বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য

অনলাইনে আয়

Google Adsense Ads

বাংলা‌দে‌শের পররাষ্ট্রনী‌তি উন্নয়ন ও চ‌্যা‌লেঞ্জ

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এসে বাংলাদেশের কূটনৈতিক অর্জন এবং ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ আলোচনার দাবি রাখে। বলার অপেক্ষা রাখে না, নানা সীমাবদ্ধতা ও সংকটের মধ্যেও স্বাধীনতার পর থেকেই কূটনীতিচর্চায় বাংলাদেশ সাফল্যজনক ভূমিকা রেখেছে।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দিকনির্দেশনা ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়’- এটা আমাদের বৈদেশিক নীতির মূল ভিত্তি। সংবিধানের ২৫ নম্বর অনুচ্ছেদে বৈদেশিক নীতি এভাবে বিবৃত হয়েছে, ‘জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও সমতার প্রতি শ্রদ্ধা, অন্যান্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা, আন্তর্জাতিক বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধান এবং আন্তর্জাতিক আইনের ও জাতিসংঘের সনদে বর্ণিত নীতিসমূহের প্রতি শ্রদ্ধা- এই সকল নীতি হইবে রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভিত্তি।

‘ আমরা দেখেছি, বঙ্গবন্ধুর সফল কূটনীতির ফলে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ অল্প সময়ে বিশ্বের ছোট-বড় অনেক দেশের স্বীকৃতি এবং সেইসঙ্গে বিশ্বের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যপদ লাভ করে। এর পর থেকে বাংলাদেশের কূটনীতির মাইলফলক অনেকদূর এগিয়েছে।

বিশেষ করে গত দুই দশকে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশ বিশ্বে এক অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। শিগগির বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের পর্যায়ে উন্নীত হচ্ছে। উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার ক্ষেত্রে প্রয়োজন অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে টেকসই আর্থসামাজিক প্রবৃদ্ধি, প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দায়িত্বশীল আচরণ।

ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সংযোগস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান। বাংলাদেশের প্রায় তিন দিক ঘিরে রয়েছে ভারত। বাংলাদেশের উত্তরে রয়েছে শিলিগুড়ি করিডোর, যা ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সঙ্গে ভারতের অবশিষ্টাংশের সংযোগ রক্ষাকারী একটি সংকীর্ণ ভূখণ্ড। তা চিকেন’স নেক নামেও অভিহিত।

বাংলাদেশের ১০০ কিলোমিটার উত্তরে রয়েছে ‘নাথু লা’ গিরিপথ, যা চীনের (তিব্বত) সঙ্গে ভারতকে স্থলপথে সংযুক্ত করেছে। ১৯৬৭ সালে ‘নাথু লা’ গিরিপথে চীন ও ভারতের মধ্যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়। তৎপূর্বে ১৯৬২ সালে ভারতের অরুণাচল প্রদেশ, যা আগে নেফা নামে পরিচিত ছিল, সেখানে চীন ও ভারত এক সংক্ষিপ্ত সীমান্তযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে।

ভারত-চীন সীমান্ত ১৯১৪ সালে ব্রিটিশ ও তিব্বতের তৎকালীন শাসকের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়; চীন সরকার এই সীমান্তরেখাকে কখনোই স্বীকৃতি দেয়নি। ম্যাকমোহন লাইন নামে পরিচিত এই সীমান্ত বরাবর আবারও সংঘাত ঘটতে পারে।

বাংলাদেশের দুই সীমান্তবর্তী প্রতিবেশী ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সীমান্ত নিয়ে আমাদের কোনো বিরোধ নেই। প্রতিবেশীদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করে বাংলাদেশ একটি শান্তিপূর্ণ অঞ্চল প্রতিষ্ঠায় প্রত্যাশী। কয়েক বছর আগে ভারতের সঙ্গে দীর্ঘদিন ঝুলে থাকা ছিটমহল ও অপদখলকৃত ভূমি সমস্যার সমাধান হয়েছে।

একই সঙ্গে ভারত ও মিয়ানমার উভয় দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার বিরোধও আপস নিষ্পত্তি হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এর পরও আমাদের প্রতিবেশীদের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় কিছু অমীমাংসিত বিষয় রয়েছে, যার আশু সমাধান প্রয়োজন।

