণের চেষ্টা করতে সাহসী হন নি। লর্ড বেন্টিংক ক্ষমতা গ্রহণ করে এ প্রথা বিলোপের জন্য কৃৎসংকল্প হন। তিনি এ কার্যে ভারতীয় শিক্ষিত উদারপন্থি হিন্দু নেতৃবর্গ ও সদর নিয়ামত আদালতের জজদের অকুণ্ঠ সমর্থন লাভ করেছিলেন। তাই তিনি ১৯২৯ সালে আইন পাস করেন (সতীদাহ নিষিদ্ধ আইন)। তবে তিনি কেবল আইন পাস করে ক্ষান্ত হন নি, তা অমান্যকারীদের শাস্তির বিধানও রাখেন।


খ. ঠগি দমন : লর্ড বেন্টিংকের অন্যতম উল্লেখযোগ্য অবদান হল ঠগি দমন। ঠগিদের অত্যাচার বহু পূর্ব হতেই নিরাপদে চলার পথে অসুবিধা সৃষ্টি করেছিল। মুঘল সম্রাট আকবর তাঁর শাসনামলে এটোয়া জেলার পাঁচশত ঠগিকে হত্যা করেছিলেন। ফরাসি পর্যটক খেতেনা-এর বর্ণনা থেকে আওরঙ্গজেবের আমলে ঠগিদের অত্যাচারের কথা পাওয়া যায়। ইংরেজ শাসনের প্রথম দিকেও ঠগিদের অত্যাচারে একস্থান থেকে অন্যস্থানে যাতায়াত ছিল খুবই ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়। অতর্কিত আক্রমণ করে তারা পথিককে ফাঁস ( গলায়) লাগিয়ে হত্যা করে সমস্ত কিছু লুটে নিত। বেন্টিংক এ ঠগি দস্যুদের দমন করার দায়িত্ব কর্নেল শ্রীম্যানের উপর অর্পণ করেন। কর্নেল শ্রীম্যান ফেরিহিয়া নামে জনৈক ঠগির মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে তাদের গোপন ঘাঁটিতে আক্রমণ চালান। এতে কারো কারো মতে প্রায় ১৫০০ (পনের শত) জন ঠগি মারা যায় । এভাবে তিনি ভারতীয় জনসাধারণকে ঠগিদের অত্যাচার থেকে মুক্ত করেন।


গ. বিবিধ ঃ উপরিউক্ত সংস্কার ছাড়াও বেন্টিংক সামাজিক ক্ষেত্রে আরো অন্যান্য যে কুসংস্কার ছিল তা দূর করেনা। পূর্বে ভারতীয়রা প্রথম সন্তানকে গঙ্গায় বিসর্জন দিত, বিবাহ দিতে অসুবিধা বিধায় কন্যা সন্তানকে হত্যা করত এবং কোন কোন অঞ্চলে নরবলি প্রচলিত ছিল। বেন্টিংক এ নরবলি-এর উচ্ছেদসহ এসব প্রথা বাতিল করেন। তবে এ ক্ষেত্রে কেবল আইন পাস করে তিনি ক্ষান্ত ছিলেন না, আইন অমান্যকারীকে শাস্তি দিয়েও এগুলো কার্যকরী করেন।


মূল্যায়ন : লর্ড উইলিয়াম বেন্টিংক ভারতবাসীর জন্য তথা ভারতীয় জনসাধারণের নৈতিক কল্যাণের জন্য আজীবন/গভর্নর জেনারেল থাকাকালীন আপ্রাণ চেষ্টা করে গেলেও তিনি সমালোচনার ঊর্ধ্বে ছিলেন না। তাঁর সমালোচনা করতে গিয়ে ঐতিহাসিক ঘনটন বলেন, বেন্টিংক নিজের যশ ও খ্যাতির প্রতি অধিকতর মনোযোগী ছিলেন। তিনি তাঁর শাসনামলের বিবরণে ফলাফল শূন্য বলেছেন। তিনি বলেন, উনিশ শতকের গোড়ায় যেসব গভর্নর জেনারেল ভারতে আসেন তাদের কেউ বেন্টিংকের মত নিজের খ্যাতি লাভের জন্য ভারতবাসীর স্বার্থকে গৌণ স্থান দেন নি। তিনি আরো যুক্তি দেখান যে,


