চ্যাপলিন হাসির আড়ালে কান্নার গল্প

চ্যাপলিন; আজও চমৎকার, চ্যাপলিন হাসির সওদাগর। চ্যাপলিন মরে ভূত হয়েও হৈ হৈ হল্লার ফোয়ারা হয়ে বেঁচে আছে।

প্রত্যেক পিতার ভেতর একজন চ্যাপলিন বাস করে; অন্তত অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘চ্যাপলিন’ নামের বাংলা মুভিটা দেখলে এই কথাটা অবলীলায় মনে হবে৷ রুদ্রনীল ঘোষ আর ছোট্ট সোহম মৈত্র অভিনীত এই মুভিটা যদি স্বয়ং চার্লি চ্যাপলিন দেখতেন, তাহলে আমি নিশ্চিত; তিনি বলতেন ‘এটা আমার বলা সেই বিশ্বস্ত বন্ধু -আয়না, আমি কাঁদলে যে হাসেনা।’

কলকাতার এক ভাঙাচোরা বস্তিঘরে বাপবেটার বসত। বাপ বিয়েশাদি আর বার্থডে পার্টিতে চ্যাপলিন সেজে সবাইকে বিনোদিত করে৷ ছোট্ট ছেলেটা বাবার সঙ্গে যায়। দেখে বাবা কত সহজে চ্যাপলিনে বদলে গিয়ে তার জন্য খাবারদাবারের খোরাক জোগায়। সবসময় যে, বাবার যথাযথ পারিশ্রমিক জুটে, তা নয়। অনেকেই ঠকায়।

তবু পার্টিতে বিনোদন-প্রদান শেষে বাপবেটা মিলে যখন খাবার খেতে বসে, তখন রুটির সঙ্গে মাংসহীন ঝোলকেই মাংস ভেবে ‘রাজভোগ’ সারে তারা। স্বপ্নে দরিদ্র বাবা আদরের ছেলেকে ভাল ভাল খাবার খাওয়ায়, রঙিন আলোর বিছানায় ঘুম পাড়ায়। আর বাস্তবিক সকালবেলায় ওঠে দুজনে আবিষ্কার করে, ঘরে কিচ্ছু নেই খাওয়ার।

বাবা চ্যাপলিনের মতোই অবোধ্য ধ্বনিতে সব কিছু ভুলিয়ে দেয়। এদিক-সেদিক চেয়েচিন্তে, চালাকি করে যেভাবে বিপন্ন বাবা তার সন্তানের আবদার পূরণ করতে ব্যাকুল, তা দেখে মমতাজউদ্দিন আহমদের বইয়ের শিরোনামটা মনে পড়ে আমাদের ‘চার্লি চ্যাপলিন: ভাঁড় নয়, ভবঘুরে নয়।’
চ্যাপলিন সেজে বাবা কত কত শিশুর জন্মদিনে আনন্দ দেয় কিন্তু নিজের ছেলের জন্মদিন করার সুযোগ হয়নি কখনও, কারণ ভাতই জুটেনা ঠিকঠাক, আবার জন্মদিন! তবে একদিন বাড়ি ফিরে বাবা দেখে, ছেলে তার ঘুমের ঘোরে বার্থডে বয় হয়ে উল্লাস করছে৷ মুহূর্তে তা আর্তির মতো বাজে বাবার বুকে। ভাবে, যেভাবেই হোক, ছেলের আগামী জন্মদিনটা পালন করবে সে। ইতিমধ্যে একটা বড় শো-তে নিজের অভিনয় প্রদর্শনের সুযোগ পায় আমাদের কলকাত্তাইয়া চ্যাপলিন। তার সঙ্গে প্রতারণা করে তাকে ঠেকিয়ে রাখতে চেষ্টা করে সমাজেরই সেইসব সুশীল বাবুরা, যারা তাকে তার প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করে, লাথিগুঁতোয় মনে করিয়ে দিতে চায় যে, সে শিল্পী নয়, আদতে একটা ভাঁড়।

