দ্বিজাতি তত্ত্ব তাৎপর্য বণনা কর, দ্বিজাতি তত্ত্ব গুরুত্ব প্রয়োজনীয়তা আলোচনা কর, দ্বিজাতি তত্ত্ব উদ্দেশ্য সমূহ আলোচনা কর

দ্বিজাতি তত্ত্ব তাৎপর্য বণনা কর, দ্বিজাতি তত্ত্ব গুরুত্ব প্রয়োজনীয়তা আলোচনা কর, দ্বিজাতি তত্ত্ব উদ্দেশ্য সমূহ আলোচনা কর


দ্বি-জাতি’ তত্ত্ব সম্পর্কে আলোচনা কর

দ্বিজাতিতত্ত্ব  ভারত ও পাকিস্তান নামে দু’টি স্বাধীন জাতি ও রাষ্ট্র গঠনের মাধ্যমে ভারতকে রাজনৈতিকভাবে দ্বিধাবিভক্ত করার নির্ণায়ক ও আদর্শাশ্রয়ী একটি রাজনৈতিক মতবাদ। ভারত থেকে ব্রিটিশ শাসন অবসানের প্রাক্কালে বিশ শতকের চল্লিশের দশকে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ দ্বিজাতি তত্ত্বের এ ধারণার উন্মেষ ঘটান। মতবাদটির একটি নির্বাচন-সংক্রান্ত প্রেক্ষাপট রয়েছে। ১৯০৯, ১৯১৯ ও ১৯৩৫ সালের পর্যায়ক্রমিক সাংবিধানিক সংস্কার আইনের ভিত্তিতে হিন্দু ও মুসলমানদের জন্য পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। পৃথক নির্বাচনী ব্যবস্থায় মুসলমানগণ প্রাদেশিক আইনসভা এবং আইন পরিষদের জন্য ভারতের মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল থেকে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করার অধিকার রাখত। এর ফলে বাংলা ও উত্তর-পশ্চিম প্রদেশসমূহে মুসলিম মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থার মাধ্যমে ক্ষমতা গ্রহণের পরেই মুসলিম নেতৃবৃন্দের ভাবোদয় হয় যে, পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থার সুফল দ্বারা দুটি পৃথক জাতীয়তাবাদী চিন্তার উদ্রেক সম্ভব যাকে ‘দ্বিজাতিতত্ত্ব’ অভিধায় আখ্যায়িত করা যায়। কারণ, ভারতের মুসলিম জনগোষ্ঠী ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও সামাজিকভাবেই পৃথক একটি জাতি গঠন করতে সক্ষম।

দ্বিজাতি তত্ত্ব উদ্দেশ্য ও গুরুত্ব বা প্রয়োজনীয়তা আলোচনা কর

মুসলমানদের একটি জাতি হিসেবে আত্মপরিচয়ের সন্ধানে উদ্বুদ্ধ করতে স্যার সৈয়দ আহমদ খান (১৮১৭-১৯৮) প্রথম এ ধারণার উন্মেষ ঘটান। তিনি ভারতের মুসলমানদের কংগ্রেস দলের তথাকথিত জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের স্রোতে গা ভাসাতে নিরূৎসাহিত করতেন। তিনি প্রচার করেন যে, ভারতীয় মুসলিম তাদের নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় একটি জাতি গঠন করবে এবং স্বশাসনের জন্য কংগ্রেস কর্তৃক পরিচালিত আন্দোলনের সঙ্গে মুসলমানদের জোটবদ্ধ হওয়া উচিৎ হবে না। তাঁর এ ধারণা উপনিবেশিক শাসকদের সমর্থন লাভ করে। কারণ ভারতে কংগ্রেস কর্তৃক যে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল তার নিয়ন্ত্রনের জন্য শাসক পক্ষের যেকোন একটি দলের সমর্থন লাভের প্রয়োজন ছিল।

