সুরা ‘ নাস’ পবিত্র কুরআনের ১১৪তম ও সর্বশেষ সুরা। মক্কায় নাজিল হওয়া এ সুরায় রয়েছে ৬টি বাক্য বা আয়াত। নাস শব্দের অর্থ মানুষ।
এ সুরার অর্থ:
অসীম দয়াময় ও অনন্ত করুণাময় আল্লাহর নামে : (১) হে রাসুল আপনি বলুন, ‘আমি মানুষের প্রতিপালকের আশ্রয় কামনা করছি, (২) মানুষের প্রভুর, (৩) ও মানুষের উপাস্যের কাছে তথা মহান আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাইছি এবং (৪) শয়তানী সন্দেহের অনিষ্ট হতে আল্লাহর আশ্রয় চাচ্ছি যে ‘খান্না’স নামক শয়তান আল্লাহর নাম শুনে পশ্চাৎপদ হয় বা আত্নগোপন করে, (৫) এইসব অদৃশ্য শয়তান মানুষের হৃদয়ে সংশয় বা কুমন্ত্রণা সৃষ্টি করে, (৬) জিনের মধ্য হতে অথবা মানুষের মধ্য হতে।’—
কাফির ও অংশীবাদীরা, বিশেষভাবে ইহুদীরা রাসূল (সা.)-এর চরম শত্রু ছিল এবং তাঁর শত্রুতায় বিভিন্ন প্রকারের অনিষ্ট করত। কখনও তাঁর খাবারের মধ্যে বিষ মিশিয়ে দিত, আবার কখনও জাদু করত। যদিও জাদু তাঁর ওপর কখনও প্রভাব ফেলতে পারেনি, তবু আল্লাহ তাদের অনিষ্ট থেকে সুরক্ষিত রাখার জন্য এবং রাসূলকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য সুরা ফালাক্ব ও সুরা নাস নাযিল করেন। এসব সূরার মাধ্যমে আল্লাহ মহানবী (সা)-কে জানিয়ে দেন যে, আল্লাহ তোমার রক্ষক ও সাহায্যকারী । শত্রু তোমার কোন ক্ষতি সাধন করতে পারবে না।
শয়তান সব সময়ই মানুষকে বিপথগামী করতে কুমন্ত্রণা দিচ্ছে। যে মানুষ যত বেশি জ্ঞানী ও সামাজিক পদ-মর্যাদা যার যত বেশি শয়তানের কুমন্ত্রণাও তার প্রতি বাড়তে থাকে।
সুরা ফালাক্বের মত সুরা নাসেও নানা অনিষ্ট বা ক্ষতি থেকে মানুষকে আল্লাহর আশ্রয় চাইতে বলা হয়েছে। তবে পার্থক্য হল সুরা ফালাক্বে আল্লাহর সৃষ্টির নানা ধরনের অনিষ্ট ও ক্ষতি হতে আল্লাহর আশ্রয়ের কথা বলা হয়েছে, কিন্তু সুরা নাসে অদৃশ্য শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে আশ্রয় চাওয়ার কথা এসেছে। এ সুরায় মহানবীকে (সা) মানবজাতির শ্রেষ্ঠ আদর্শ হিসেবে মানুষ ও জিন শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে মহান আল্লাহর আশ্রয় চাইতে বলা হয়েছে।
সুরা নাসের প্রথম দিকে মহান আল্লাহর বৈশিষ্ট্য হিসেবে রবুবিয়াত বা প্রভুত্ব তথা প্রতিপালন ও প্রশিক্ষণ, মালিকানা ও খোদায়িত্ব বা উলুহিয়্যাত তথা উপাস্যতার বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে। শয়তানের কুমন্ত্রণার ব্যাপক বিস্তৃত জাল থেকে মানুষের মুক্তি ও সুরক্ষা, প্রশিক্ষণ ও প্রতিপালন আল্লাহর এই বৈশিষ্ট্যগুলোর সঙ্গে সম্পর্কিত। ‘রাব্বিন্নাস’ বলে মানুষ প্রথমেই মহান আল্লাহকে তার রব হিসেব স্বীকার করছে এবং নিজের প্রতিপালন ও প্রশিক্ষণকে তাঁরই ওপর ছেড়ে দিচ্ছে। ‘মালিকিন্নাস’ কথাটি বলে মানুষ স্বীকার করছে যে তার মালিক হচ্ছেন আল্লাহ; আর তাই আল্লাহর দাস হিসেবে তাঁর সব বিধি-বিধান ও নির্দেশ মানতে সে বাধ্য। সুরা নাসের তৃতীয় আয়াতে ‘ইলাহিন্নাস’ কথাটি বলে মানুষ আল্লাহর ইবাদাত বা উপাসনার দিকে অগ্রসর হয় এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য কারোই উপাসনা করে না। আল্লাহ কাফির-মুশরিক ও বিশ্বাসী নির্বিশেষে সবারই রব। তাই তিনি সব শ্রেণীর দাসকে পূর্ণতার দিকে এগিয়ে নেন। আল্লাহর দাসরা জিন ও শয়তানের প্রভাবে সঠিক পথ হারিয়ে বিভ্রান্ত হবে- এটা আল্লাহ কখনও হতে দিতে পারেন না। অবশ্য মানুষ নিজেই যদি শয়তানকে নেতা মানে তাহলে তারা সুপথ ও পূর্ণতার পথ পাবে না।
শয়তান মানুষের কাছে দুনিয়ার চাকচিক্যকে ও পাপাচারকে শোভনীয় করে তুলে ধরে এবং মিথ্যাকে সত্যের পোশাক পরিয়ে সত্যকে ঢেকে রাখে। শয়তান পাপকে ইবাদাত ও বিভ্রান্তিকে হেদায়াত বা সুপথ হিসেবে তুলে ধরে। যেসব মানুষের ঈমান ও প্রজ্ঞা কম তারা এভাবে শয়তানের ধোঁকায় পড়ে এবং ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার আসক্ত হয়।
শয়তান ও তার সেনারা গোপন থাকে এবং তাদের কর্মসূচিও গোপন। তাই সত্যের পথিকদের সতর্ক করা হচ্ছে যে শয়তানদেরকে আসল চেহারায় দেখার আশা যেন তারা না করে। শয়তানদের কুমন্ত্রণা হচ্ছে গোপন। তারা ধোঁকা, মিথ্যাচার, লোক-দেখানো তৎপরতা এবং সত্য গোপনের মাধ্যমে কাজ করে। কুমন্ত্রণাদানকারী শয়তানরা কেবল বিশেষ কোনো গোষ্ঠী, শ্রেণী ও জাতির মধ্যে কাজ করে না, তাদের পোশাকও একই ধরনের নয়। তারা মানুষ ও জিনদের মধ্যে ছড়িয়ে আছে এবং সব পোশাকে সব শ্রেণী ও জাতির মধ্যেই তারা তৎপর।
বিচ্যুত বন্ধু, জালেম ও পথভ্রষ্ট নেতা, খোদাদ্রোহী ও বলদর্পী শক্তি, বিচ্যুত লেখক ও বক্তা, কুফরি নানা মতাদর্শ, কুমন্ত্রণাদানকারী গণমাধ্যম- এসবই গোপন কুমন্ত্রণাদানকারী। তাই মানুষের উচিত এ-সব শয়তানসহ সব শয়তান থেকেই মহান আল্লাহর আশ্রয় চাওয়া। আশ্রয় চাওয়াটা হতে হবে মৌখিক ও কার্যক্ষেত্রের এবং সব পাপ ও মন্দ কাজের জন্য তওবা করতে হবে।
মহানবীর (সা) আহলে বাইতের সদস্য হযরত ইমাম সাদিক (আ) থেকে বর্ণিত: সুরা আলে ইমরানের ১৩৫ আয়াত তথা ‘ তারা কখনও কোন অশ্লীল কাজ করে ফেললে কিংবা কোন মন্দ কাজে জড়িত হয়ে নিজের উপর জুলুম করে ফেললে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং নিজের পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে।’–এ আয়াত যখন নাজিল হয় তখন শয়তানদের গুরু ইবলিস মক্কার পাহাড়ে গিয়ে সব শয়তানকে জড়ো করে বলে যে এই আয়াত আমাদের নড়বড়ে করে দিয়েছে এবং এ আয়াত মানুষের মুক্তির মাধ্যম। কে এর মোকাবেলা করতে পারবে? বড় ধরনের কোনো কোনো শয়তান তখন কিছু ষড়যন্ত্র বা ফন্দির কথা জানাল। কিন্তু এসব শয়তানের পছন্দ হয়নি। এরপর গোপনে থেকে মানুষকে কুমন্ত্রণা দিতে অভ্যস্ত খান্নাস নামক শয়তান বলল: আমি এর মোকাবেলার দায়িত্ব নিলাম! ইবলিস বলল: কিভাবে তুমি মানুষকে বিভ্রান্ত করবে। খান্নাস বলল, মানুষকে নানা আশার বেড়াজালে বেঁধে পাপে লিপ্ত করব এবং যখনই গোনাহ করবে তওবা করার কথাও ভুলিয়ে দেব। তখন ইবলিস বলল: হ্যাঁ, তুমিই এ কাজের জন্য উপযুক্ত এবং কিয়ামত বা বিচার-দিবস পর্যন্ত তুমি এ দায়িত্ব পালন করবে।
মহান আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ যে তিনি পবিত্র কুরআনের সুরাগুলোর গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য বা ব্যাখ্যা সম্পর্কিত ধারাবাহিক আলোচনা অনুষ্ঠান ‘আসমানি সুরা’ শেষ করার সুযোগ দিয়েছেন। মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে পবিত্র কুরআনকে ভালোভাবে বোঝার সুযোগ দিন এবং জিন ও মানুষ শয়তানের অনিষ্ট থেকে রক্ষা করুন। এতদিন যারা আমাদের সঙ্গ দিলেন তাদের সবাইকে জানাচ্ছি অনেক ধন্যবাদ।
কুরআন সমাপ্তির দো’আ
হে আল্লাহ! আমার কবরে আমার হতবুদ্ধিতা ও চিন্তা দূরীভূত করুন এবং মহান কুরআনের উসীলায় আমার প্রতি কৃপা করুন। আর কুরআনকে আমার জন্য নেতা, নূরের উপায় ও হেদায়াতের কারণ এবং অনুগ্রহস্বরূপ করুণ। হে আল্লাহ! কুরআনের যা কিছু আমি বিস্মৃত হয়েছি স্মরণ করিয়ে দিন এবং কুরআনের মধ্যে যা কিছু আমি অনুধাবন করিনি তার জ্ঞান দান করুন; দিবা-রাত্রি এর তেলাওয়াত আমার নসীব করুন এবং (কিয়ামত দিবসে) একে আমার জন্য দিশারী প্রমাণস্বরূপ করুন। হে নিখিল বিশ্বের প্রতিপালক।#
- ভাগে কোরবানির নিয়ম, অংশীদারির ভিত্তিতে কোরবানি করার নিয়ম, ভাগে কোরবানির যত বিধি বিধান
- কোরবানির অর্থনৈতিক ও সামাজিক গুরুত্ব,আরও একবার জানুন কোরবানির অর্থনৈতিক ও সামাজিক গুরুত্ব
- ইসলামে কুরবানীর গুরুত্ব ও বিধান,ইসলামে কোরবানির যত ফজিলত গুরুত্ব ও শিক্ষা
- বৃষ্টির নামাজের গুরুত্ব ও ফজিলত, বৃষ্টির নামাজের পর আমল
- ইসতিসকার নামাজের নিয়ম ও নিয়ত, ইসতিসকার নামাজের গুরুত্ব ও ফজিলত, ইসতিসকার নামাজের পর আমল
- বাসর রাত সম্পর্কে ইসলামের বিধান,বাসর রাতের নামাজ