এক নজরে বিল গেটসের জীবনের গল্প

বিল গেটস। এ নামটির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে বর্তমান বিশ্বের অর্থনীতি। তিনি বিশ্বের সবচেয়ে ধনাঢ্য ব্যক্তিই নন, হয়ে উঠেছেন হাজারও উদ্যোক্তার আদর্শ উদাহরণ। বাবা আইনজীবী ও মা ব্যাংকার হলেও ছোট থেকে গেটসের দৌড়ঝাঁপ কোডিং আর প্রোগ্রামিংয়ের সঙ্গে। পরবর্তীতে তার হাত ধরেই গোটা বিশ্ব প্রবেশ করেছে কম্পিউটিংয়ের নতুন দুনিয়ায়। তাকে নিয়েই আজকের আয়োজন-

শিক্ষাজীবন

বিল গেটসের মা-বাবা চাইতেন বড় হয়ে তিনি আইনজীবী হবেন। কিন্তু কৈশোর থেকে উদ্ভাবন ও উপার্জনের নেশা তাকে পেয়ে বসে। ১৩ বছর বয়সে যখন মা-বাবা তাকে লেকসাইড স্কুলে পাঠান তখন তিনি বিভিন্ন সফটওয়্যার নিয়ে অধ্যয়ন করতে থাকেন। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় লেকসাইড স্কুলের মাদার্স ক্লাবে জেনারেল ইলেকট্রিক কম্পিউটারের বেসিক প্রোগ্রামিং শিখতে থাকেন। বলা হয়ে থাকে, লেকসাইডের স্কুলটি তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। এ সময় গেটস কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ের প্রতি এতটাই মুগ্ধ হন, বেশিরভাগ সময় তিনি স্কুলের ল্যাবেই বসে থাকতেন। স্কুলে পড়ার সময় তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন পল অ্যালেন।

বলতে গেলে গেটসের প্রোগ্রামিংয়ের হাতেখড়ি স্কুলের এই ল্যাবটিই। একবার অতিরিক্ত সময় কম্পিউটার ব্যবহারের কারণে কম্পিউটার সেন্টার করপোরেশন (সিসিসি) তাকে ব্যান করে। একই সময় তার বন্ধু পল অ্যালেন, রিক ওয়েইল্যান্ড ও কেন্ট ইভান্সকেও ব্যান করা হয়।

পরবর্তীতে চার বন্ধু মিলে লেকসাইড প্রোগ্রামস ক্লাব তৈরি করেন। অন্যদিকে কম্পিউটার সেন্টার করপোরেশনের (সিসিসি) ব্যান করার মেয়াদ শেষ হলে সফটওয়্যারের বাগ খুঁজে দিতে বলা হয়। দূরদর্শী বিল গেটস এই সুযোগ হাতছাড়া করেননি। বাগ খুঁজে দেওয়ার পাশাপাশি ফোর্টরান, লিম্প, মেশিন ল্যাংগুয়েজসহ আরও নানা প্রোগ্রামের সোর্স কোড অধ্যয়ন করেন। ১৯৭০ সাল অবধি তিনি সিসিসিকে সফটওয়্যারের বাগ খুঁজে দিতে সহায়তা করেন।

১৭ বছর বয়সে বিল গেটস পল অ্যালেনের সঙ্গে ইনটেল ৮০০৮ প্রসেসরের ওপর ভিত্তি করে ট্র্যাক-ও-ডেটা নামে একটি ট্র্যাফিক কাউন্টার তৈরির উদ্যোগ নেন। ১৯৭৩ সালে লেকসাইড স্কুলে অধ্যয়ন শেষ করেন এবং স্কোল্যাস্টিক এপটিচিউড টেস্টে (স্যাট) ১৬০০ নম্বরের মধ্যে ১৫৯০ পান। এরপর অটাম (শরৎকালীন) সেশনে হার্ভার্ড কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু দুই বছর পর সেখানে আর পড়াশুনা করেননি বিল গেটস।

কর্মজীবন

১৯৭৪ সালে এমআইটিএস নামে একটি কোম্পানি ইনটেল-৮০৮০ প্রসেসর ভিত্তিক আলটায়ার-৮৮০০ প্রকাশ করে। সফটওয়্যারটি প্রকাশের পর কোডিং আরও অনেক সহজ হয়ে যায়। এ সময় গেটস ও অ্যালেনকে এ কোম্পানি থেকে চাকরির প্রস্তাব দেয়। অ্যালেন ও বিল গেটস ভালো উপার্জনের আশায় চাকরিটি গ্রহণ করেন। বিল গেটস ও পল অ্যালেন এক সপ্তাহের মধ্যে আলতেয়ার প্রোগ্রামিংয়ের বেসিক ভার্সন তৈরি করেন। এতে এমআইটিএস কোম্পানির কাছে তারা ব্যাপক প্রশংসিত হন।

মাইক্রোসফটের গল্প

পল অ্যালেন ও বিল গেটস দুজনের অংশীদারিত্বের নাম দেন ‘মাইক্রো-সফট’। যার অর্থ ‘মাইক্রো কম্পিউটার’ ও ‘সফটওয়্যারের’ সংমিশ্রণ। ১৯৭৫ সালের ৪ এপ্রিল মাইক্রোসফট কোম্পানিটি প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর ১৯৮০ সালে বিল গেটসের হার্ভার্ড কলেজের বন্ধু স্টিভ বালমর মাইক্রোসফটে যোগদান করেন। ১৯৮৮ সালে তাকে বিক্রয় বিভাগের এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট করেন বিল গেটস।

আশির দশকে বিল গেটস খ্যাতির শিখরে পৌঁছেন। তখন থেকে তিনি সফল শিল্পোদ্যোক্তা ও বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি হিসেবে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। এ সময় তিনি ৮৬-ডিওএস বা ডিস্ক অপারেটিং সিস্টেম আইবিএমের কাছে ৫০ হাজার ডলারে বিক্রির ব্যবস্থা করেন। তবে কপিরাইটের ব্যাপারে আইবিএম কোনও আপত্তি তোলেনি এবং বিল গেটসও কোনও কিছু বলেনি। এর অর্থ অপারেটিং সিস্টেমটির নিজস্ব ভার্সন এমএস-ডস বিক্রি করতে উৎসাহী ছিলেন বিল গেটস।

১৯৮৩ সালে মাইক্রোসফটের মোট বিক্রি হয় ৫ কোটি ৫০ লাখ ডলার। এর মাধ্যমে মাইক্রোসফট কম্পিউটার ব্যবসায় সবচেয়ে বড় কোম্পানি হিসেবে জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ১৯৮৬ সালের ১৩ মার্চ মাইক্রোসফটের শেয়ারের পরিমাণ ছিল ২ কোটি ১০ লাখ ডলার। ১৯৮৭ সালে মাত্র ৩১ বছর বয়সে বিল গেটস বিলিয়ন-পতি হিসেবে পরিচিত হন। ১৯৯৬ সালে তিনি বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত হন। ২০০৭ সাল পর্যন্ত তিনি এই খেতাবে ভূষিত ছিলেন। ২০০৮ সালে ওয়ারেন বাফেট সেই স্থান দখল করে নেন এবং এর ঠিক দুই বছর পর তিনি আবার বিশ্বের সবচেয়ে ধনাঢ্য ব্যক্তি স্থান অধিকার করেন।

২০০০ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত মাইক্রোসফটের প্রধান নির্বাহী ছিলেন স্টিভ বালমোর। ২০১৪ সাল থেকে এখন পর্যন্ত সত্য নাদেলা কোম্পানিটির প্রধান নির্বাহী হিসেবে রয়েছেন। ১৯৭৫ সালের ৪ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের নিউ মেক্সিকো অঙ্গরাজ্যের আলবুকার্ক শহরে এটি প্রতিষ্ঠা করেন বিল গেটস ও পল অ্যালেন।

১০। যত দ্রুত সম্ভব শুরু করে দিন
বিল গেটস সব সময় একটি কথা বলেন, “এখনই শুরু করে দিন”। কারণ আজ যে আইডিয়া মাথায় নিয়ে আপনি ঘুরছেন, তা যদি বাস্তবায়ন করতে না পা্রেন তাহলে ঠিক কয়েক বছর পর দেখবেন আপনার আইডিয়াটি কাজে লাগিয়ে ঠিকই আরেকজন সফল হয়ে গেছে। তখন আফসোস ছাড়া আর কিছুই আপনার করার থাকবে না।

৯। প্রতিদিন নিজের ‘সেরা’ টা দিতে হবে
বিল গেটসের ভাষায় জীবনটা সেমিস্টার হিসেবে ভাগ করা নেই যে কয়েক মাস পর পর চাইলেই আপনি আগের ভুলগুলো শুধরে নেয়ার সুযোগ পাবেন। এমনকি এখানে ব্রেক বলেও কিছু নেই। আপনাকে প্রতিটি সেকেন্ডের যথার্থ ব্যবহার করতে হবে। অর্থাৎ প্রতিদিনই আপনাকে আপনার সেরাটাই দিতে হবে।

৮। আপনি নিজেই নিজের ‘বস’
“Don’t compare yourself with anyone in this world… If you do so, you are insulting yourself.”
স্বপ্ন পূরণের পথে অন্যকে অনুসরণ করা থেকে বিরত থাকুন। নিজেই এমন কিছু করুন যাতে অন্যরা আপনাকে অনুসরণ করে। প্রতিটি মানুষের স্বকীয় সত্তা ও চিন্তাশক্তি রয়েছে। নিজের স্বকীয়তাকে কাজে লাগান। দেখবেন, একটা সময় যাকে আপনি অনুসরণ করার কথা চিন্তা করেছিলেন, জীবন যুদ্ধে তার থেকেও আপনি অনেক এগিয়ে গেছেন।

৭। না বলতে শিখুন
আপনি যত প্রতিভাবান-ই হয়ে থাকুন, প্রতিদিন ২৪ ঘণ্টার বেশি কিন্তু আপনার হাতে নেই। এই ২৪টি ঘণ্টাকে কে কীভাবে ব্যবহার করলো সেটাই নির্ধারণ করে দেয় একজন সফল ও ব্যর্থ মানুষের মধ্যে পার্থক্য। বিল গেটস হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বক্তব্যে বলেছিলেন, “জীবনের সেরা উপদেশটি আমি পেয়েছি বন্ধু ওয়ারেন বাফেটের কাছে থেকে। সে বলেছিলেন, তোমাকে ‘না’ বলতে জানতে হবে”।

বিল গেটস মনে করেন, কখনো কখনো আপনার ‘না’ বলতে পারাটা আপনাকে আপনার লক্ষ্যে অবিচল রাখতে সাহায্য করে।

৬। দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হোন
প্রত্যেক সফল উদ্যোক্তাই একটি ব্যাপারে জোর দিতে বলেন। তা হচ্ছে- ‘দৃঢ় প্রতিজ্ঞ’ হওয়া। প্রতিজ্ঞা আসে ভালোবাসা থেকে। কাজের প্রতি প্রচণ্ড ভালোবাসা তৈরী করুন। আপনি যে কাজটি করছেন, তার প্রতি আপনার ভালোবাসা থাকতে হবে। সফল মানুষেরা একমাত্র ভালোবাসা দিয়েই প্রতিটি কঠিন কাজকে সহজ করে ফেলে।

৫। জীবন আপনার সেরা স্কুল
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয় বরং জীবনই আপনার সেরা স্কুল। আপনি যত বই-পুস্তকই পড়ে থাকেন না কেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের যত পরীক্ষাই দেন না কেন এসবের কোনোটাই আপনাকে শেখাতে পারবে না কীভাবে জীবনের কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়। আপনাকে নিজের জীবন থেকে শিখেই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রস্তুত হতে হবে।

৪। আশা হারাবেন না
বিল গেটস বলেন, “লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে হতাশাবাদী হলে চলবে না বরং সব সময় আশাবাদী হতে হবে”। ২০১৩ সালে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এর এক ভাষণে তিনি শিক্ষার্থীদের বলেছিলেন, “আশাবাদ অনেক সময় মিথ্যে আশায় পরিণত হয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে, মিথ্যে হতাশা বলেও কিছু আছে”।

“Dare to follow your dreams”

৩। সমালোচনাকে স্বাগত জানান
বিল গেটস তাঁর “Bussiness of The Thought” বইয়ে সমালোচনার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বলেছেন। তিনি বিশ্বাস করেন অভিযোগ আর অসন্তুষ্টি মানুষকে যে কোনো কাজে আরও ভালো করার সুযোগ করে দেয়। তিনি লিখেছেন, “আপনার সব থেকে অসন্তুষ্ট কাস্টমারই আপনার শেখার সবচেয়ে বড় উৎস”।

We all need people who will give us feedback, that’s how we improve

২। সাফল্যের হিসাব করুন
২০০৩ সালে বিল গেটস তাঁর “ The Most Powerful Idea In The World” বই থেকে তাঁর কাছে ‘শিক্ষা’ কী তা বলেছেন।

তিনি বলেন, “আপনি যদি সব সময় একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্য ঠিক করে, একটা নির্দিষ্ট সময় পরে তার হিসাব করেন যে, আপনি কতটুকু আগালেন তাহলেই লক্ষ্যে অবিচল থাকতে পারবেন”। এর সঙ্গে তিনি এও যোগ করেছেন- “এটা বলা যতটা সহজ, করা ঠিক ততটাই কঠিন”।

সুতরাং, যে কোনো কাজ করার জন্য নিজেকেই নিজের সময় ধরে দিতে হবে এবং নির্ধারিত সময় পার হবার পর হিসেব করে দেখতে হবে কাজটি কতটুকু এগিয়েছে।

১। জীবন সহজ নয়- এটা মেনে নিন
আপনি যত কঠোর পরিশ্রম করুন না কেন, এমন একটা সময় নিশ্চয়ই আসবে যখন সবকিছু আপনার মন মতো হবে না, সব কিছু আপনার নিয়ন্ত্রণে থাকবে না। আপনি হোঁচট খাবেন, পড়ে যাবেন। কিন্তু মনে রাখবেন, আপনাকে আবারো দাঁড়াতে হবে। এটাই চরম সত্য যে, জীবনের কঠিন সময়ের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে হবে। একনিষ্ঠভাবে স্বপ্ন পূরণের পথে সময়ের অপচয় না করে এগিয়ে যান, সাফল্য ঠিক সময়েই আপনার দরজায় এসে কড়া নাড়বে।

Leave a Comment