রিয়া সম্পর্কে হাদিস, “রিয়া” মুক্ত আমল করুন এর প্রতিদান আল্লাহ দিবেন

রিয়া (الرياء) অর্থ প্রদর্শন করা বা প্রদর্শনেচ্ছা। আল্লাহর জন্য করণীয় ইবাদত পালনের মধ্যে মানুষের দর্শন, প্রশংসা বা বাহবার ইচ্ছা পোষণ করাকে রিয়া বলে।

মুমিনের ইবাদত ধ্বংস করে তাকে জাহান্নামী বানানোর জন্য শয়তানের অন্যতম ফাঁদ ‘রিয়া’। কুরআন-হাদীসে রিয়ার ভয়াবহতা সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন: কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম যাদেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে তাদের একজন বড় আলিম, একজন প্রসিদ্ধ শহীদ ও একজন বড় দাতা। তারা আজীবন আল্লাহর ইবাদত বন্দেগিতে কাটালেও রিয়ার কারণে তারা ধ্বংসগ্রস্ত হয়।[1]

বিভিন্ন হাদীসে রিয়াকে ‘শিরক আসগার’ বা ছোট শিরক এবং ‘শিরক খাফী’ বা লূক্কায়িত শিরক বলা হয়েছে। কারণ বান্দা আল্লাহর জন্য ইবাদত করলেও অন্য সৃষ্টি থেকেও সেজন্য ‘কিছু’ আশা করে আল্লাহর সাথে অন্যকে শরিক করে। এ শিরকের কারণে মুসলিম কাফির বলে গণ্য না হলেও তার ইবাদত ধ্বংস ও অগ্রহণযোগ্য হয়ে যায়। মাহমূদ ইবন লাবীদ (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:


إِنَّ أَخْوَفَ مَا أَخَافُ عَلَيْكُمْ الشِّرْكُ الأَصْغَرُ قَالُوا وَمَا الشِّرْكُ الأَصْغَرُ يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ الرِّيَاءُ يَقُولُ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ لَهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ إِذَا جُزِيَ النَّاسُ بِأَعْمَالِهِمْ اذْهَبُوا إِلَى الَّذِينَ كُنْتُمْ تُرَاءُونَ فِي الدُّنْيَا فَانْظُرُوا هَلْ تَجِدُونَ عِنْدَهُمْ جَزَاءً


‘‘আমি সবচেয়ে বেশি যে বিষয়টি তোমাদের ব্যাপারে ভয় পাই তা হলো শিরক আসগার বা ক্ষুদ্রতর শিরক। সাহাবীগণ প্রশ্ন করেন: হে আল্লাহর রাসূল, শিরক আসগার কী? তিনি বলেন: রিয়া বা প্রদর্শনেচ্ছা। কিয়ামতের দিন যখন মানুষদেরকে তাদের কর্মের প্রতিফল দেওয়া হবে তখন মহান আল্লাহ এদেরকে বলবেন, তোমরা যাদের দেখাতে তাদের নিকট যাও, দেখ তাদের কাছে তোমাদের পুরস্কার পাও কি না!’’[2]

এক হাদীসে আবূ সাঈদ খুদরী (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন:


أَلا أُخْبِرُكُمْ بِمَا هُوَ أَخْوَفُ عَلَيْكُمْ عِنْدِي مِنْ الْمَسِيحِ الدَّجَّالِ قَالَ قُلْنَا بَلَى فَقَالَ الشِّرْكُ الْخَفِيُّ أَنْ يَقُومَ الرَّجُلُ يُصَلِّي فَيُزَيِّنُ صَلاتَهُ لِمَا يَرَى مِنْ نَظَرِ رَجُلٍ


‘‘দাজ্জালের চেয়েও যে বিষয় আমি তোমাদের জন্য বেশি ভয় পাই সে বিষয়টি কি তোমাদেরকে বলব না? আমরা বললাম, হ্যাঁ, অবশ্যই বলুন। তিনি বলেন, বিষয়টি গোপন শির্ক। গোপন শির্ক এই যে, একজন সালাতে দাঁড়াবে এরপর যখন দেখবে যে মানুষ তার দিকে তাকাচ্ছে তখন সে সালাত সুন্দর করবে।’’[3]

রিয়া থেকে আত্মরক্ষার জন্য মুমিনের চেষ্টা করতে হবে যথাসম্ভব সকল নফল ইবাদত গোপনে করা। তবে যে ইবাদত প্রকাশ্যে করাই সুন্নাত-সম্মত তা প্রকাশ্যেই করতে হবে। রিয়ার ভয়ে কোনো নিয়মিত ইবাদত বা প্রকাশ্যে করণীয় ইবাদত বাদ দেওয়া যাবে না। রিয়ার অনুভূতি মন থেকে দূর করতে চেষ্টা করতে হবে। কখনো এসে গেলে বারবার তাওবা করতে হবে এবং আল্লাহর কাছে তাওফীক প্রার্থনা করতে হবে।

রিয়ার কারণ সমাজের মানুষদের কাছে সম্মান, মর্যাদা বা প্রশংসার আশা। আমাদের বুঝতে হবে যে, দুনিয়ায় কোনো মানুষই কিছু দিতে পারে না। যে মানুষকে দেখানোর বা শোনানোর জন্য, যার প্রশংসা বা পুরস্কার লাভের জন্য আমি লালায়িত হচ্ছি সে আমার মতই অসহায় মানুষ। আমার কর্ম দেখে সে প্রশংসা নাও করতে পারে। হয়ত তার প্রশংসা শোনার আগেই আমার মৃত্যু হবে। অথবা প্রশংসা করার আগেই তার মৃত্যু হবে। আর সে প্রশংসা বা সম্মান করলেও আমার কিছুই লাভ হবে না। আমার পালনকর্তার পুরস্কারই আমার জন্য যথেষ্ট। তিনি অল্পতেই খুশি হন ও বেশি পুরস্কার দেন। তিনি দিলে কেউ ঠেকাতে পারে না। আর তিনি না দিলে কেউ দিতে পারে না।

