পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকচক্র পূর্ব বাংলাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কি কি কৌশল অবলম্বন করেছিল আলোচনা কর।
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পৃথিবীর পঞ্চম বৃহত্তম রাষ্ট্ররূপে পাকিস্তান আত্মপ্রকাশ করে। প্রত্যেকে আশা করেছিল, অচিরেই স্বাধীনতার উত্তম ফসল সকলের জীবনকে সার্থক করবে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের জনগণ আশা করেছিল, পাকিস্তানে তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হবে এবং সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবনে নেমে আসবে সার্থকতার উজ্জ্বল আলোক। কিন্তু কয়েকটি জটিল কারণের জন্য তা সফল হয় নি। এ কারণগুলো অনুধাবন করা একান্তভাবে প্রয়োজন। বস্তুত পাকিস্তান যাত্রা শুরু করেছিল তার বিভিন্ন অংশের, বিশেষ করে পূর্ব ও পশ্চিম অংশের মধ্যে মৌলিক ব্যবধান মাথায় নিয়ে।
ভাষায় সাহিত্যে, পোশাক-পরিচ্ছদে, আহার- বিহারে, জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিতে, শিল্প ঐতিহ্যে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের অধিবাসীদের মধ্যে মিল ছিল খুবই কম। উভয়ের মধ্যে মিলনের একমাত্র সেতু ছিল ধর্ম ইসলাম। পশ্চিম পাকিস্তানের প্রায় সকলেই মুসলমান এবং পূর্ববাংলার শতকরা ৮০ জন ব্যক্তিই ইসলাম ধর্মাবলম্বী। সুতরাং যাত্রা শুরুকালেই পাকিস্তান ব্যবধান ও বিভেদের প্রাচীরে বারে বারে ধাক্কা খেয়েছে। এ ব্যবধানের তীব্রতা আরও বৃদ্ধি পায় ভৌগোলিক কারণে।
কেননা, পাকিস্তানের পূর্ব ও পশ্চিম অংশের মধ্যে ব্যবধান ছিল প্রায় এক হাজার মাইল আর দুই অংশের মধ্যে ছিল ভারতের বিশাল ভূখণ্ড এবং ভারত প্রথম থেকেই ছিল পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বৈরীভাবাপন্ন। সে যাহোক, পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকচক্র পূর্ব বাংলাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এবং তাদের কায়েমী স্বার্থ আদায়ের জন্য নানান কৌশল অবলম্বন করে তাদের কর্তৃত্ব বজায় রেখেছিল। আমাদের এ আলোচনায় এসব কারণ পর্যালোচনা করা হয়েছে।
পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকচক্র কর্তৃক পূর্ব বাংলাকে নিয়ন্ত্রণ ও বৈষম্যমূলক আচরণের কৌশলসমূহ ঃ নিচে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক চক্রের হীনম্মন্য নীতি, নিয়ন্ত্রণ কৌশল ও বৈষম্যমূলক আচরণের কৌশলসমূহ আলোচনা করা হল :
১. ভাষা : উর্দু যদিও পাকিস্তানের কোন অংশের মাতৃভাষা ছিল না তথাপি উর্দুকে একক রাষ্ট্রভাষা করার প্রশ্নে কেবলমাত্র একটি যুক্তি ছিল, তা হল উর্দু হরফ আরবি ও ফারসি হরফের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ও মুঘল ঐতিহ্যের ধারাবাহী । ইসলামি রাষ্ট্র পাকিস্তানের ইসলামি ভাবধারার জনগণের কাছে এ ভাষা গ্রহণযোগ্য হবে এ বিশ্বাসে শাসকবর্গ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তবে এ সিদ্ধান্তের পেছনে যে মূল ঘটনা ছিল তা হল, জিন্নাসহ পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন শাসকবর্গের ভাষা ছিল উর্দু এবং উর্দুকে উচ্চ শ্রেণীর মুসলমানদের ভাষা হিসেবে বিবেচনা করা হতো। তাছাড়া একাধিক ভাষা নিয়েও একটি জাতিসত্তা সৃষ্টি হতে পারে সেই ধারণা বা বিশ্বাস মিঃ জিন্নাহ্র ছিল না। ফলে ভাষাগত কৌশল খাটিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানিরা পূর্ব বাংলার মানুষকে দমিয়ে রাখার এবং শাসন ও শোষণের পায়তারা করেছিল ।
২. সাংস্কৃতিক আগ্রাসন : ভাষা ছাড়াও দুই পাকিস্তানের পৃথক পৃথক সংস্কৃতি এবং উভয় অংশের মধ্যে হাজার মাইল দূরত্বের ব্যবধানের ফলে দুই অংশের আর্থসামাজিক কাঠামোতেও ছিল ভারসাম্যের অভাব। পূর্ব বাংলার স্বল্পতর ভূখণ্ডের তুলনায় জনসংখ্যা ছিল বেশি। অন্যদিকে, পশ্চিম পাকিস্তানে ভূখণ্ডের পরিমাণ বেশি হলেও জনবসতির ঘনত্ব ছিল কম। সিন্ধু, বেলুচিস্তান ও উত্তরপশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এ তিনটি অপেক্ষাকৃত কম উন্নত প্রদেশ হলেও পাঞ্জাব ছিল অপেক্ষাকৃত উন্নত ও সমৃদ্ধশালী এবং পাঞ্জাবিরাই পশ্চিম পাকিস্তানের সর্বক্ষেত্রে প্রাধান্য বিস্তার করেছিল।
৩. সামরিক শাসন : ১৯৫৮ হতে ১৯৬২ (মে মাস) পর্যন্ত পাকিস্তানে পূর্ণ সামরিক আইন ও সামরিক শাসন বলবৎ ছিল। সে সময় আইয়ুব খান যে শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করে তা ছিল কার্যত ‘সাংবিধানিক একনায়কত্ব’। ১৯৫৬ সালের সংবিধানে যেটুকু স্বায়ত্তশাসন ও গণতান্ত্রিক অধিকার ছিল ১৯৬২ সালের সংবিধানের দ্বারা তাও কেঁড়ে নেওয়া হয়। এর অধীনে প্রকৃত ক্ষমতা ন্যস্ত ছিল রাষ্ট্রপতির হাতে এবং রাষ্ট্রপতির শীর্ষস্থানীয় উপদেষ্টাগণ প্রায় সকলেই ছিলেন জনসমর্থনহীন তোষামোদকারী। আইয়ুবের অধীনে ১৬ জন বাঙালি মন্ত্রিত্ব করেন। তাঁদের মধ্যে ৪ জন ছিলেন প্রাক্তন আমলা ও একজন সাংবাদিক। অবশিষ্ট ১১ জন ছিলেন মুসলিম লীগ নেতা, যাদের মধ্যে ৮ জনই ছিলেন ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে পরাজিত ব্যক্তি। আইয়ুব আমলে রাজনৈতিক অংশগ্রহণ সীমিত থাকার ফলে নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে সামরিক ও বেসামরিক আমলাগণ মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। কিন্তু এ আমলাবাহিনীতে বাঙালিদের সংখ্যা ছিল নগণ্য।
( তথ্য সূত্র : Talukder Maniruzzaman; Radical Politics and the Emergence of Bangladesh, Dhaka; 1972, P-34. | সামরিক বাহিনীতে বাঙালিদের সংখ্যা ছিল আরও কম। ১৯৬৫ সালে মোট ১৭ জন জেনারেল, লেঃ জেনারেল ও মেজর জেনারেলের মধ্যে মাত্র ১ জন মেজর জেনারেল ছিলেন বাঙালি। (তথ্য সূত্র : K. B. Sayeed, The Political System of Pakistan, Boston, 1967, P-196.] সেনাবাহিনী, নৌ বাহিনী ও বিমান বাহিনীর অফিসার শ্রেণীতে বাঙালিদের প্রতিনিধিত্ব ছিল যথাক্রমে ৫%, ১০% ও ১৬%। (তথ্য সূত্র : Debates, Vol-1, 1963, PP-29-30.1