১. তিনি শাসনব্যবস্থায় ভারতবাসীর অংশীদারিত্বের কথা বললেও হাতে কলমে তার কিছুই ছিল না ।


২. ভারতীয়দের সরকারি চাকরিতে নিয়োগের তিনি নিয়ম করলেও তা পুরোপুরি কার্যকরী হয় নি।

৩. ভারতবাসীর মঙ্গল সাধনের জন্য যদিও বেন্টিংক অনেক হিতবাদী মতামত দেন তবুও একমাত্র সতীদাহ প্রথা বন্ধ ও ঠগি দমন ছাড়া তেমন কিছুই করতে পারেন নি


৪. বেন্টিংক রাজা রামমোহন রায়ের পথিকৃত হিসেবে এ হাওয়ায় পাল খাটিয়ে দু একটি সামাজিক ও শিক্ষা বিষয়ক সংস্কার সাবধানতার সাথে সম্পাদন করেন মাত্র। কোন আমূল পরিবর্তন সাধনের চেষ্টা তিনি করেন নি।


রমেশচন্দ্র দত্তের মতে, বেন্টিংকের তথাকথিত সংস্কারবাদের আড়ালে ইংল্যান্ডের শিল্পপতি, বণিক ও ধনতন্ত্রীদের স্বার্থরক্ষার চেষ্টা করা উচিত। তবে এত কিছু সত্ত্বেও তাঁর সংস্কার কার্য প্রশংসনীয় ছিল বলা যায়। ভারতীয় সমাজে কুসংস্কার দূরীকরণ, ভারতীয় ও ইংরেজ কর্মচারীর মধ্যে বৈষম্য দূরীকরণ, ভারতীয়দের শিক্ষাদীক্ষার উন্নতি সাধন প্রভৃতির জন্য লর্ড মেকলে উইলিয়াম বেন্টিংকের প্রশংসা করতে গিয়ে বলেন, তিনিই সর্বপ্রথম প্রাচ্য দেশীয় অত্যাচারী শাসনের

স্থলে ব্রিটিশ স্বাধীনতার আস্বাদ ভারতবাসীকে দেন। তাই নিরপেক্ষ বিচারে এ কথা স্বীকার করতে হয় যে, তিনি কোম্পানির আর্থিক অনটন দূর করে কোম্পানির বাৎসরিক আয় ব্যয়ের ঘাটতি পূরণ করে প্রতি বছর যথেষ্ট পরিমাণ রাজস্ব উদ্বৃত্ত রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। এ ছাড়া প্রশাসনিক, সামাজিক, শিক্ষা সংক্রান্ত সংস্কার সাধনের পশ্চাতে জনকল্যাণের ইচ্ছাই ছিল তাঁর মুখ্য উদ্দেশ্য । এসকল কারণে বেন্টিংক ভারতবাসীর কৃতজ্ঞতা অর্জন করেছেন।

লর্ড উইলিয়াম বেন্টিংকের সংস্কারসমূহ আলোচনা কর ।

লর্ড বেন্টিংকের সংস্কারসমূহ : ভারতের ইতিহাসে সংস্কার কার্যের জন্য তিনি বিখ্যাত। নিম্নে তার সংস্কার কার্যাদির বিবরণ দেওয়া হল ঃ


১. অর্থনৈতিক সংস্কার ঃ বেন্টিংকের সংস্কারসমূহের মধ্যে অন্যতম হল অর্থনৈতিক কাঠামোর পুনর্গঠন করা। অবশ্য ডাইরেক্টর সভা থেকেও তার উপর ব্যয় সংকোচন ও যুদ্ধ নীতি ত্যাগের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত ছিল। বেন্টিংক শাসনকার্য পরিচালনার অসুবিধা ছাড়া বিভিন্ন সরকারি অফিসের অপ্রয়োজনীয় কর্মচারী ছাঁটাই করেন। শান্তির সময় অর্থাৎ যুদ্ধ যখন চলছে না তখন সামরিক কর্মচারীদের যে অর্ধেক ভাতা দেওয়ার প্রচলন ছিল একে বলে বাট্টাকরণ ব্যবস্থা।

