“চোর কাহিনী” রুদ্র অয়ন

“চোর কাহিনী” রুদ্র অয়ন

আবুল ফজল । এলাকার নাম করা চোর। তবে ফজলু বলতেই সবাই একনামে চেনে তাকে।
বিষন্ন মনে উঠোনে বসে আছে। তার বউ জরিনাকে দেখে দীর্ঘশ্বাস চাপতে চাপতে বললো, ‘দেখ বউ, দিনকাল বদলে গেছে।মানুষের মধ্যে বিচার বিবেচনা উঠে যাচ্ছে। আমি বয়সে গ্রামের অনেকের বড়। অথচ গ্রামের মানুষ আমাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে। ছোটখাট চুরির বিষয় নিয়ে মাতামাতি করে। সেদিন পুকুর পাড়ে বসে আছি। আরমান মেম্বারের কলেজ পড়া ছেলেটা একটা মোটর সাইকেলে ভোঁ ভোঁ হর্ণ বাজিয়ে হাওয়াই সার্টের বোতাম খুলে এসে কড়া গলায় জিজ্ঞেস করলো, কে ওখানে? কি করিসরে তুই ওখানে? আমি ভাঙা গলায় জবাব দিলাম, কোন লাট সাহেবের বেটা রে তুই যে বাপের বয়সি একজনের সাথে এভাবে কথা বলিস? মেম্বারের ছেলে একটু লজ্জাও পেলোনা। বললো তোর মত চোর মানুষকে আপনি করে বলতে হবে কেন? বলো জরিনা আমি কি গ্রামের কারো চুরি করি? তা ছাড়া আমি মাদ্রাসা, মক্তব, এতিমখানা সবখানে দান খয়রাত করি। কিন্তু আজও আমি একজন সফল চোর হতে পারলামনা, সহায় সম্পত্তি কিছু করতে পারলামনা। ওর বাপ আরমান মেম্বার, লতিফ চেয়ারম্যান ওরা যে গরিবের রিলিফের বস্তা বস্তা চাল, গম, টিন চুরি করে খাচ্ছে, সেকথা কি আমরা ওদের সামনে বলতে পারি, তুই তুকারি তো দূরের কথা।’
এক নাগারে কথাগুলো বলে থামলো ফজলু। তারপর আবার বলতে লাগলো,
‘বুঝলি জরিনা, মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে এলাকা ছেড়ে চলে যাই। নেহাত বাপদাদার ভিটা এখানে, তাই এ অঞ্চলে পড়ে থাকা, নইলে ঝাটা মেরে কবে ছেড়ে চলে যেতাম।’

‘এসব কথা বলতে আপনের শরম করেনা? চুরিও করবেন, আবার মানুষের প্রশংসা পাওয়ার লোভও করবেন, এটা কেমন কথা?’ বলে জরিনা।

‘তুই এটা কেমন কথা কইলি জরিনা? চুরি করি বলে আমার মান সন্মান কিছুই নাই!’

‘আচ্ছা এতই যদি মান সন্মানে লাগে, তবে এই পেশা ছেড়ে আর কিছু করেননা কেন?’

‘চুরিচামারির কাম ছাড়া অন্য কিছু করতে পারিনা, করতে ভালো লাগেনা।’ গলার স্বর নিচু করে ফজলু বললো।

‘কেন?’

‘এই একটাই বিদ্যা আমার। চুরি বিদ্যা। অন্য কোন বিদ্যা আমার জানা নাই। তাছাড়া তুইতো জানোস আমরা কয়েক পুরুষ ধইরা চোর। আমার দাদাও ছিলো চোর। এই জেলার মধ্যে শ্রেষ্ঠ চোর ছিল। তার নাম শোনা মাত্র এলাকার গৃহস্থরা আঁতকে উঠতো। বৃদ্ধ বয়সে যখন সে চলাচল করতে পারতোনা, তখন দূর দুরান্ত থেকে লোকজন তাকে একনজর দেখতে আসতো। চুরি পেশা আমার শিরায় শিরায়, রক্তে রক্তে ; বুঝলি জরিনা।’

‘তাও আপনে চুরি চামারি ছাইড়া ভালো হয়ে যাবেন এই এক কথা আমার। তার আগে আমার জন্য পাঁচ ভরি সোনা চুরি করেন। আমার অনেক দিনের শখ। যে কয়টা দিন বাঁচি আরাম কইরা বাঁচি। ভালমন্দ কিছু খাবার খাই। দুই হাতে চার গাছি সোনার চুরির আমার বড় শখ। আর গলার একটা হার।’

‘চিন্তা করিসনা বউ। তোর শখ পুরণ করবো। লতিফ চেয়ারম্যানের বাড়িতে অনেক সোনাদানা আছে। খবর পাইছি। তক্কে তক্কে আছি। তবে জানিস কি বউ, দিনকাল বদলে গেছে। বেশ কিছুদিন হলো গ্রামে বিদ্যুৎ চলে এসেছে। সবার হাতে এখন হাই ভোল্টেজের চারজার লাইট, মোবাইল ফোন। এখন চুরি করা আর আগের মত সোজা নয়। মনে হয় শেষমেশ পৈত্রিক এই পেশাটি ছেড়েই দেয়া লাগবে।’ এসব চিন্তা ভাবনা করতে করতে ফজলুর প্রচন্ড মাথা ধরে গেল।

কৃষ্ণপক্ষের রাত। ঘুট ঘুটে অন্ধকার। চারিদিকে আবার মহামারী শুরু হয়েছে! করোনার প্রকোপে দুনিয়াজুড়ে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে! দেশ দুনিয়ায় কিযে শুরু হলো! চারিদিকে শ্মশানের নিস্তব্দতা। খাম্বার বিদ্যুতের বাতির ঝাপসা আলো এতো দূর থেকেও দেখা যায়। গায়ে কয়েক জায়গায় তারপিন তেল মেখে একটা কালো গেঞ্জি চাপিয়ে থলি আর তেলের শিশি নিয়ে মন্ত্র জপতে জপতে বেরিয়ে পড়ল ফজলু চোর। সরু একটা রাস্তার শেষে একটা মাঠ। মাঠটা পেরোলেই চেয়ারম্যানের বাড়ি। মাঠের মাঝখানটায় বড় বট গাছের নিচে যেখানে গ্রামের চ্যাংড়া ছেলেগুলো আড্ডা দেয় সেখানে বসে পড়ল ফজলু চোর। মৃদুমন্দ বাতাসে শুকনো পাতা পড়ার শব্দ। ঝিঝি ডাকছে চার পাশে। কয়েকটা বাদুড় উড়ে গেল দূরের আকাশে। উত্তরের বিলের ওপারে শ্মশান থেকে শিয়ালের ডাক ভেসে আসছে।

একটুখানি পরে আবারও সে বলতে লাগলো, ‘আমি ভেঙ্গে পড়ি নাই। আমার মত ঝানু চোরের ভেঙ্গে পড়া মানায়ওনা। এই তল্লাটে চুরির লাইনে আমার ধারে কাছেও কেউ নেই। গত ত্রিশ বছরে একবার মাত্র ধরা পড়েছি। কাজেই দশদিন চোরের একদিন গেরস্থের কথাটা আমার বেলায় খাটেনা। সেবার বরকত মাষ্টারের বাড়িতে চুরি করতে গিয়ে ভাগ্য দোষে ধরা পড়েছিলাম। তখন সবে চুরি করা শুরু করেছি। আগেই পাকা খবর ছিল ওখানে সোনাদানা আছে। আলমারির দরজা ভেঙ্গে একটা বড় গলার হার ও বেশ কয়েকটা হাতের চুড়ি নিয়ে বের হব এমন সময় মাস্টারের বউ হঠাৎ দেখে ফেলে এমন জোরে একটা চিল্লানি মারলো, গোটা গ্রামের লোকজন জেগে গেলো। জান বাঁচাতে আমি বাড়ির পিছনের ডোবায় লাফ দেই। কিন্তু ততক্ষনে আট দশজন ঘিরে ফেলেছে আমাকে। আমারে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে একটা কাঠাল গাছের সাথে পিছমোড়া করে বেঁধে কিযে মারা মারল, বলার মত না। আচ্ছা মতো পিটিয়ে তক্তা বানালো ওরা। পাছায় ও কোমরে ক্যাঁৎ ক্যাঁৎ করে লাথি মারলো। মেরুদন্ডের ব্যাথাটা এখনো যায়নি। মাইরের চোটে একসময় অজ্ঞান হয়ে পড়ি। পরে পুলিশ এসে আমাকে থানায় নিয়ে যায়। সেই স্মৃতি এখনো ভুলতে পারিনাই।’