দ্বিজাতি তত্ত্ব তাৎপর্য বণনা কর

প্রাদেশিক পর্যায়ে সাংবিধানিক কুশাসন প্রক্রিয়ার ফলে সৃষ্ট কংগ্রেসের অসহযোগী মনোভাব কংগ্রেসের জাতীয়তাবাদী রাজনীতি থেকে বেশ সংখ্যক মুসলিম রাজনৈতিককে বিচ্ছিন্ন করে দেয় এবং এর ফলে যে মুসলিম লীগ ১৯২৯ সাল পর্যন্ত মৃতপ্রায় অবস্থায় ছিল, তাই দিনে দিনে বাংলায় এবং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশের রাজনীতির বাহকে পরিণত হয়। ১৯৩০ সালের ডিসেম্বর মাসে সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে কবি ও দার্শনিক স্যার মুহাম্মদ ইকবাল দ্বিজাতিতত্ত্বের তাত্ত্বিক কাঠামো উপস্থাপন করেন। মুসলিম প্রতিনিধিত্ব দলের মনোভাবকে লন্ডনের গোলটেবিল বৈঠকে প্রতিক্রিয়াশীলবাদের উপর ভিত্তিশীল বলে পন্ডিত জওহরলাল নেহেরু যে মন্তব্য করেন তার প্রতিবাদে স্যার মুহাম্মদ ইকবাল বক্তব্য দিতে গিয়ে ‘মুসলিম জাতীয়তাবাদ’ সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গীর বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেন। ইকবাল তাঁর বক্তব্যের উপসংহারে বলেন:

দ্বিজাতি তত্ত্ব বলতে কি বুঝায়?

‘উপসংহারে পন্ডিত জওহরলাল নেহেরুর নিকট আমি সরাসরি একটি প্রশ্ন রাখতে চাই যে, সংখ্যা গরিষ্ঠদের দ্বারা আট কোটি সংখ্যালঘুদের ন্যুনতম নিরাপত্তা বিধান স্বীকার না করে, এমনকি তৃতীয় পক্ষের রোয়েদাদকেও (ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ম্যাকাডোনালের ঘোষিত সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ) মেনে না নিয়ে কী করে ভারতের সমস্যার সমাধান সম্ভব; অথচ যার যার স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে এক ধরনের জাতীয়তাবাদ নিয়ে আলোচনা চলছে? এহেন অবস্থায় মাত্র দু’টি বিকল্প পথ খোলা আছে। হয় ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় কর্তৃক পূর্বাঞ্চলে নিজেদের জন্য ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের স্থায়ী প্রতিনিধির পদকে স্বীকার করে নেওয়া, অথবা ধর্মীয়, ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক সাজুস্যের ভিত্তিতে দেশকে অবশ্যই পুনর্বণ্টন করে (পৃথক) নির্বাচনী ব্যবস্থা ও সাম্প্রদায়িক সমস্যার বিদ্যমান অবস্থার সমাধান করা।’

দ্বিজাতি তত্ত্বে কী বলা হয়েছে?

১৯৪০ সালের ২২-২৩ মার্চ তারিখে লাহোরে বাংলাসহ ভারতের একাধিক প্রদেশে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের সম্মেলনের সভাপতির ভাষণে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তাঁর দ্বিজাতিতত্ত্বের চূড়ান্ত ব্যাখ্যা তুলে ধরেন। তাঁর বক্তব্য ছিল নিম্নরূপ:

দ্বিজাতি তত্ত্ব বলতে কি বুঝ

‘এটা মেনে নিতে কষ্ট হয় যে, কেন আমাদের হিন্দু বন্ধুগণ ইসলাম ও হিন্দু মতবাদের মূল প্রকৃতি অনুধাবন করতে অপারগ হচ্ছেন। তাঁরা কঠোর অর্থে ধার্মিক নন, অথচ পৃথক ও সুনির্দিষ্ট সামাজিক বিন্যাসের ক্ষেত্রে তাঁরা ধার্মিক হিসেবে প্রতীয়মান হন। হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায় একত্রে একটি সাধারণ জাতীয়তাবাদী ভিত্তি গড়ে তোলারে বিষয়টি আসলে একটা স্বপ্ন ছাড়া কিছুই নয় এবং আমরা যদি সময় থাকতে আমাদের জাতিকে গড়ে তুলতে বিফল হই তবে ‘এক ভারতীয় জাতি’ নামক এই ভুল ধারণাটি পূর্বেও যেরূপ সমস্যার সৃষ্টি করেছে, ভবিষ্যতেও তা ভারতকে ধ্বংসের দিকে টেনে নিবে। হিন্দু মুসলমান- উভয় সম্প্রদায়ই পৃথক ধর্মীয় দর্শন, সামাজিক রীতি, সাহিত্য প্রভৃতির ক্ষেত্রে দু’টি পৃথক প্রকৃত অবস্থার মধ্যে অবস্থান করে। তারা কখনো নিজেদের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে না, বা একসঙ্গে কোনো অনুষ্ঠানও করে না, এবং প্রকৃত অর্থেই তারা পারস্পারিক দ্বন্দ্বপূর্ণ ধারণা ও পরিকল্পনার উপর নির্ভরশীল দু’টি পৃথক মেরুতে অবস্থানকারী পৃথক দুটি জাতি। জীবন ও জীবনধারন সম্পর্কে তাদের ধারণাও ভিন্ন। এটা সুস্পষ্ট যে, হিন্দু ও মুসলমানগণ ইতিহাসের পৃথক পৃথক উৎস থেকে প্রেরণা আহরণ করেছে। তাদের রয়েছে পৃথক মহাকাব্য, পৃথক জাতীয় বীর ও পৃথক উপাখ্যান। প্রায়ই দেখা গিয়েছে যে, এক জাতির নায়ক অন্য জাতির খলনায়ক এবং অনুরূপভাবে একের বিজয়গাথা অন্যের পরাজয়কে চিহ্নিত করে। এভাবে সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় হিসেবে দু’টি জাতিকে এক আঙ্গিকে একটি একক রাষ্ট্রের অধীনে আনার যেকোন প্রয়াসের ক্ষেত্রে অসন্তোষ দেখা দিবে এবং এ ধরণের যে কোনো প্রয়াসই চূড়ান্ত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে।’