বেন্টিংক এ বাট্টাকরণ ব্যবস্থা রহিত করেন। এছাড়া উচ্চস্তরের বেসামরিক কর্মচারীদের বেতন তিনি হ্রাস করেন। এ কাজের জ অনেকের কাছে তিনি অপ্রিয় হন কিন্তু ডাইরেক্টর সভার অনুমোদন থাকায় কোন অসুবিধা হয় নি। বেন্টিংক কর্নওয়ালিসের রাজত্বকালের প্রাদেশিক আপিল কোর্ট বাতিল করে উত্তর প্রদেশে জমি জরিপ ও রাজস্ব ব্যবস্থা দ্বারা আর্থিক সচ্ছলতা আনেন। পূর্বে অনেক জমি অবৈধভাবে নিষ্কর বলে দেখানো হতো।

বেন্টিংক এটা বাতিল করে সেগুলোর উপর কর বসান। তিনি মাদ্রাজ ও যুক্ত প্রদেশ এ জমি বন্দোবস্ত দিয়ে কোম্পানির আয় বৃদ্ধি করেন। তিনি মালবে অন্যায়ভাবে উৎপন্ন আফিমের উপর শুল্ক আরোপ করেন। বাণিজ্য সংক্রান্ত উন্নতির জন্য সিন্ধুর আমির ও পাঞ্জাবের রনজিৎ সিংহের সাথে পরি করে ইংরেজ বণিকদের ব্যবসায় বাণিজ্যের পথ উন্মুক্ত করেন। তিনি চা, কয়লা, লোহা ও দুর্লভ খনিজ দ্রব্যের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এসকল ব্যবস্থা গ্রহণ করার ফলে তার গভর্নর জেনারেল থাকাকালীন পূর্বের যে ঘাটতি ছিল তা পূরণ হয়েও ১৫ লক্ষ টাকা উদ্বৃত্ত দেখাতে সক্ষম হন।


২. শাসনতান্ত্রিক ও বিচার সংস্কার : প্রশাসনিক সংস্কার বা শাসন ও বিচার সংক্রান্ত সংস্কার বেন্টিকের রাজত্বকালের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। বেন্টিংক ত্রুটিপূর্ণ বিচার ও শাসনব্যবস্থার সংস্কার সাধনের জন্য কর্নওয়ালিস প্রবর্তিত প্রাদেশিক বিচারালয় ও আপিল আদালতগুলো তুলে দিয়ে বিচারকার্যে অযথা বিলম্বরোধের চেষ্টা করেন। এছাড়া ফৌজদারি বিচারের ভার জেলা কালেক্টেরের উপর অর্পণ করেন। কেন্টিংক বিচারালয়গুলোতে ফারসি ভাষার পরিবর্তে স্থানীয় ভাষা ব্যবহারের নির্দেশ দেন। তিনি ১৮৩৩ সালের চার্টার এ্যাক্ট পরিবর্তন করে সর্বপ্রথম ভারতীয়দেরকে গুণানুযায়ী বিচার ও শাসন বিভাগের উচ্চপদে নিয়োগ করেন। তার সময় ভারতীয়দের জন্য ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও সাবজর্জের পদ সৃষ্টি করা হয়। বেন্টিংক ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় জুরি ব্যবহার প্রবর্তন করে ভারতীয়দের জুরি হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন। দেশের শাসনকার্য সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য সমগ্র দেশকে ২০টি বিভাগে ভাগ করে প্রতিটি বিভাগে একজন করে বিভাগীয় কমিশনার নিযুক্ত করেন।

তার সময় তার পৃষ্ঠপোষকতায় ৬ জন নবনিযুক্ত আইন সদস্যের প্রচেষ্টায় বিখ্যাত ভারতীয় পেনাল কোড রচিত হয়। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টরগণের দায়িত্ব একই ব্যক্তির উপর অর্পণ করা হয়। এছাড়া কোম্পানির কর্মচারীদের কাজকর্ম সম্পর্কে তদন্ত করার জন্য একটি ব্যবস্থা তিনি করেন। তিনি রাজস্ব আদায়ের সুবিধার জন্য এলাহাবাদে একটি বোর্ড অব রিভিনিউ স্থাপন করেন। বেন্টিংকের শাসনামলে বিচার ও শাসন ক্ষেত্রে এ সমস্ত ব্যবস্থা ও সংস্কার সাধনের ফলে কোম্পানির শাসনব্যবস্থা পূর্বের তুলনায় অনেক উন্নত হয় ।


৩. সামাজিক সংস্কার ঃ বেন্টিংকের সংস্কার কার্যের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হল সামাজিক ক্ষেত্রে অবদান রাখা। সামাজিক সংস্কারের জন্যই বেন্টিংক ভারত ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন। ১৮২৯ সালে তিনি সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করেন। সে সময় স্বামী মারা গেলে একই চিতায় স্ত্রীকেও ইচ্ছা বা অনিচ্ছা সত্ত্বেও পুড়ে মারা হতো। সতীদাহ প্রথা ছিল দু’ ধরনের একটা ছিল। সহমরণ অর্থাৎ স্বামী মারা গেলে একই চিতায় স্ত্রীকে ইচ্ছা বা অনিচ্ছা সত্ত্বেও পুড়ে মারা। অন্যটি ছিল দূর দেশে স্বামী মারা গেলে স্ত্রীকে একাকী ইচ্ছা বা অনিচ্ছা সত্ত্বেও পুড়িয়ে মার হতো। এ প্রথা ছিল একবারে অমানবিক। প্রগতিশীল ব্যক্তি মাত্রই এ বীভৎস ও অমানুষিক অনুষ্ঠানের বিরোধিতা করতে লাগলেন। লর্ড কর্নওয়ালিসের শাসনকাল থেকে কোম্পানি সতীদাহ প্রথা উঠিয়ে দেওয়ার জন্য সচেষ্ট ছিলেন। এজন্য ইংরেজ কর্মচারীগণকে এ বিষয়ে মনোযোগী হতে বলা হয়েছিল।


ইতঃপূর্বে লর্ড ওয়েলেসলি সতীদাহ প্রথা নিবারণার্থে সদর নিয়ামত আদালতের মতামত জানতে চেয়েছিলেন। তারা এ প্রথা একবারে উঠিয়ে না দিয়ে কতকগুলো কঠোর নিয়মকানুন দ্বারা নিয়ন্ত্রণের সুপারিশ করেছিলেন। লর্ড মিন্টোর শাসনকালে এ সুপারিশ কার্যকরী করার উদ্দেশ্যে কোন ম্যাজিস্ট্রেট বা পুলিশ কর্মচারীর বিনা অনুমতিতে সতীদাহ নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করা হয়েছিল। লর্ড হেস্টিংসের শাসনামলে ডাইরেক্টর সভা এ অমানুষিক প্রথা বিলোপের নির্দেশ প্রেরণ করেছিলেন।

কিন্তু ভারতীয়দের ধর্মে আঘাত দেওয়া সমীচীন হবে না মনে করে লর্ড আমহাস্ট সতীদাহ নিবারণের চেষ্টা করতে সাহসী হন নি । লর্ড বেন্টিংক অবশ্য সতীদাহ প্রথা নিবারণের জন্য কৃৎসংকল্প ছিলেন। তিনি শিক্ষিত উদারপন্থি হিন্দু নেতৃবর্গ এবং সদর নিয়ামত আদালতের জজদের অকুণ্ঠ সমর্থন লাভ করেছিলেন। পিন্স দারকানাথ ঠাকুর ও রামমোহন রায়ের নাম এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। ১৮২৯ সালে বেন্টিংক এক আদেশের মাধ্যমে নৃশংস সতীদাহ প্রথার বিলোপ সাধন করার চেষ্টা করেন। এতে তিনি শুধু আইন পাস করে ক্ষান্ত হন নি, আইন অমান্যকারীদের শাস্তিরও বিধান করেন।


বেন্টিংকের সামাজিক সংস্কারের একটি অন্যতম দিক হল ঠগি দমন। ঠগিদের অত্যাচার বহু পূর্ব হতেই নিরাপদ প চলার অসুবিধা সৃষ্টি করেছিল। মুঘল সম্রাট আকবর এটোয়া জেলায় পাঁচ শত ঠগিকে হত্যা করেছিলেন। ফরাসি পর্যটক খেতেনা-এর বর্ণনা থেকে আওরঙ্গজেবের আমলে ঠগিদের অত্যাচারের কথা পাওয়া যায়। ইংরেজ শাসনের প্রথম দিনের ঠগিদের অত্যাচারে একস্থান থেকে অন্যস্থানে যাতায়াত বিপজ্জনক হয়ে উঠেছিল। তারা অতর্কিত আক্রমণ করে गा লাগিয়ে হত্যা করে তাদের অর্থ ও জিনিস পত্রাদি আত্মসাৎ করত। বেন্টিংক কর্নেল শ্রীম্যানকে ঠগিদের দমনের ভার অর্পন করেন। শ্ৰীম্যান ফেরিস্মিয়া নামে জনৈক ঠগির কাছ থেকে ঠগিদের গোপন ঘাঁটির সংবাদ পেয়ে কঠোর হস্তে তাদের দমন করেন। ফলে অনেকের মতে প্রায় দেড় হাজার ঠগি দস্যুদল মারা যায়। ফলে জনসাধারণ ঠগি নামে দস্যুদের অত্যাচার থেকে মুক্তি পান এবং শান্তিতে বেড়াতে পারতেন।


