পরিচয় পর্ব ।। আব্রাহাম লিংকন আত্মজীবনী পাঠ-১

আব্রাহাম লিংকন (১২ ফেব্রুয়ারি ১৮০৯ – ১৫ এপ্রিল ১৮৬৫) একজন মার্কিন রাজনীতিবিদ ও আইনজীবী ছিলেন। তিনি ১৮৬১ সাল থেকে ১৮৬৫ সালে তার হত্যার আগপর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১৬তম রাষ্ট্রপতি ছিলেন। নৈতিক, সাংস্কৃতিক, সাংবিধানিক এবং রাজনৈতিক সঙ্কট তিনি আমেরিকাকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তিনি ইউনিয়ন সংরক্ষণ, দাসত্ব বিলোপ, ফেডারেল সরকারকে মজবুত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে আধুনিকীকরণে সফল হন।

লিংকন কাঠের গুরি দিয়ে তৈরি একটি ঘরে দারিদ্র্যের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং মূলত ইন্ডিয়ানার সীমান্তে বেড়ে ওঠেন। তিনি স্ব-শিক্ষিত ছিলেন যার পেছনে অনুপ্রেরণা দিয়েছেন উনার বাবা-মা।তিনি মূলত তাঁর বাবার জন্যই পড়াশোনা চালিয়ে গেছেন শত দারিদ্রতার মধ্যে।তিনি তাঁর বন্ধুদের পুরাতন বই সংগ্রহ করে পড়তেন এবং এভাবেই শিক্ষিত হয়েছেন। তিনি একজন আইনজীবী, ইলিনয় রাজ্যের বিধায়ক এবং ইলিনয় থেকে মার্কিন কংগ্রেস সদস্য হয়েছিলেন। ১৮৪৯ সালে, তিনি তার আইন অনুশীলনে ফিরে আসেন তবে দাসত্বের জন্য অতিরিক্ত জমি খোলার জন্য কানসাস – নেব্রাস্কা আইনের দ্বারা উদ্বেগিত হন। তিনি ১৮৫৪ সালে নতুন রিপাবলিকান পার্টির নেতা হয়ে রাজনীতিতে নতুনভাবে প্রবেশ করেন এবং স্টিফেন ডগলাসের বিরুদ্ধে ১৮৫৮ সালের বিতর্কে তিনি জাতীয় দর্শকের কাছে পৌঁছেছিলেন। লিঙ্কন ১৮৬০ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে লড়েছিলেন এবং উত্তরের জয়ের পথ সুদুরপ্রসারিত করেছিলেন। দক্ষিণে দাসত্বের পক্ষের উপাদানগুলি তার সাফল্যের সাথে উত্তরের দাসত্ব অনুশীলনের অধিকার প্রত্যাখ্যান করে এবং দক্ষিণ রাজ্যগুলি ইউনিয়ন থেকে পৃথক হওয়া শুরু করে। এর স্বাধীনতা সুরক্ষার জন্য, নতুন কনফেডারেট স্টেটস দক্ষিণের মার্কিন কেল্লা ফোর্ট সামিটের উপর গুলি চালিয়েছিল এবং লিংকন এই বিদ্রোহ দমনে এবং ইউনিয়ন পুনরুদ্ধার করার জন্য বাহিনী গঠন করেছিলো।

মধ্যপন্থী রিপাবলিকানদের নেতা হিসাবে, লিংকনকে উভয় পক্ষের বন্ধু এবং বিরোধীদের সাথে এ বিতর্কিত দলগুলিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে হয়েছিলো । যুদ্ধ-ডেমোক্র্যাটস তাদের মধ্যপন্থী শিবিরে প্রাক্তন বিরোধীদের একটি বিশাল দলকে সমাবেশ করেছিলেন, তবে তাদের বিরুদ্ধে সহজাত-রিপাবলিকানরা পাল্টা লড়াই করেছিলেন, যারা দক্ষিণ সত্রুবাহিনির কঠোর শাস্তি দাবি করেছিলেন। যুদ্ধবিরোধী ডেমোক্র্যাটরা (যাকে “কপারহেডস” বলা হয়) তাকে তুচ্ছ করে, এবং দুর্নীতিহীন-কনফেডারেটপন্থি উপাদানগুলি তার হত্যার পরিকল্পনা করেছিল। লিংকন তাদের পারস্পরিক শত্রুতা কাজে লাগিয়ে, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার সাহায্যে তাদের বিতরণ করে এবং মার্কিন জনগণের কাছে আবেদন জানিয়ে দলগুলিকে পরিচালনা করেছিলেন।

জানা অজানা

তাঁর ঐতিহাসিক গেটিসবার্গের ভাষণের ফলে তিনি প্রজাতন্ত্রবাদ, সম অধিকার, স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্রের প্রবক্তা হয়ে ওঠে।তিনি দক্ষিণের জেনারেলদের উপর নিষেধাজ্ঞা এবং নৌ অবরোধ দিয়ে সেখানকার বাণিজ্যে প্রভাব ফেলার মাধমে যুদ্ধের কৌশলে আগিয়ে জান।তিনি হবিয়াস কর্পসকে সাময়িক বরখাস্ত করেছিলেন এবং তিনি ট্রেন্ট বিষয়কে অবজ্ঞা করে ব্রিটিশদের হস্তক্ষেপকে এড়িয়ে গেছেন। তিনি তার “মুক্তি মুক্তি” ঘোষণা এবং সেনাবাহিনী প্রাক্তন দাসদের রক্ষা এবং নিয়োগের আদেশ দিয়ে দাসত্বের অবসান ঘটিয়েছিলেন। তিনি সীমান্ত রাজ্যগুলিকে দাসত্ব নিষিদ্ধ করার জন্য উত্সাহিত করেছিলেন, এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর প্রচার করেছিলেন, যা দেশজুড়ে দাসত্বকে নিষিদ্ধ করেছিল।

লিংকন তার নিজের পুনরায় নির্বাচন প্রচার সফলভাবে পরিচালনা করেছিলেন। তিনি যুদ্ধ-বিধ্বস্ত জাতিকে পুনর্মিলনের মাধ্যমে সুস্থ করার চেষ্টা করেছিলেন। অ্যাপোমাটক্সে যুদ্ধ শেষ হওয়ার কয়েক দিন পরে ১৮৬৫ সালের ১৪ এপ্রিল লিঙ্কন তাঁর স্ত্রী মেরির সাথে ফোর্ডের থিয়েটারে একটি নাটকে অংশ নিচ্ছিলেন তখন চুক্তিবদ্ধ জন উইলকস বুথ তাকে হত্যা করেছিলেন। তার বিবাহের পরে চার পুত্র জন্ম হয়েছিল, তাদের মধ্যে দু’জন মারা যাওয়ায় তাদের ও মেরির উপর প্রচণ্ড মানসিক প্রভাব ফেলেছিল। লিংকনকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শহীদ নায়ক হিসাবে স্মরণ করা হয় এবং তিনি ধারাবাহিকভাবে আমেরিকান ইতিহাসের অন্যতম সেরা রাষ্ট্রপতি হিসাবে স্থান পান।

আব্রাহাম লিংকন একজন রূচিপূর্ণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন যার পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর একটি চিঠির দ্বারা।যেটি তিনি পাঠিয়েছিলেন তাঁর পুত্রের শিক্ষকের কাছে।

মাননীয় মহাশয়,

আমার পুত্রকে জ্ঞানার্জনের জন্য আপনার কাছে প্রেরণ করলাম। তাকে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবেন-এটাই আপনার কাছে আমার বিশেষ দাবি।

আমার পুত্রকে অবশ্যই শেখাবেন- সব মানুষই ন্যায়পরায়ণ নয়, সব মানুষই সত্যনিষ্ঠ নয়। তাকে এ-ও শেখাবেন প্রত্যেক বদমায়েশের মাঝেও একজন বীর থাকতে পারে, প্রত্যোক স্বার্থপর রাজনীতিকের মাঝেও একজন নিঃস্বার্থ নেতা থাকে। তাকে শেখাবেন প্রত্যেক শত্রুর মাঝে একজন বন্ধু থাকে। আমি জানি এটা শিখতে তার সময় লাগবে, তবুও যদি পারেন তাকে শেখাবেন পাঁচটি ডলার কুড়িয়ে পাওয়ার চেয়ে একটি উপার্জিত ডলার অধিক মূল্যবান। এ-ও তাকে শেখাবেন, কীভাবে পরাজয়কে মেনে নিতে হয় এবং কীভাবে বিজয়োল্লাস উপভোগ করতে হয়। হিংসা থেকে দূরে থাকার শিক্ষাও তাকে দেবেন। যদি পারেন নীরব হাসির গোপন সৌন্দর্য তাকে শেখাবেন। সে যেন আগ-ভাগেই এ কথা বুঝতে শেখে যারা পীড়নকরী তাদেরই সহজে কাবু করা যায়। বইয়ের মাঝে কি রহস্য লুকিয়ে আছে তা-ও তাকে বুঝতে শেখাবেন।

আমার পুত্রকে শেখাবেন, বিদ্যালয়ে নকল করার চেয়ে অকৃতকার্য হওয়া অনেক বেশি সম্মানজনক। নিজের ওপর তার যেন সুমহান আস্থা থাকে। এমনকি সবাই যদি সেটাকে ভুলও মনে করে। তাকে শেখাবেন ভদ্রলোকের প্রতি ভদ্র আচরণ করতে, কঠোরদের প্রতি কঠোর হতে। আমার পুত্র যেন এ শক্তি পায় হুজুগে মাতাল জনতার পদাঙ্ক অনুসরণ না করার। সে যেন সবার কথা শোনে এবং তা সত্যের পর্দায় ছেঁকে যেন ভালোটাই শুধু গ্রহণ করে- এ শিক্ষাও তাকে দেবেন সে যেন শেখে দুঃখের মাঝে কিভাবে হাসতে হয় আবার কান্নার মাঝে যে লজ্জা নেই-এ কথা তাকে বুঝতে শেখাবেন।

যারা নির্দয়, নির্মম তাদের সে যেন ঘৃণা করতে শেখে আর অতিরিক্ত আরাম-আয়েশ থেকে সাবধান থাকে। আমার পুত্রের প্রতি সদয় আচরণ করবেন কিন্তু সোহাগ করবেন না। কেননা আগুনে পুড়েই ইস্পাত খাঁটি হয়। আমার সন্তানের যেন অধৈর্য হওয়ার সাহস না থাকে, থাকে যেন তার সাহসী হওয়ার ধৈর্য। তাকে এ শিক্ষাও দেবেন নিজের প্রতি তার যেন সুমহান আস্থা থাকে আর তখনই তার সুমহান আস্থা থাকবে মানবজাতির প্রতি।

সশ্রদ্ধ সালাম, আব্রহাম লিংকন।

জানা অজানা

Leave a Comment