বাংলাদেশে দারিদ্র্যের সূচক বা নির্ধারকগুলো আলোচনা কর, বাংলাদেশে বিরাজমান দারিদ্র্যের জন্য কি কি সূচক বা নির্ধারক রয়েছে তা উল্লেখ কর

বাংলাদেশে দারিদ্র্যের সূচক বা নির্ধারকগুলো আলোচনা কর, বাংলাদেশে বিরাজমান দারিদ্র্যের জন্য কি কি সূচক বা নির্ধারক রয়েছে তা উল্লেখ কর

বাংলাদেশের সার্বিক আর্থসামাজিক উন্নয়নের প্রধান প্রতিবন্ধক হলো দারিদ্র্য। দারিদ্র্য শুধু সমস্যাই নয়, অন্যান্য সমস্যার প্রধান কারণও বটে। দারিদ্র্য একটি আপেক্ষিক প্রত্যয়। এটি এমন একটি অবস্থা যা নির্দিষ্ট সময়ে একটি সমাজের জীবন মান এবং সম্পদের পরিপ্রেক্ষিতে পরিমাপ করা হয়।

ডেভিড জেরি ও জুলিয়া জেরি প্রণীত Colling Dictionary-র ব্যাখ্যানুযায়ী, “Poverty is the lack of sufficient material and cultural resources to sustain a health exitance.” অর্থাৎ, দারিদ্র্য কারো কাম্য না হলেও পৃথিবীতে বিভিন্ন মাত্রায় এবং বিভিন্ন আঙ্গিকে দারিদ্র্য দেখা দিচ্ছে।

বাংলাদেশে দারিদ্র্যের সূচক বা নির্ধারকগুলো আলোচনা কর, বাংলাদেশে বিরাজমান দারিদ্র্যের জন্য কি কি সূচক বা নির্ধারক রয়েছে তা উল্লেখ কর

→ দারিদ্র্যের সূচক বা নির্ধারক : উন্নয়ন যেমন একটি বহুমুখী ধারণা, তেমনি দারিদ্র্য একটি বহুমুখী সমস্যার সমন্বয়। তাই দারিদ্র্য চিহ্নিতকরণের কতকগুলো নির্দেশক আছে, যার ভিত্তিতে নির্ণয় করা যায় একটি দেশ দরিদ্র কিনা। নিম্নে সেগুলো আলোচনা করা হলো :

১. দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি : বাংলাদেশ একটি ছোট দেশ। কিন্তু জনসংখ্যার বৃদ্ধিজনিত কারণে জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ৯১৬ জন। বাংলাদেশে বসবাসকারী জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.৩৭% । জনসংখ্যা বৃদ্ধির এই দ্রুততার কারণে দেশ আরো দরিদ্র হয়ে পড়ছে। সুতরাং এ লাগামহীন জনসংখ্যা বৃদ্ধি দরিদ্র্যতার অন্যতম নির্দেশক।

২. শিক্ষা : শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। শিক্ষা ছাড়া কোন দেশ, কোন জাতি উন্নতি করতে পারে না। আর এ শিক্ষা একটা দেশের দারিদ্র্য নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এদেশে শিক্ষার হার অত্যন্ত কম । সুতরাং উন্নয়ন এখানে অকল্পনীয় মনে হয় ।

৩. স্বল্প মাথাপিছু আয় : বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় অত্যন্ত স্বল্প। স্বল্প মাথাপিছু আয় দারিদ্র্যের অন্যতম নির্দেশক। সাধারণত সম্পদের সীমাবদ্ধতার কারণে আমাদের দেশে মাথাপিছু আয় ২০৬৪ মা. ডলার, যা অন্যান্য দেশের তুলনায় কম। ফলে এ দেশের ২৩.০৫% লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে।

৪. ভূমিহীনতা : আমাদের দেশের জনগণের মাথাপিছু ভূমির পরিমাণ ০.১২ একর। প্রাকৃতিক দুর্যোগ এ দেশের মানুষকে ক্রমশ আরো ভূমিহীন করে তুলেছে। এর অন্যতম কারণ হলো দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি । যে দেশে ভূমিহীনদের সংখ্যা যত বেশি, সে দেশ তত দরিদ্র।

৫. বাসস্থান : কৃষিনির্ভর জনগণ কৃষি ব্যবস্থাপনা বর্তমানে অলাভজনক হওয়ায় মানুষ শহরমুখী হয়। ফলে তারা ফুটপাথে, রেলস্টেশনে, বস্তিতে ভারসাম্যহীনভাবে বসবাস করে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, বাসস্থান সমস্যা ব্যাপক আকার ধারণ করায় দারিদ্র্য আরো করাল গ্রাস ধারণ করে ।

৬. চিকিৎসা : অন্ন, বস্ত্র বাসস্থান এ তিনটি মৌলিক চাহিদার পর মানুষের দরকার চিকিৎসা সুবিধা। কিন্তু চিকিৎসা ক্ষেত্রে এ দেশের মাথা পিছু বরাদ্দ অত্যন্ত কম। এদেশের মাথাপিছু বরাদ্দ মাত্র ৩৬ টাকা। যা দ্বারা কোন উন্নত চিকিৎসা আশা করা যায় না। তাছাড়া প্রায় ৭৫% লোক অপুষ্টিতে ভোগে, ৩% লোকের বিশুদ্ধ পানির কোন ব্যবস্থা নেই।

৭. বেকারত্ব : শ্রমশক্তি জরিপ ২০১৬ অনুযায়ী এদেশে ২৬ লক্ষ লোক বেকার। দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি, স্বল্প মাথাপিছু আয়, ভূমিহীনতা, কৃষির উপর অত্যধিক নির্ভরশীলতা ইত্যাদি মূলত • বেকারত্বের কারণ যা দারিদ্র্যের অন্যতম নির্ধারক।

৮. সম্পদের অসম বণ্টন : স্বল্প সম্পদের অসম বণ্টন দারিদ্র্যের অন্যতম নির্ধারক। আমাদের দেশে এটি অধিক ভয়াবহ। যেমন মাত্র ২০ ভাগ লোক ৮০ ভাগ সম্পদ এবং ৮০ ভাগ লোক ২০ ভাগ সম্পদ ভোগ করে থাকে। এটা Capitalism এর প্রভাব। এর ফলে ধনীরা আরো ধনী, এবং গরিবরা ক্রমশ গরিবে পরিণত হচ্ছে।

৯. প্রসূতি শিশু মৃত্যুহার : তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, অশিক্ষা, কুসংস্কার, অস্বাস্থ্য ইত্যাদি কারণে জনগণ স্বাস্থ্য সম্পর্কে অজ্ঞ, যার ফলে প্রতি মা ও শিশু মৃত্যুর হার বেড়েই চলেছে, যা দারিদ্র্যের অন্যতম নির্ধারক। বিশ্বব্যাংকের রিপোর্ট ২০০২ অনুযায়ী উন্নয়নশীল দেশে প্রায় ১৭০ মিলিয়ন শিশু অপুষ্টিতে এবং প্রায় ৩ মিলিয়ন হাজারে ১১৭ জন মৃত্যুবরণ করে।

১০. পরিবেশগত সমস্যা : পরিবেশগত কারণে আমরা দারিদ্র্য। প্রাকৃতিকভাবে এ দেশের মানুষ অলস। অলসতা জাতিকে আরো দরিদ্র করে। বিশ্বের শীতপ্রধান দেশগুলো উন্নত, আর মৌসুমি জুলবায়ুর দেশগুলো বেশি উন্নত নয় ।

১১. পুষ্টিহীনতা : পুষ্টিহীনতা বাংলাদেশে দারিদ্র্যের আরেকটি নির্ধারক। আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ পুষ্টি কর খাবার খেতে পারে না। ফলে বিভিন্ন পুষ্টি উপাদানের অভাবে তারা ক্রমশ রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে। বাংলাদেশে পুষ্টিহীনতা সমস্যা অত্যন্ত প্রকট ।

১২. কৃষির উপর নির্ভরশীলতা : বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ গ্রামে বাস করে। আর গ্রামের এসব মানুষের মূল জীবিকা হলো কৃষিকাজ। কৃষিই এ দেশের গ্রামাঞ্চলের মানুষের প্রধান পেশা। কৃষির উপর অধিক নির্ভরশীলতার কারণে এদেশে দারিদ্র্যের সংখ্যা ক্রমশ বেড়ে চলছে। এই কৃষির উপর নির্ভরশীলতা দারিদ্র্যের অন্যতম নির্ধারক।

১৩. উচ্চ হারে মাইগ্রেশন : মাইগ্রেশন অর্থ হলো এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্থানান্তর। এদেশের গ্রামাঞ্চলের মানুষ প্রতিনিয়ত শহরে আদহে জীবন ও জীবিকার তাগিদে । আবার শহরের মানুষরা জীবিকার জন্য পাড়ি জমাচ্ছে বিভিন্ন দেশে, উচ্চ হারে এই মাইগ্রেশনের কারণে দারিদ্র্যের সৃষ্টি হয়।

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, দারিদ্র্য বাংলাদেশের একটা বড় অভিশাপ আকারে দেখা দিয়েছে। আর দারিদ্র্যের কারণে আনুষঙ্গিক সব সমস্যা দেখা দিচ্ছে। তাই বলা হয়, “Poverty is the root cause of all under develoment.” দারিদ্র্যের এ প্রভাব বাংলাদেশের মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে, যার কারণে উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে। মানুষ তার মৌলিক চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হওয়ার কারণে বিভিন্ন বিষয়ে থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সুতরাং দারিদ্র্য এ দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক প্রভৃতি ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করছে, যার বাস্তবতা আমরা প্রতিনিয়ত দেখতে পাচ্ছি।

একাডেমিক শিক্ষা বিষয়ক লিখিত প্রশ্ন সমাধান পেতে ক্লিক করুন।

আর্টিকেলের শেষ কথাঃ বাংলাদেশে দারিদ্র্যের সূচক বা নির্ধারকগুলো আলোচনা কর, বাংলাদেশে বিরাজমান দারিদ্র্যের জন্য কি কি সূচক বা নির্ধারক রয়েছে তা উল্লেখ কর

Leave a Comment