বিষয়: সার্ক / SAARC
সার্ক / SAARC
ভূমিকা : দক্ষিণ এশিয়া একটি প্রাচীন ও বৈচিত্র্যময় জনপদ। এ অঞ্চল সমৃদ্ধ সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী। আটটি দেশের জনসমষ্টি একত্রে সমগ্র পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-চতুর্থাংশ। কিন্তু বিশ্ববাণিজ্যে এ অঞ্চলের অংশ মাত্র ১ শতাংশ এবং বিশ্বের মোট জাতীয় উৎপাদনের মাত্র দেড় শতাংশ অবদান এ অঞ্চলের। সদস্য দেশগুলোর মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক তেমন সুবিধাজনক না হওয়ায় জনসংখ্যায় বিশ্বের বৃহৎ এ আঞ্চলিক সংস্থাটি অনেক ক্ষেত্রেই ব্যর্থ।
সর্ক গঠনের প্রেক্ষাপট : ১৯৮০ সালে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান একটি আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা গড়ে তোলার জন্য দক্ষিণ এশিয় দেশগুলোর নিকট প্রস্তাব পেশ করেন। এ প্রস্তাব নিয়ে আলোচনার জন্য ১৯৮১ সালে শ্রীলংকার রাজধানী কলম্বোতে দক্ষিণ এশিয় সাতটি দেশের প্রতিনিধিগণ বৈঠকে মিলিত হয়। পরবর্তীতে কাঠমান্ডু, ইসলামাবাদ, ঢাকা ও সর্বশেষ নয়াদিল্লিতে সচিব পর্যায়ের বৈঠকের পর ১৯৮৫ সালে সাতটি দেশের সরকারপ্রধানদের ঢাকায় এক শীর্ষ সম্মেলনে এটি গঠিত হয়। সার্কের বর্তমান সদস্য দেশ ৮টি। দেশগুলো হলো বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ ও আফগানিস্তান। পর্যবেক্ষক দেশ ও সংস্থা ৯টি; এগুলো হচ্ছে চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, মিয়ানমার, যুক্তরাষ্ট্র, ইরান, মরিশাস ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এর সদর দপ্তর নেপালের কাঠমান্ডু। সার্কের বর্তমান ও ত্রয়োদশ মহাসচিব আমজাদ হোসেন বি সিয়াল (পাকিস্তান ১ মার্চ ২০১৭ – বর্তামন)।
সার্কের সহযোগিতার ক্ষেত্রেসমূহ : ১৯৮৫ সালের জন্মলগ্ন থেকে জুন ২০১৪ পর্যন্ত সার্কের ১৮টি শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ২৬-২৭ নভেম্বর ২০১৪ নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে ১৮তম শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় এবং ২০১৬ সালে ১৯তম শীর্ষ সম্মেলন পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেপ্টেম্বর ২০১৬ ভারতের জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের উরি এলাকায় পাকিস্তানি জঙ্গিবাহিনীর হামলার প্রতিবাদে ভারত, বাংলাদেশ, আফগানিস্তান ও ভুটান এ সম্মেলনে অংশগ্রহণ না করার ঘোষণা দেয়। বিগত শীর্ষ সম্মেলনে সহযোগিতার নিম্নোক্ত ক্ষেত্রসমূহ নির্ধারিত হয়েছে-
১. কৃষি ও পল্লী উন্নয়ন,
২. জৈব প্রযুক্তি,
৩. যোগাযোগ তথ্য এবং গণমাধ্যম,
৪. অর্থনীতি,
৫. সার্ক জ্বালানি,
৬. পরিবেশ,
৭. তহবিল গঠন,
৮. মানব সম্পদ উন্নয়ন,
৯. আইন সংক্রান্ত,
১০. জনগণের সাথে যোগাযোগ উন্নয়ন,
১১. দারিদ্র্য বিমোচন,
১২. বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি,