৪. প্রশাসনিক কৌশল : পাকিস্তানের জাতীয় নেতৃত্ব শাসনতন্ত্র প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় তিনটি প্রধান বিষয়ে বিতর্কের সম্মুখীন হয়েছিল। যেগুলো মোকাবিলা করতে গিয়ে উভয় অংশের মধ্যে নানান প্রকার দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের সৃষ্টি হয়েছে। তিনটি প্রধান বিতর্কিত বিষয় ছিল- ক. কেন্দ্রীয় আইনসভার জনপ্রতিনিধিত্বের ভিত্তি, খ, প্রদেশগুলোকে প্রদেয় স্বায়ত্তশাসনের মাত্রা, গ. পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত প্রদেশগুলোর পদমর্যাদা অর্থাৎ সেগুলো কি পৃথক প্রদেশ হিসেবে অস্তি ত্ব বজায় রাখবে না সবগুলো একই সাথে সমন্বিত হবে। দু’দিক থেকেই ক্ষমতাবান পাঞ্জাবিরা উভয় সঙ্কটে ছিল। অঞ্চলভিত্তিক প্রতিনিধিত্ব হলেও পূর্ব-পাকিস্তান ও পশ্চিমাঞ্চলের অন্য তিনটি প্রদেশ ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠতার দাবিদার। অন্যদিকে, জনসংখ্যাভিত্তিক প্রতিনিধি প্রেরণের ব্যবস্থা বলে পূর্ব পাকিস্তান ছিল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার দাবিদার ।
৫. আমলাতান্ত্রিক কৌশল : কেন্দ্রীয় সরকার আমলাতন্ত্রের মাধ্যমেও পূর্ব-পাকিস্তান তথা পূর্ব বাংলাকে নিয়ন্ত্রণ করত। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানে আগত মোট ৯৫ জন আই.সি.এস এবং আই.পি.এস অফিসারের মধ্যে মাত্র ১ জন ছিলেন বাঙালি। সুতরাং পাকিস্তানের প্রথম দশকে কেন্দ্রীয় ও পূর্ব বাংলার সচিবালয়ে সকল মুখ্য পদে পশ্চিম পাকিস্তানিরা অধিষ্ঠিত ছিল। এক হিসাব মতে, ১৯৫৬ সালে কেন্দ্রীয় সচিবালয় মোট ১৯৩ জন সচিব, যুগ্ম সচিব ও উপসচিবের মধ্যে বাঙালি ছিলেন মাত্র ১৩ জন এবং তাদের মধ্যে কেউই সচিবের পদে ছিলেন না। (তথ্য সূত্র : আবুল মনসুর আহমেদ, আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর, (তৃতীয় সংস্করণ); ঢাকা, ১৯৭৫, পৃঃ ৩৪ ।]
৬. অর্থনৈতিক বৈষম্য সৃষ্টি : ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান মূলত এক কৃষি নির্ভর অর্থনীতির উত্তরাধিকারী হয়। জন্মলগ্নে পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্তর ছিল প্রায় একই রূপ। শুরুতে যদিও পূর্ব পাকিস্তানে মাথাপিছু আয় পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় কম ছিল, জাতীয় আয়ের ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের অবদান ছিল বেশি (প্রায় ৫২%)। কিন্তু পরবর্তীতে পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অগ্রগতির হার দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৯৫৪-১৯৫৫ সালে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের আঞ্চলিক উৎপাদন একই সমান হয় এবং ১৯৫৯-৬০ অর্থ বছরে পশ্চিম পাকিস্তানের আঞ্চলিক আয় পূর্ব পাকিস্তানের আয়কে ছাড়িয়ে যায়। ১৯৪৯-১৯৫০ সালে পূর্ব পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় কমে গিয়ে ২২৮ টাকা হয়। অপরদিকে, পশ্চিম পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেয়ে ৩৭৩ টাকায় দাঁড়ায়।