দ্বি-জাতি তত্ত্ব এক ঐতিহাসিক বাস্তবতা


দ্বিজাতি তত্ত্বের গুরুত্ব : ভারতীয় মুসলমানদের ইতিহাসে দ্বিজাতি তত্ত্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে মুসলমানদের সকল দাবিদাওয়া উত্থাপনের ক্ষেত্রে নতুন পথ লাভ করে। এর গুরুত্ব নিচে দেওয়া হলো :
১. মুসলিম জাতীয়াতাবাদের চূড়ান্ত উন্মেষ : তত্ত্ব প্রকাশের পর মুসলিম জাতীয়তাবাদের চূড়ান্ত উন্মেষ ঘটে। মুসলমানরা নিজেদের পৃথক জাতি হিসেবে তাদের অধিকার ও দাবি সম্পর্কে অধিক সচেতন হয়।
২. ব্রিটিশ সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ : দ্বিজাতি তত্ত্ব ঘোষণা, ব্রিটিশ সরকারকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে যে, ভারতে মুসলমানরা একটি পৃথক জাতি এবং এদের দাবিদাওয়াও ভিন্ন। তাদের দাবিদাওয়ার প্রতি পৃথক দৃষ্টিভঙ্গি ও গুরুত্ব প্রদান করতে হবে।
৩. মুসলমানদের সমস্যার সুরাহা : এ দ্বিজাতি তত্ত্ব প্রকাশের পর মুসলমানদের বিভিন্ন সমস্যার একটি নির্দিষ্ট সুরাহা মিলে।
৪. লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তি : জিন্নাহর দ্বিজাতি তত্ত্বের আলোকের ভিত্তিতে ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব পেশ করা হয় যাতে মুসলমানদের জন্য পৃথক আবাসভূমির দাবি করা হয়।
৫. জিন্নাহর সুখ্যাতি : এ তত্ত্ব প্রকাশের পর ভারতের মুসলমানদের কাছে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর খ্যাতি বৃদ্ধি পায়। তিনি মুসলিম লীগের গুরুত্বপূর্ণ আসনে অধিষ্ঠিত হন।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, জিন্নাহ এর দ্বিজাতি তত্ত্ব ঘোষণার মাধ্যমে ভারতের মুসলমানেরা ভারতবাসীকে জানিয়ে দেয় যে, ভারতের মুসলমান সম্পূর্ণ পৃথক- ধর্ম, মূল্যবোধ, সংস্কৃতি, সামাজিক প্রথা ও রীতিনীতি সংবলিত জাতি এবং তাদের পৃথক দাবি ও স্বার্থ রয়েছে যা সরকারকে পৃথক দৃষ্টিভঙ্গি ও গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করতে হবে।

দ্বিজাতি তত্ত্ব গুরুত্ব প্রয়োজনীয়তা আলোচনা কর

দ্বিজাতি তত্ত্ব তাৎপর্য বণনা কর, দ্বিজাতি তত্ত্ব গুরুত্ব প্রয়োজনীয়তা আলোচনা কর, দ্বিজাতি তত্ত্ব উদ্দেশ্য সমূহ আলোচনা কর

Leave a Comment