বিশ্বের ভূ-রাজনৈতিক ও ভূ-কৌশলগত দৃশ্যপট দ্রুত বদলে যাচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র্রের একচেটিয়া আধিপত্যে চীন ও রাশিয়া চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতের নেতৃত্বাধীন কোয়াড বা চতুর্পক্ষীয় নিরাপত্তা সংলাপের নামে একটি জোট গঠিত হয়েছে, যার উদ্দেশ্য হলো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও পারিপার্শ্বিক অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের মোকাবিলা করা।

অন্যদিকে, চীন তার ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ তথা বিআরআইর মাধ্যমে ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকায় তার প্রভাববলয় বাড়াতে চায়। বাংলাদেশ বিআরআইর সদস্য এবং একই সঙ্গে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোর নানা আঞ্চলিক বাণিজ্যিক উদ্যোগের অংশীদার।

বাংলাদেশ আসিয়ানের আঞ্চলিক ফোরাম বিমসটেকের সক্রিয় সদস্য। চীন, জাপান ও কোরিয়া এখন বাংলাদেশের প্রধান বিনিয়োগকারী দেশ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন আমাদের রপ্তানি সামগ্রীর প্রধান গ্রাহক। বাংলাদেশ একই সঙ্গে সার্ককে আরও সংহত করে গড়ে তোলার কাজ করছে।

বাংলাদেশ ওআইসি ও অন্যান্য সংস্থার মাধ্যমে ফিলিস্তিনি জনগণের অধিকার রক্ষায় কাজ করে চলেছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো তেল, গ্যাস ও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের জন্য আমাদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়।

নিকটতম প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক বিশেষ গুরুত্বের দাবিদার। ভারতের সঙ্গে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আন্তঃসীমান্ত নদীগুলোর পানির ন্যায্য বণ্টন। ১৯৯৬ সালে গঙ্গা চুক্তির পর থেকে দু’দেশের মধ্যে প্রবাহিত বাকি ৫০টি নদীর পানি নিয়ে সামান্যই অগ্রগতি হয়েছে।

এক দশক ধরে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি অমীমাংসিত রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিরোধিতার কারণে। পানি বণ্টনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অভিন্ন নদীগুলোর অববাহিকাভিত্তিক সমাধানে আগ্রহী। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও ভারতের পাশাপাশি নেপাল, ভুটান ও চীনকেও অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন বলে মনে করি। এ বিষয়ে কূটনৈতিক পর্যায়ে আলোচনা শুরু করা প্রয়োজন।

ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির নেতারা অবৈধ অনুপ্রবেশের জন্য বারবার বাংলাদেশের প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করে চলেছেন। বাংলাদেশ বরাবরই এর তীব্র নিন্দা জানিয়ে আসছে। বস্তুত বিজেপি এনআরসি প্রকল্পের অপপ্রচারের মাধ্যমে আসামে নিরঙ্কুশ রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী হতে চেয়েছিল এবং এ প্রচেষ্টায় তারা সফলও হয়েছে।

অথচ এনআরসির চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের পরই এটা প্রমাণ হয়ে যায় যে, তথাকথিত বাংলাদেশি অনুপ্রবেশের ধুয়া আসলেই একটি রাজনৈতিক কৌশল মাত্র। একইভাবে জাতীয় নাগরিকত্ব আইনের সংশোধনী বিলও বিজেপির রাজনৈতিক ফায়দা লাভের প্রচেষ্টা মাত্র। উভয় ব্যাপারে বাংলাদেশ তার উদ্বেগ জানিয়ে এসেছে।

ভারতের বিএসএফ কর্তৃক সীমান্তে হত্যার ঘটনা বাংলাদেশের দিক থেকে গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিএসএফ অবশ্যই অবৈধ অনুপ্রবেশ ও চোরাচালান বন্ধ করবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, যারা সীমান্ত হত্যার শিকার হয়, তাদের অধিকাংশই হতদরিদ্র, নিরীহ গ্রামবাসী।