কা’ব ইবন মালিক (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:


مَا ذِئْبَانِ جَائِعَانِ أُرْسِلا فِي غَنَمٍ بِأَفْسَدَ لَهَا مِنْ حِرْصِ الْمَرْءِ عَلَى الْمَالِ وَالشَّرَفِ لِدِينِهِ


‘‘দুটি ক্ষুধার্ত নেকড়েকে একটি মেষপালের মধ্যে ছেড়ে দিলে নেকড়েদুটি মেশপালের যে ক্ষতি করে, সম্পদ ও সম্মানের লোভ মানুষের দীনের তার চেয়েও বেশি ক্ষতি করে।’’[4][1] মুসলিম, আস-সহীহ ৩/১৫১৩-১৫১৪ (কিতাবুল ইমারাহ, বাবু মান কাতালা লির্রিয়া)।

[2] আহমদ, আল-মুসনাদ ৫/৪২৮-৪২৯; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ১/১০২। হাদীসটি সহীহ।

[3] ইবনু মাজাহ, আস-সুনান ২/১৪০৬ (কিতাবুয যুহদ, বাবুর রিয়া ওয়াস সুমআখ); আলবানী, সহীহুুত তারগীব ১/৮৯। হাদীসটি হাসান।

[4] তিরমিযী, আস-সুনান ৪/৫৮৮ (কিতাবুয যুহদ, বাব ৪৩)। হাদীসটি হাসান-সহীহ।

১) নামায শেষ করে উঠে যাওয়ার সময় জানতে পারলাম মেহমান চলে এসেছে। এজন্য মেহমান ঘরে প্রবেশ করা পর্যন্ত জায়নামাজে বসে থাকলাম। সম্পুর্ন ইচ্ছাকৃত না হলেও অবচেতন মন চাইছে নামায যে পড়তেছি মেহমান দেখুক! এটি ই রিয়া।

২) কেউ জিজ্ঞেস করলো-আপনি কি করছেন?
উত্তরে বললাম-আমি নামায পড়ে উঠে নাস্তা করতেছি বা নামায পড়ে উঠে এখন রান্না করতেছি।এখানে শুধু নাস্তা বা রান্না করার কথা বললেই হতো, সাথে -নামায পড়ে উঠে” কথাটি জুড়ে দিয়ে অতি সুক্ষভাবে নামাযকে প্রচারে নিয়ে আসা হল। এটি ই রিয়া।

৩) ফজরে যে নামায পড়তে উঠলাম কিন্তু কেউ জানলো না, তাই সেটা মানুষকে জানানোর জন্য দিলাম ফেসবুকে একটা পোস্ট, লিখলাম : “সবাই নামায পড়তে উঠুন/ঐ সময় ই ফজর নামাজের ফযীলত সম্পর্কিত/শাস্তি নিয়ে পোস্ট করলাম।” আমি জানি আমার এই পোস্টে কারো ঘুম ভাংগবেনা,তাও দিলাম। মোদ্দাকথা নামাযের ব্যাপারটা সবাইকে জানাতেই হবে। এটি ই রিয়া।

৪) নফল রোজা রেখে দুপুরে বন্ধুর সাথে চ্যাট করছি, হঠাৎ তাকে জিজ্ঞেস করেছি,ভাত খেয়েছিস কিনা?অথচ আজীবন তার ভাতের খবর নেয়নি,সে হ্যাঁ/না উত্তরের সাথে যে “তুই খেয়েছিস?”এটা জিজ্ঞেস করবে সেটার গ্যারান্টি সূর্য উঠার মতই,সে সুযোগে না দোস্ত রোজা রেখেছি বলে রোজার প্রচার করে দিলাম, এটি ই রিয়া।

৫) কুরবানির গরু কিনলাম, অফলাইনের আশেপাশের সবাই দেখলেও অনলাইন বন্ধুদের সামনে তো আর শো আপ করা হলো না।তাই প্রাইভেসি পাবলিক করে দিয়ে দিলাম পোস্ট, আলহামদুলিল্লাহ্‌ Done এইটি রিয়া।

৬) বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়ার সময় মজার ছলেই টেকনিকে বলে দিলাম, তুই বেটা কিপটা, কিছুই দান করিস না। প্রতিউত্তরে, “তুই কি দান করে উল্টিয়ে ফেলছিস? এই প্রশ্নটা যে করবে তা জানুয়ারির পর ফেব্রুয়ারি আসার মতই নিশ্চিত আমি, সাথে সাথেই দিয়ে দিলাম আমার দানের লিস্ট, সম্পূর্ণ ডিটেল সহকারে। এইটি রিয়া।

উপরের প্রত্যেক উদ্দীপক পড়ে কিছু আয়ত্ত করতে পারলেন কি? একেই বলে রিয়া। এতক্ষণ যে ইবাদত গুলো করলাম সেগুলা কি আল্লাহর জন্য, নাকি লোক দেখানো? লোক দেখানো মানেই রিয়া।

কখনো ভেবেছেন, এসব ইবাদত আদৌ কবুল হবে কি? উপরোক্ত প্রত্যেকটি ইবাদতই হলো “রিয়া”

আল্লাহ আমাদের রিয়ামুক্ত ইবাদতের তৌফিক দান করুক। আল্লাহুম্মা আমিন।

    Leave a Comment