কতদিনের চেনা ঘরবাড়ি কেন যেন অচেনা লাগছে আজ ফজলুর কাছে। চেয়ারম্যানের বাড়ির কাছে অন্ধকার ভেদ করে কালো কালো ছায়া শরীর বা অবয়ব দেখা যাচ্ছে। আবছা আলোয় স্পষ্ট দেখতে পেল লোকজন কি যেন পাহারা দিচ্ছে। ফজলু বুঝলো আজ তার কপাল খারাপ। ধরা পড়লে খবর আছে। কিন্তু এতো লোকজন কিসের জন্যে, আড়ালে থেকে বুঝতে চেষ্টা করলো সে। হঠাৎ একটা ট্রাক এসে দাড়লো এককোণে। লোকজন তখন টপাটপ চালের বস্তা চেয়ারম্যান বাড়ির পেছনের গেট দিয়ে বের করে ট্রাক বোঝাই করে চলেছে! চেয়ারম্যান আবার সরকারি দলের লোক। ঝামেলা করতে গেলে ফজলু চোরই কোথায় ফেঁসে যেতে পারে! এসব রাঘব বোয়াল চোরদের, যারা গরীবের হক মেরে খায় ; অভুক্ত মানুষের ত্রাণের মাল চুরি করে খায় তাদের সাজা খুব একটা হয়না। যদি কখনো ধরাও খায় ঐ জেল যাওয়া অবধি। কখন আবার টুপ করে বেরিয়ে আসে তার হিসেবে মেলা ভার।

আজ আর মন সায় দিচ্ছেনা ফজলুর। কিন্তু একবার মন্ত্র পড়লে তো আর খালি হাতে ফেরা যায়না। ফেরার পথে এক জেলে বাড়ি থেকে একটা হুইল চেয়ার মাথায় নিয়ে বাড়ি ফিরলো সে।
বাড়ি ফিরতেই জড়িনা বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে বললো, ‘আপনে রুগিদের এই চেয়ার কোথা থেকে আনলেন? আমার জন্য গলার হার এনেছেন?’

‘না বউ আনতে পারিনাই। কপাল খারাপ। চেয়ারম্যানের বাড়িতে লোকজন জেগে রয়েছে। জান হাতে নিয়ে ফিরে আসলাম। খালি হাতে তো আসা যায়না। তাই আসার পথে এক বাড়ির আঙ্গিনা থেকে চেয়ারটা নিয়ে আসছি।’

‘তাই বলে বুড়া মাইনসের চেয়ার আনবেন? চোর হয়েছেন বলে কি বিবেক বুদ্ধি পুরোপুরি বিসর্জন দিতে হবে।’ কটকটে গলায় বললো জড়িনা।

‘এতো কিছু দেখলে চোর হওয়া যায়না।’ জবাব দেয় ফজলু।

গ্রীষ্মকাল। দুনিয়া এক অদৃশ্য মহামারী করোনা ভাইরাসের সাথে যুদ্ধ করছে। গোটা এলাকা লকডাউন। ফজলু বিষন্ন মনে বসে আছে আর বিড়বিড় করে বলছে, ‘রাজু চোরের কাছে শুনলাম শহর এলাকায় ছিছি না সিসি কি সব ক্যামেরা চালু হয়েছে। সেটা দেখে সহজেই চোর ধরা যায়। বাপ দাদার পেশা মনে হয় আর ধরে রাখা যাবেনা।’ ফজলু ছোট শিশুর মত কাঁদতে লাগলো।

জড়িনা বললো, ‘দেখেন, আপনে এবার ভালো হয়ে যান। কাজ কাম কইরা খান। এ গ্রামের কেউ কাজ না দিলে দূরে কোথাও কাজের সন্ধান করবেন। আল্লাহর কাছে তওবা করে ভাল হয়ে যান। আল্লাহই আপনেরে পথ দেখাইবো।’

ফজলু আগের মতোই বিড়বিড় করে বললো, ‘একটা কারনে মনটা খুব খারাপ হয়। সেটা হলো, পুলিশ কিন্তু আমগোর মত ছোট চোরদের ধরে, বড় চোরদের কিন্তু ধরেনা বা ধরতে পারেনা। আর কখনও ধরলেও ওগো উপযুক্ত সাজা হয়না। ঘুষ, দূর্নীতি, খুন ধর্ষণের বিচার হয়না! দৃষ্টান্তমূলক কঠোর কঠিন শাস্তি হয়না! এই করোনা কালেও গরীব অনাহারী মাইনষের ত্রাণের মালামাল ওরা চুরি কইরা খায়। খুন ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। দু’একটা ওমন অমানুষদের ধইরা ব্রাশফায়ারে মারা হোউক। দেখবা ওমন কাজ করার আগে ওগো বুক কাঁপবো। এসব অনাচার অত্যাচারও কমবো।’ কথা শেষ করে ফজলু আবারও কেঁদে ফেলে।

ঢাকা, বাংলাদেশ

লেখক: রুদ্র অয়ন

Leave a Comment