কিন্তু প্রস্তুতিহীন মহড়া-মঞ্চে নিজের ভনিতাহীন অভিনয়কলা দিয়ে চ্যাপলিন সবাইকে মুগ্ধ করে, কিছু টাকাপয়সাও আসে। হ্যাঁ, এই দিয়ে ছেলেটার আসন্ন জন্মদিনটা ভালভাবে পালন করা যাবে ভেবে দারুণ আহলাদিত সে। কিন্তু জন্মদিনের আগে আগে জানা গেল, মায়াবী ছেলেট জটিল অসুখ বাঁধিয়ে মৃত্যুর পথে একটু একটু করে পা বাড়াচ্ছে। চ্যাপলিনের হাসির গোডাউন যেন রূপ নেয় বিষাদের সমুদ্র অথৈ।
নিজের এতদিনের অভিনয়কলার প্রতিটি হাস্যরস এখন তাকে বহুগুণ বেগের দুঃখধারা হয়ে ভাসিয়ে নিতে থাকে৷ ভাসতে ভাসতে তবু বাবা একটু থিতু হয়ে ছেলের এতকালের সব বায়না মেটাতে থাকে। তুমুল ঘোরাঘুরি, ভাল খাওয়াদাওয়া আর জন্মদিনের অপেক্ষা। চ্যাপলিনের চূড়ান্ত শো’র দিন আসে। সবাই অধীর অপেক্ষায়৷ অডিশনে যা দেখিয়েছে তার চেয়েও অসাধারণ কিছু করে তাক লাগিয়ে দেবে সে। কারণ সে তো শিল্পী মূলত, ভাঁড়ামি তে তার প্রয়োজনীয় পরচুলা-মাত্র। সবাই ঘড়ি দেখছে কিন্তু চ্যাপলিন কোথায়!

চ্যাপলিন তো তার হৃদয়ঘরের বারান্দায়। আজ যে তার আদরের ছেলেটার জন্মদিন। আলোঝলমল শো -তে নিজেকে প্রদর্শনের বদলে শহরের বন্ধ হলের অন্ধকারে বাবা এই প্রথম শুধু তার সন্তানের জন্য নিজের সর্বোচ্চ অভিনয় প্রদর্শন করতে শুরু করল৷ ছেলে এতকাল বাবাকে দেখেছে বড়লোকের বাচ্চাদের জন্মদিনে আনন্দ দিতে৷ সে কাছে দাঁড়িয়ে ভেবেছে, ইশ, যদি বাবা কখনও আমাকেও এমন আনন্দ দিত। আমাকেও বলতো, ‘হ্যাপি বার্থডে টু ইউ….’ আজ সে মাহেন্দ্রমুহূর্ত। বাবা যেন সত্যিকারের চার্লি চ্যাপলিন হয়ে গিয়ে ছেলেকে নিয়ে যাচ্ছে হাসির জোয়ারে, আনন্দের অনন্ত উজানে ।
শো’-এর আয়োজকরা তাকে কোথাও না পেয়ে আসে সেই হলে। এসে দেখে আজ যেন, নিজের ভেতরের শ্রেষ্ঠ চ্যাপলিনকে বের করে আনছে, এক মৃত্যুপথযাত্রী সন্তানের প্রিয় বাবা; যার কাছে নিজ জীবন আর সন্তানে একবিন্দু ভেদ নেই৷ ভেতরের এতকালের অবরুদ্ধ কান্না আজ হাসির আদলে বেরিয়ে আসছে আর ছেলে ; যেন সে প্রাণ-প্রদর্শনীর শ্রেষ্ঠতম শ্রোতাদর্শক করতালিতে ফেটে পড়ছে৷ আর কতটুকু আনন্দ পাওয়ার থাকতে পারে একজন পিতার?

চারপাশের সবাই এ দৃশ্যের দর্শক না শুধু, তারা এ দৃশ্যজলের ভেতর নিজেদের বেদনা -সাঁতার কাটে অনায়াসে, অনিন্দ্য -আনন্দের ডাঙায় উঠবে বলে। মানুষের অসুখবিসুখ তো হয় মরার জন্য বা সেরে উঠার জন্য। মুভির শেষেও আমরা এ দুটোর যেকোনো একটি তো দেখেই থাকি৷ এখানেও তাই।

তবে, আমরা এই মুভি শেষ করে কাছেধারে কোথায় যেন স্বয়ং চার্লি চ্যাপলিন মশাইকেও তার হাসিসমগ্র রুমালে মুছে রোদনের ল্যাম্প জ্বেলে বলতে শুনি, হে দর্শক,আমি তো আর কিছু না, মৃত্যুর মুখে নিত্য দাঁড়িয়ে জীবনের এই অনন্য সেলিব্রেশন।

Leave a Comment