১৩. সার্ক আলোচ্যসূচি,
১৪. সার্ক বহু ধরনের আঞ্চলিক পরিবহন পর্যবেক্ষণ করা,
১৫. সার্ক পর্যটন।
সার্কের সাফল্য/আঞ্চলিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে সার্কের সাফল্য : দীর্ঘ আড়াই দশকে সার্ক সীমিত কিন্তু প্রশংসনীয় কিছু কাজ করেছে। উদাহরণস্বরূপ- সন্ত্রাস দমনে সমঝোতা দলিলে স্বাক্ষর; আঞ্চলিক খাদ্য নিরাপত্তা সৃষ্টি; পরিবহন ও যোগাযোগ ক্ষেত্রে সহযোগিতা; জৈব প্রযুক্তি, পরিবেশ, আবহাওয়া, বনজসম্পদ এবং গণমাধ্যম সেক্টরে পারস্পরিক সহযোগিতা; আঞ্চলিক দারিদ্র্য প্রোফাইল প্রস্তুতকরণ; সাপটা (SAPTA) ও সাফটা (SAFTA) গঠন ইত্যাদি। তাছাড়া সার্ক কৃষি তথ্য কেন্দ্র, সার্ক যক্ষ্মা সেন্টার, সার্ক ডকুমেন্টেশন সেন্টার, সার্ক আবহাওয়া গবেষণা কেন্দ্র, সার্ক জ্বালানি কেন্দ্র ইত্যাদি সার্কের সাফল্যের প্রতীক। সার্কের ইতিবাচক দিকের মধ্যে আরো আছে সার্ক শীর্ষ সম্মেলন প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হওয়া (যদিও বিভিন্ন কারণে কয়েক বছর সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়নি), মন্ত্রিপর্যায়ের বিভিন্ন নিয়মিত সভা, সদস্য দেশসমূহের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে পারস্পরিক অভিমত বিনিময়ও সহযোগিতার নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে। এরূপ উচ্চপর্যায়ের সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার ফলে বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে একে অপরের দৃষ্টিভঙ্গি অনুধাবন, বৃহত্তর সমঝোতা এবং পারস্পরিক বিশ্বাস অর্জন সম্ভব হচ্ছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে পাকিস্তানের সাথে ভারতের সম্পর্কের অবনতি হলে ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিতব্য ১৯তম সার্ক সম্মেলন প্রায় সব সদস্য রাষ্ট্র কর্তৃক বর্জনের ফলে অনেকেই সার্কের ভবিষ্যৎ অন্ধকার দেখছেন।
দারিদ্র্য বিমোচন : দক্ষিণ এশিয়ার বিশাল জনগোষ্ঠী দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে বিধায় সার্ক দেশসমূহ সব শীর্ষ সম্মেলনেই দারিদ্র্য বিমোচন নিয়ে আলোচনা করে। এসব সম্মেলনে দারিদ্র্য বিমোচন নিয়ে আলোচনা করে। এসব সম্মেলনে দারিদ্র্য বিমোচনে অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের আনুকূল্যে প্রণীত দারিদ্র্য বিমোচন কৌশলপত্র (PRSP) বাংলাদেশ ইতোমধ্যে প্রণয়ন ও চূড়ান্ত করে ফেলেছে। এখন যদি জাতীয় দারিদ্র্য বিমোচন প্রক্রিয়া এবং সার্ক কাঠামোগত আঞ্চলিক দারিদ্র্য বিমোচন উদ্যোগের মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক স্থাপন করা যায় তাহলে বাংলাদেশসহ সার্কভুক্ত সকল দেশের দারিদ্র্য কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। তবে দারিদ্র্য একটি বহুমাত্রিক ধারণা। তাছাড়া দারিদ্র্য বিমোচন অনেকগুলো কর্মপরিকল্পনার মধ্যেও নিবিড়ভাবে লুক্কায়িত। তারপরও দক্ষিণ এশিয় সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানগণ দারিদ্র্য বিমোচনে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক অঙ্গীকারসমূহকে সামনে রেখে সার্ক কর্মকাণ্ডকে জোরালো করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সার্ক সহাসচিব কর্তৃক প্রণীত দারিদ্র্য সূচকের ভিত্তিতে সার্ক অঞ্চলে দারিদ্র্যের অবস্থা মনিটর ও পর্যবেক্ষণের জন্য মন্ত্রিপর্যায়ের কাউন্সিলকে নির্দেশ দিয়েছে এবং নেপালকে আহ্বায়ক ও বাংলাদেশকে সহ-আহ্বায়ক করে দারিদ্র্য বিমোচন কমিশন গটন করেছে, যা একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
সামাটিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন : ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিত দ্বাদশ শীর্ষ সম্মেলনে সামাজিক সনদ সই একটি যুগান্তকারী অর্জন। এ অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর জীবনে এই সনদের বিভিন্ন দিকের বাস্তবায়ন যেমন দারিদ্র্য বিমোচন, জনসংখ্যা স্থিতিশীলকরণ, নারীদের সক্ষমতা দান, যুব সঞ্চালন, মানবসম্পদ উন্নয়ন, শিশুদের স্বাস্থ্য উন্নয়ন, পুষ্টি এবং তাদের নিরাপত্তা বিধান ইত্যাদি বিষয়ে সনদটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। সামাজিক সনদ এ প্রসঙ্গে এইডস, যক্ষ্মা এবং অন্যান্য বহনযোগ্য ব্যাধি নিরোধে ডাক্তারি দক্ষতা, ফার্মাসিউটিক্যাল ও সনাতনী ওষুধ সম্পদ উন্নয়নের ওপর জোর দেয়। সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয় নেতারা সনাতনী দ্ক্ষতা, শিল্প ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ের ওপর জোর দিয়েছেন। দক্ষিণ এশিয়ার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারক হিসেবে শ্রীলংকার ক্যান্ডিতে সার্ক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র স্থাপন এক্ষেত্রে মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।
সার্কের ব্যর্থতা ও এর কারণ : জনসংখ্যায় সার্ক বিশ্বের বৃহৎ আঞ্চলিক সংগঠন হলেও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংগঠন আসিয়ানের (ASEAN) মতো সফলতা অর্জন করতে পারেনি। বিশেষজ্ঞদের মতে, সার্কের ব্যর্থতার অন্যতম কারণ সদস্য দেশগুলোর নেতৃবর্গের আঞ্চলিক মতানৈক্য দূর করে অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করার ব্যাপারে অনীহা বা তা করার ব্যাপারে তাদের অযোগ্যতা এবং পাক-ভারত রাজনৈতিক বিরোধ। বিশেষজ্ঞরা সার্কের ব্যর্থতার ৩টি কারণ চিহ্নিত করেছেন-
১. রাজনৈতিক সমস্যা,
২. নেতৃত্বের সমস্যা এবং
৩. কাঠামোগত সমস্যা।