বেন্টিংকের সময় সামাজিক ক্ষেত্রে আরো কিছু কুসংস্কার ছিল যা তিনি দূর করেন। তৎকালীন হিন্দু রীতি অনুসারে প্রথম সন্তানকে গঙ্গায় বিসর্জন দেওয়া। বিবাহ দিতে অসুবিধা বিধায় কন্যা সন্তানকে হত্যা এবং কোন কোন অঞ্চলে নরবলি প্রচলিত ছিল। বেন্টিংক এসকল অমানবিক প্রথার বিলোপ সাধন করেন তথা এ প্রথাগুলোর বিলোপ সাধন করার জন্য তিনি কেবল আইন পাস করে ক্ষান্ত হন নি। আইন অমান্যকারীদের শাস্তির ব্যবস্থাও করেছিলেন।


৪. শিক্ষা সংস্কার : লর্ড বেন্টিংক শিক্ষা ক্ষেত্রে যে অবদান রাখেন তা ছিল ভারত ইতিহাসে বিখ্যাত। বেন্টিংকের শিক্ষা সংস্কারের অন্যতম হল পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রবর্তন করা। ১৮১৩ সালের সনদ আইন অনুযায়ী কোম্পানি ভারতীয়দের শিক্ষার জন্য বাৎসরিক অন্তত এক লক্ষ টাকা ব্যয় করতে বাধ্য ছিলেন। এ অর্থ কেবলমাত্র সংস্কৃত ফারসি প্রথা (প্রাচ্য) ভাষা শিক্ষার জন্য বায় হতো। ১৮৩৩ সালে বেন্টিংক ইংরেজি ভাষায় শিক্ষাদানের জন্য অর্থ ব্যয়িত হবে স্থির করলে একসূত্রে তীব্র বিতর্কের সৃষ্টি হয়। তদানীন্তন ব্রিটিশ সেক্রেটারি গ্রিপ ও বিখ্যাত ঐতিহাসিক উইলিসন প্রাচ্য ভাষা শিক্ষার জন্য অর্থ ব্যয় করার পক্ষপাতী ছিলেন। গভর্নর জেনারেলের কাউন্সিলের অন্যতম সদস্য লর্ড মেকলে ছিলেন ইংরেজি শিক্ষাদানের পক্ষপাতী। রাজা রামমোহন রায় প্রমুখ কলকাতার শিক্ষিত হিন্দু সমাজ পাশ্চাত্য শিক্ষায় পক্ষপাতী ছিলেন।

১৮৩৫ সালের ৭ মার্চ বেন্টিংক ও তার কাউন্সিল ইংরেজি শিক্ষার জন্য সরকারি অর্থ ব্যয়িত হবে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন। ফলে সেই বছরেই অর্থাৎ ১৮৩৫ সালে লর্ড বেন্টিংকের প্রচেষ্টায় কলিকাতায় মেডিক্যাল কলেজ ও বোম্বাই এর এলফিনস্টোন ইনস্টিটিউশন স্থাপিত হয়। ফলে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার অবাধ প্রসারের পথ উন্মুক্ত হয়।
মূল্যায়ন : লর্ড উইলিয়াম বেন্টিংক ভারতবাসীর জন্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে দক্ষতার প্রমাণ দিলেও সমালোচনার উর্ধ্বে ছিলেন না । ঐতিহাসিক ঘনটন-এর মতে, বেন্টিংক নিজের যশ ও খ্যাতির প্রতি অধিকতর মনোযোগী ছিলেন। তিনি তার শাসনামলকে ফলাফল শূন্য বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, উনিশ শতকের গোড়ায় যেসব গভর্নর জেনারেল ভারতে আসেন তাদের কেউ বেন্টিংকের মত নিজের খ্যাতি লাভের জন্য ভারতবাসীর স্বার্থকে গৌণ স্থান দেন নি।

তিনি যে সকল কার্য করেন-
ক. তিনি শাসনব্যবস্থায় ভারতবাসীর অংশীদারিত্বের কথা বললেও হাতে কলমে তা কিছু ছিল না।
খ. ভারতীয়দের সরকারি চাকরিতে নিয়োগের নিয়ম তিনি করলেও তা পুরোপুরি কার্যকরী হয় নি ।
গ. ভারতবাসীর মঙ্গল সাধনের জন্য যদিও বেন্টিংক অনেক হিতবাদী মতামত দেন তবুও একমাত্র সতীদাহ প্রথা বন্ধ ও ঠগি দমন ছাড়া কিছু করতে পারেন নি।
ঘ. বেন্টিংক রাজা রামমোহন রায়-এর ন্যায় পণ্ডিতের পথিকৃতের পথ প্রদর্শক হিসেবে এ হাওয়ায় পাল খাটিয়ে দু’একটি সামাজিক ও শিক্ষা বিষয়ক সংস্কার সাবধানতার সাথে সম্পাদন করেন মাত্র। কোন আমূল পরিবর্তন সাধনের চেষ্টা তিনি করেন নি।


রমেশচন্দ্র দত্তের মতে, বেন্টিংকের তথাকথিত সংস্কারবাদের আড়ালে ইংল্যান্ডের শিল্পপতি, বণিক ও ধনতন্ত্রীদের স্বার্থরক্ষার চেষ্টা লক্ষ করা উচিত। তবে এত কিছু সত্ত্বেও তার সংস্কার কার্য প্রশংসনীয় ছিল বলা যায়। ভারতীয় সমাজে কুসংস্কার দূরীকরণ, ভারতীয় ও ইংরেজ কর্মচারীদের মধ্যে বৈষম্য দূরীকরণ, ভারতীয়দের শিক্ষাদীক্ষার উন্নতি সাধন প্রভৃতির জন্য লর্ড মেকলে উইলিয়াম বেন্টিংকের প্রশংসা করতে গিয়ে বলেন যে, তিনিই সর্বপ্রথম প্রাচ্যদেশীয় অত্যাচারী শাসনের স্থলে ব্রিটিশ স্বাধীনতার আস্বাদ ভারতবাসীকে দিয়েছিলেন। তাই নিরপেক্ষ বিচারে একথা স্বীকার করতেই হবে যে, তিনি কোম্পানির আর্থিক অনটন দূর করে কোম্পানির বাৎসরিক আয় ব্যয়ের ঘাটতি পূরণ করে প্রতি বছর যথেষ্ট পরিমাণ রাজস্ব উদ্বৃত্ত রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। এছাড়া প্রশাসনিক, সামাজিক, শিক্ষা সংক্রান্ত সংস্কার সাধনের পশ্চাতে জনকল্যাণের ইচ্ছাই ছিল তার মুখ্য উদ্দেশ্য। এ সকল কারণে বেন্টিংক ভারতবাসীর কৃতজ্ঞতা অর্জন করেছেন এবং তার নাম ভারত ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে।


উপসংহার : অতএব বলা যায়, ভারতীয় উপমহাদেশের কোম্পানি শাসনের ইতিহাসে বেন্টিংক যোদ্ধা হিসেবে নয় সংস্কারক হিসেবে সবিশেষ পরিচিত। তাঁর সমাজ ও শিক্ষা সংক্রান্ত সংস্কারগুলো ভারত ইতিহাসের গতিকে পরিবর্তন করে দিয়েছিল। তাই উদারকামী, শান্তিপ্রিয়, নির্ভেজাল সংস্কারক, মুক্ত প্রতিযোগিতার অধিকারী হিসেবে বেন্টিংক ছিলেন ভিক্টোরিয়া যুগের মূর্ত প্রতীক। এছাড়া তুলনামূলক বিচারে তিনি অন্যান্য গভর্নর জেনারেলদের চেয়ে প্রশংসনীয় ছিলেন বলা যায়। কিন্তু বেন্টিংকের ভারতবাসীর প্রতি সহানুভূতিশীল মনোভাব থাকলেও ঐ মনোভাবের মধ্যে ব্রিটিশ সংস্কারের স্বার্থ লুকায়িত ছিল।

Leave a Comment