[তথ্য সূত্র : Gustav A. Papanek; Pakistan’s Development: Social Goals and Private Incentives; Cambridge; 1967; P-20.] এভাবে ১৯৬৪-১৯৬৫ সালে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মাথাপিছু আয়ের বৈষম্য ছিল ৪৬%। পাকিস্তানের তৃতীয় পঞ্চম বার্ষিকী পরিকল্পনার (১৯৬৫-১৯৭০) অন্যতম ঘোষিত লক্ষ্য ছিল দুই অঞ্চলের মধ্যে মাথাপিছু আয়ের বৈষম্য ২০% কমানো, কিন্তু বাস্তবে ১৯৬৯-৭০ সালে এ বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়ে ৬০% এ দাঁড়ায়। [তথ্য সূত্র : Government of East Pakistan; Economic Survey of East Pakistan; 1969-’70; Dhaka; 1970; P. 15.1 এ ব্যাপক বৈষম্যের কারণগুলোর মধ্যে ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে অধিক হারে রাজস্ব ও উন্নয়ন ব্যয় করা এবং পূর্ব পাকিস্তানের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার একটি মোটা অংশ পশ্চিম পাকিস্তানে শিল্পোন্নয়নে বিনিয়োগ করা।
এক হিসেব মতে, ১৯৪৮-‘৪৯ হতে ১৯৬৮-৬৯ সালের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান হতে পশ্চিম পাকিস্তানে মোট ৪১৯ কোটি টাকার সম্পদ হস্তান্তর করা হয়। তাছাড়া, বৈদেশিক সাহায্য বণ্টনের ক্ষেত্রে দুই অঞ্চলের মধ্যে বৈষম্য করা হয়। ১৯৫০-৬৯ সময়ের মধ্যে পাকিস্তান ৫৬৮৩ মিলিয়ন ডলার বৈদেশিক সাহায্য লাভ করে। এর মধ্যে মাত্র ১৯৪১ মিলিয়ন ডলার অর্থাৎ ৩৪% পূর্ব পাকিস্তানে ব্যয় করা হয়। [তথ্য সূত্র : Government of Pakistan; Reports of Advisory Pannels for the Fourth Five year plan, vol. 1; Islamabad, 1970; PP. 2292791 সরকারের এ অর্থনৈতিক নীতির ফলে পশ্চিম পাকিস্তান দ্রুত শিল্পোন্নত অঞ্চল হিসেবে গড়ে উঠে এবং পূর্ব পাকিস্তান এর উপনিবেশ তথা রক্ষিত বাজারে পরিণত হয়। এমনকি, পূর্ব পাকিস্তানের বেসরকারি শিল্পসমূহের ৪৩% এর মালিকানা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানিদের হাতে এবং ব্যাংক ও বীমা ব্যবসায়ে তাদের একচেটিয়া আধিপত্য ছিল।
৭. দৃষ্টিভঙ্গিগত : পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বাংলাদেশের মুসলমানদের বরাবরই সন্দেহের চোখে দেখে এসেছে এ ধারণায় যে, বাংলাদেশের মুসলমানরা হিন্দু বাংলার সাংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট, হিন্দু রবীন্দ্রনাথের ভক্ত, নিজস্ব জীবনবোধ ও সংস্কৃতির প্রতি অধিকতর শ্রদ্ধাশীল এবং মুসলিমদের ভাষা উর্দু (?) অপেক্ষা বাংলা ভাষার প্রতি সর্বাধিক অনুরক্ত।
৮. কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অবহেলা : পাকিস্তানের উভয় অংশের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠায় কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ব্যর্থতায় উভয় অংশের মধ্যে একাত্মতা স্থাপনের কোন সুষ্ঠু ব্যবস্থা গৃহীত হয় নি। বরং জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলার মনোভাব গ্রহণ করে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ভারত বিদ্বেষী মনোভাব জাগ্রত করার প্রচেষ্টা করছে সব সময়। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক জীবনের প্রতি সন্দেহপরায়ণ হয়ে তাই প্রথম থেকে বাংলাদেশে এক বিজাতীয় সংস্কৃতি চাপিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা হয়েছে। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ নিজেই ঘোষণা করেন একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা, যদিও তা রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় কোনক্রমেই যুক্তিযুক্ত ছিল না। কেননা সমগ্র পাকিস্তানের শতকরা ৮ জন লোক উর্দু ভাষায় কথা বলে, অথচ বাংলাভাষী ছিল শতকরা ৫৬ জন। তাই দেখা যায়, ভাষা সমস্যাকে কেন্দ্র করেই সর্বপ্রথম ভাঙনের সূত্রপাত হয়।
৯. ভঙ্গুর মনোভাব : বাঙালিরা ‘পুরাপুরি মুসলমান নয়’, এ মনোভাবের ফলে পাকিস্তানের মৌলিক আদর্শে বাঙালিরা কোনদিন একাত্মতা অনুভব করেন নি। বাঙালিরা তাদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে ভালবাসে। বাঙালিরা ধর্মকে ভালবাসে। কিন্তু ২৩ বছরের ইতিহাসে বাঙালিরা কোন দিন ‘প্রকৃত বাঙালি’ হয়ে প্রকৃত ‘পাকিস্তানি’ হবার সুযোগ লাভ করে নি।’ (In the whole mange of history of Pakistan, East Pakistan’s did not get any opportunity to the loyal Pakistanis and true Bengalis which they wanted to become.”- Tapper)। এমনকি ১৯৭১ সালের সংগ্রামী দিনগুলোতেও পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী বাংলাদেশের মুসলমানদের হত্যা করে ‘বিধর্মী’ হত্যার অপার আনন্দ অনুভব করেছিল। সুতরাং আদর্শের কাঠামোয় উভয় অংশের অধিবাসীরা কোনদিনই ঐক্যবদ্ধ হতে পারে নি।
আরো ও সাজেশন:-
১০. ভারত বিদ্বেষ ও সন্দেহের প্রশ্ন : পাকিস্তানের ভারত বিদ্বেষের কারণ অনেকটা ঐতিহাসিক। ভারত বিভাগ তথা পাকিস্তান সৃষ্টি কোন দিনই ভারতের কাম্য ছিল না। কিন্তু ভারত বিদ্বেষ পাকিস্তানের এক চূড়ান্ত নীতিতে পরিণত হয়ে উঠে এবং অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে তার গুরুত্ব বিশিষ্ট হয়ে উঠে। ভারত বিদ্বেষনীতি পশ্চিম পাকিস্তানে ঐক্যবোধ সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়েছিল বটে। কিন্তু বাংলাদেশে তা এক বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে এবং কায়েমী স্বার্থের ধারক বাহক হয়ে উঠে। তাই দেখা যায়, বাংলাদেশে যখনই পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ চরমে উঠেছে তখনই তাকে ‘ভারতের চক্রান্ত’ বা ‘ভারতের চরদের কলাকৌশল’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের উদ্যোক্তারা, মুক্তিবুদ্ধিসম্পন্ন রাজনৈতিকেরা, স্বায়ত্তশাসনের আহ্বান করা, আওয়ামী লীগের ছয় দফা, এমনকি শেষ পর্যায়ে স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর সৈনিকেরা পর্যন্ত ‘ভারতের চর’ এবং ‘চক্রান্ত’ বলে চিহ্নিত হয়েছেন।
১১. রাজনৈতিক ক্ষমতা চর্চা : পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অবাস্তব পরিকল্পনা, পাকিস্তানে এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থার প্রচলন ও কেন্দ্রকে শক্তিশালী করতে দৃঢ় সংকল্প পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী ( Muling elites) প্রথম থেকে চেষ্টা করেছে কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাকে সুদৃঢ় করতে, প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থাকে কেন্দ্রের অধীনে ন্যস্ত করতে এবং কেন্দ্রে এক প্রকার একনায়কসুলভ শক্তিকেন্দ্র স্থাপন করতে। তা একদিকে যেমন ছিল ইতিহাসের গতিধারা বিরোধী, অন্যদিকে তেমন ভৌগোলিক অবস্থানের সঠিক অনুধাবনহীনতা। পাকিস্তানের এ গতিপ্রকৃতি পরিলক্ষিত হয় প্রথম থেকেই। জিন্নাহর মৃত্যুর পর খাজা নাজিমুদ্দীন গভর্নর জেনারেল হলে পাকিস্তানের সর্বপ্রথম মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকারের স্বরূপ প্রকাশিত হয়। কিন্তু তা ছিল অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী। লিয়াকত আলী খানের মৃত্যুর পর খাজা নাজিমুদ্দিন প্রধানমন্ত্রী হন এবং গভর্নর জেনারেল হন গোলাম মোহাম্মদ। তিনি ছিলেন একজন উচ্চ পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা। তিনি ছিলেন উচ্চাকাঙ্ক্ষী, ক্ষমতা লিপ্সু এবং ষড়যন্ত্রপ্রিয়। তাঁরই আমলে পাকিস্তানে ‘প্রাসাদ ষড়যন্ত্র’ শুরু হয় এবং সীমিত রাজনীতির পথ প্রশস্ত হয়।
১২. সংখ্যাধিক্য নীতি না মানা : কেন্দ্রীয় সরকারে বাংলাদেশ থেকে সমান সংখ্যক মন্ত্রী নিযুক্ত হলেও এবং গণপরিষদে বাংলাদেশ থেকে অধিক সংখ্যক সদস্য থাকা সত্ত্বেও তাঁরা পূর্ব বাংলার স্বার্থ রক্ষায় ব্যর্থ হন। কেননা, তাঁদের ক্ষমতা ছিল সীমিত এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ পর্যায়ে তাদের কোন ভূমিকা ছিল না। এভাবে পশ্চিম পাকিস্তানিরা পূর্ব বাংলার মানুষদেরকে শাসন ও শোষণ করার জন্য বিভিন্ন ধরনের কৌশল গ্রহণ করে।
[ বি:দ্র: উত্তর দাতা: রাকিব হোসেন সজল ©সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত (বাংলা নিউজ এক্সপ্রেস)]
১৩. উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা নিয়োগে বৈষম্য : স্থায়ী কর্মকর্তাদের কর্তৃত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত হবার ফলে বাংলাদেশের সমূহ ক্ষতি হল। কেননা, বাংলাদেশ থেকে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সংখ্যা ছিল অত্যন্ত নগণ্য এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের চূড়ান্ত পর্যায়ে কোন দিনই কোন বাঙালি কর্মচারী সুযোগ লাভ করেন নি।
১৪. প্রেসিডেন্টের সর্বময় কর্তৃত্ব ও মৌলিক গণতন্ত্র : ১৯৫৮ সালে সমগ্র দেশে সামরিক শাসন প্রবর্তিত হলে দেশে রাজনৈতিক কার্যকলাপের সমাপ্তি ঘটে। ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের শাসন কাঠামোয় বাংলাদেশে সঠিক প্রতিনিধিত্ব না থাকলেও অন্তত দাবি-দাওয়া উত্থাপন করার পথ ছিল উন্মুক্ত। কিন্তু ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসনের পর সে পথও রুদ্ধ হল। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভাগ্যে যা এসেছে তা শূন্যের নামান্তর। ১৯৬২ সালের সংবিধানে প্রেসিডেন্টের সর্বময় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রেসিডেন্টের দ্বারা এবং প্রেসিডেন্টের জন্য ( A government by the president of the president and for the president.) শাসনব্যবস্থার শীর্ষে ছিলেন প্রেসিডেন্ট এবং শাসনকার্য পরিচালিত হতো সিভিল সার্ভিস ও সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তাদের দ্বারা। এর ফল হয় অত্যন্ত বিষময় ।
পরবর্তীতে আইয়ুব খান মৌলিক গণতন্ত্রের মাধ্যমে এক যোগসূত্র স্থাপনে প্রয়াসী হন, যা অল্প সময়ে প্রতিক্রিয়াশীল এক ব্যবস্থায় রূপ লাভ করে এবং গণবিরোধী স্বার্থের প্রতিনিধি হয়ে উঠে। মৌলিক গণতন্ত্রে না ছিল কোন মৌলিকত্ব, না ছিল গণতন্ত্রের নামগন্ধ। তার লক্ষ্য সামরিক কর্তৃপক্ষ ও সিভিল সার্ভিসের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের হাতে ক্ষমতার সমাবেশ ঘটানো। ১৯৬২ সালের সংবিধানে এ মৌলিক গণতন্ত্রকে শাসনব্যবস্থার ভিত্তিরূপে দাঁড় করানো হয়। ফলে প্রেসিডেন্ট হয়ে উঠেন রাষ্ট্রের সর্বময় কর্তা। শক্তিশালী কেন্দ্র, প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার দাবির অস্বীকৃতি, বিশেষ করে শাসনব্যবস্থায় বাংলাদেশের যোগ্য প্রতিনিধিত্ব দানে অস্বীকৃতি এবং সর্বোপরি দেশে রাজনৈতিক কর্মধারাকে জোর করে স্তব্ধ করার মানসিকতা- সবকিছু মিলিয়ে পাকিস্তানকে সংকটের দিকে টেনে আনে।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকচক্র পূর্ব-পাকিস্তান তথা বাংলাদেশকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এমন সব কৌশল অবলম্বন করেছিল যা পশ্চিম পাকিস্তানের স্বার্থ রক্ষা করে এবং বাংলাদেশের শাসন ও শোষণের পথ প্রশস্ত করে। ফলে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বিরোধ ও সম্পর্কের অবনতি বৃদ্ধি পায়।
রচনা ,প্রবন্ধ | উত্তর লিংক | ভাবসম্প্রসারণ | উত্তর লিংক | Paragraph | উত্তর লিংক |
আবেদন পত্র ও Application | উত্তর লিংক | অনুচ্ছেদ রচনা | উত্তর লিংক | Composition | উত্তর লিংক |
চিঠি ও Letter | উত্তর লিংক | প্রতিবেদন | উত্তর লিংক | CV | উত্তর লিংক |
ইমেল ও Email | উত্তর লিংক | সারাংশ ও সারমর্ম | উত্তর লিংক | Seen, Unseen | উত্তর লিংক |
Essay | উত্তর লিংক | Completing Story | উত্তর লিংক | Dialog/সংলাপ | উত্তর লিংক |
অনুবাদ | উত্তর লিংক | Short Stories/Poems/খুদেগল্প | উত্তর লিংক | Sentence Writing | উত্তর লিংক |
প্রশ্ন ও মতামত জানাতে পারেন আমাদের কে ইমেল : info@banglanewsexpress.com
আমরা আছি নিচের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুলোতে ও
- ইজারাদাতার অবশিষ্ট মূল্য সম্পর্কে আলোচনা কর
- ইজারা গ্রহীতার বইয়ের হিসাব সংরক্ষণের প্রক্রিয়া আলোচনা কর
- ইজারা দাতার প্রত্যক্ষ ইজারার অর্থায়ন পদ্ধতি ধারণা সহ আলোচনা কর
- ইজারা ও মালিকানা পার্থক্য । ইজারা vs মালিকানা পার্থক্য
- ইজারা অর্থসংস্থানের সুবিধা ও অসুবিধা সমূহ লিখ, ইজারা অর্থসংস্থানের সুবিধা ও অসুবিধা গুলো বিস্তারিত আলোচনা কর
- ইজারা অর্থসংস্থানের আর্থিক প্রভাব সমূহ আলোচনা কর