তবে সার্কের ব্যর্থতার মূল কারণ পাক-ভারত রাজনৈতিক বিরোধ। কাশ্মীর ও পারমাণবিক ইস্যু নিয়ে দুটি দেশের মধ্যে বিরোধ রয়েছে। ফলে বিঘ্নিত হচ্ছে সার্কের সামগ্রিক গতিধারা। অপরদিকে, দক্ষিণ এশিয়ার বৈশিষ্ট্যগত বাধাও সার্কের সফলতার অন্যতম অন্তরায়। সামাজিক ও শিক্ষাগত অনগ্রসরতার কারণে এ অঞ্চলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, বিরোধ, অবিশ্বাস, প্রতিদ্বন্দ্বিতা এমনকি প্রকাশ্য বৈরিতাও মাঝে মাঝে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। দক্ষিণ এশিয়ার এসব ঐশিষ্ট্যগত বাধার কারণেও সার্ক অনেকাংশে ব্যর্থ হচ্ছে। সার্কের ব্যর্থতার আরো একটি বড় কারণ ভারতের প্রভুসুলভ মানসিকতা। দক্ষিণ এশিয়ার এ আটটি দেশের বিরোধ অনেকাংশেই ভারতকেন্দ্রিক। সদস্যভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে আয়তন ও জনসংখ্যায় ভারত সর্ববৃহৎ ও সুবিশাল হওয়ার কারণে বিরোধ মীমাংসার ক্ষেত্রে ভারত অধিকাংশ ক্ষেত্রে যুক্তিসঙ্গত ছাড় দিতেও রাজি হয় না। এ অঞ্চলের রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং যোগ্য নেতৃত্বের অভাব সার্কের সফলতার পথে বিরাট অন্তরায়।
সার্কের ভবিষ্যৎ সংগঠন : সার্কের কার্যাবলীর মধ্যে নতুন সংগঠন হিসেবে দক্ষিণ এশিয় শুল্ক সংস্থা (SACU) এবং দক্ষিণ এশিয় অর্থনৈতিক ইউনিয়ন গঠন প্রধান। এ লক্ষ্যে প্রাসঙ্গিক বিষয়ে বিস্তর সমীক্ষা ও প্রচুর শ্রমসাপেক্ষ কাজ চলছে। যেমন – সংবেদনশীল তালিকা, উৎপত্তির নীতিসমূহ, সেবা খাতে বাণিজ্য, শ্রমিক আন্দোলন, মান নিয়ন্ত্রণ, বিনিময় হার নির্ধারণ কৌশল, সাধারণ এক্সটারনাল ট্যারিফ প্রস্তুতকরণ এবং আরো আনুষঙ্গিক বিষয়ের সমস্যা চিহ্নিতকরণ এবং তার সম্ভাব্য সমাধান অনুসন্ধান ইত্যাদি।
উপসংহার : বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ ও আফগানিস্তান – এ ৮টি দেশের আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা সার্কের গুরুত্ব ও আকর্ষণ পর্যায়ক্রমে বাড়ছে বিশ্বের উন্নত দেশ ও আঞ্চলিক ফোরামগুলোর কাছে। বিশ্বের মোট জনগোষ্ঠীর এক-চতুর্থাংশের প্রতিনিধিত্ব করছে এই সার্ক। যদিও এ বিরাট জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে, তবুও আমাদের সকলের প্রত্যাশা সার্কের পরবর্তী ১৯তম শীর্ষ সম্মেলনের মাধ্যমে পিছনের সকল গ্লানি, দৈন্য ধুয়ে আবার মাথা তুলে দাঁড়াবে। বাস্তবসম্মত ও অঙ্গীকারবদ্ধ পদক্ষেপের মাধ্যমে সংগঠনটির পুনরুজ্জীবনে অগ্রদূত হিসেবে কাজ করবে এবং এমন এক রাজনৈতিক দূরদৃষ্টির সৃষ্টি করবে, যা অনুসরণ করে এ সংগঠনটি আগামী নিগুলোতে আরো সাফল্যের দিকে এগিয়ে যাবে।
[ বি:দ্র: নমুনা উত্তর দাতা: রাকিব হোসেন সজল (বাংলা নিউজ এক্সপ্রেস)] |
Paragraph & Composition/Application/Emali | উত্তর লিংক | ভাবসম্প্রসারণ | উত্তর লিংক |
আবেদন পত্র/প্রতিবেদন/ চিঠি ও ইমেল | উত্তর লিংক | প্রবন্ধ, অনুচ্ছেদ রচনা | উত্তর লিংক |
এখানে সকল প্রকাশ শিক্ষা বিষয় তথ্য ও সাজেশন পেতে আমাদের সাথে থাকুন ।
প্রশ্ন ও মতামত জানাতে পারেন আমাদের কে ইমেল : info@banglanewsexpress.com
আমরা আছি নিচের সামাজিক মাধ্যম গুলোতে ও