Google Adsense Ads

সীমান্তে মারণাস্ত্র ব্যবহার করবে না বলে বারবার আশ্বস্ত করার পরও বিএসএফ বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা বন্ধ করছে না। এসব ঘটনায় বাংলাদেশে ভারত বিরোধিতা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে এবং যারা বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যকার সুসম্পর্ক চায় না, তারাই লাভবান হয়। শান্তিপূর্ণ সীমান্ত রক্ষায় তাই দুই দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করা উচিত।

১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ সরকার সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে আসছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বিশ্ব সম্প্রদায়ের সমবেদনা পাওয়া ছাড়া কোনো অগ্রগতি সাধিত হয়নি বললেই চলে। রোহিঙ্গাদের স্থায়ী ও নিরাপদ প্রত্যাবাসন না হওয়া পর্যন্ত আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সমর্থন তৈরির জন্য বাংলাদেশকে নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।

এ জন্য জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য দেশগুলোর যেমন বিশেষ ভূমিকা প্রয়োজন, একই সঙ্গে মিয়ানমারের ওপর রাশিয়া ও চীনের আরও অধিক চাপ প্রয়োগের চেষ্টা করতে হবে। রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে ভারতও প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের কারণে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়টি আরও পিছিয়ে পড়েছে। এ ক্ষেত্রে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভবিষ্যতে আরও কঠিন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবে।

আফগানিস্তান পরিস্থিতি নিয়েও বাংলাদেশের মাথাব্যথার কারণ রয়েছে। তালেবানের একটি অংশ মার্কিন শান্তিচুক্তিতে অংশগ্রহণ করলেও আরেক অংশ আল কায়দা ও ইসলামিক স্টেটের অঙ্গীভূত হয়েছে। ১১ সেপ্টেম্বর ২০২১-এর মধ্যে দেশটি থেকে মার্কিন ও ন্যাটো সৈন্য প্রত্যাহার করা হবে।

আফগানিস্তানে যদি আবারও তালেবান ক্ষমতায় ফিরে আসে, তাহলে সেখানে আমরা ১৯৯৬-২০০১ সালের চেয়ে আরও ভয়ংকর অবস্থা দেখতে পাব। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। সমাজে উগ্রবাদী চিন্তার প্রসার বন্ধ করার জন্য আমাদের ব্যাপক পদক্ষেপ নিতে হবে।

আমরা দেখছি, ভারতে উগ্র হিন্দুত্ববাদের উত্থান বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতেও বিরূপ প্রভাব ফেলছে। আমরা প্রত্যাশা করি, এ অঞ্চলের রাজনীতিবিদরা রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার বন্ধে ব্যবস্থ্থা গ্রহণ করে সমাজে শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখতে সচেষ্ট হবেন।

বাংলাদেশ জাতিসংঘের শান্তি মিশনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। আমাদের সামরিক বাহিনী, আধাসামরিক ব্যক্তি ও পুলিশ সদস্যরা বিভিন্ন দেশে গুরুত্বপূর্ণ মিশনে দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করছেন। বাংলাদেশের উজ্জ্বল ভাবমূর্তি কাজে লাগিয়ে যেসব দেশে আমাদের জাতিসংঘ মিশন ছিল বা আছে, সেসব দেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারলে বাংলাদেশ আরও লাভবান হতো।

এ ক্ষেত্রে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় আমাদের উদ্যোক্তারা বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় অর্থনৈতিক সহায়তা চুক্তি করতে পারে। বাংলাদেশ বিকশিত অর্থনীতির দেশ হিসেবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে ব্যবসায়িক, শিক্ষা-সংস্কৃতি, মিডিয়া ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের আরও গভীর যোগাযোগ থাকা প্রয়োজন।

বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতি দীর্ঘ মেয়াদে টেকসই হতে হলে তাতে দেশের আপামর জনগণের সমর্থন থাকতে হবে। তাই পররাষ্ট্রনীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে সংসদ ও সংসদের বাইরে জনমানুষের অংশগ্রহণ প্রয়োজন। আশা করি, অতীতের মতো ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তার দক্ষতার পরিচয় তুলে ধরবে।

সূত্র; বিডি স্টাডি কর্নার

Google Adsense Ads

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *