অনিয়মিত মাসিক

দুই মাসিকের মধ্যবর্তী সময় যদি বার বার পরিবর্তন হতে থাকে, তাহলে তাকে অনিয়মিত মাসিক বলে। অনিয়ম দুইভাবে হতে পারে-ঘন ঘন, নয়তো দেরিতে দেরিতে।

মাসিকের চক্র কিভাবে হিসাব করতে হয়?

এক মাসিকের প্রথম দিন থেকে আর এক মাসিকের প্রথম দিন পর্যন্ত যে সময় সেটাই হলো এক মাসিক চক্র। সাধারণত ২৮ দিন পরপর মাসিক হয়। যদিও ২১ থেকে ৩৫ দিন অন্তর পর্যন্ত স্বাভাবিকতার তারতম্য হতে পারে। একবার মাসিক হলে সাধারণত ২-৮ দিন থাকে এবং এক মাসিকে মোট ৫-৮০ মিলি পর্যন্ত রক্ত যেতে পারে। এই তিনটার যেকোনো একটার অনিয়ম মানেই অনিয়মিত মাসিক।

কেন হয়?

বিভিন্ন বয়সে বিভিন্ন কারণে অনিয়মিত মাসিক হয়। যেমন-

১) সাবালিকা হওয়ার প্রথম ১-২ বছর ডিম্বাশয়ের অপরিপক্বতার জন্য।

২) মেনোপজ হওয়ার আগের ৪-৫ বছর হরমোনের তারতম্যের জন্য।

৩) কিছু কিছু পিল খাওয়ার সময় বা কপার-টি দেওয়া অবস্থায় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার জন্য।

৪) বুকের দুধ খাওয়ানো অবস্থায় হরমোনের তারতম্যের জন্য।

৫) খুব বেশি ব্যায়াম করলে।

৬) অতিরিক্ত টেনশনে থাকলে।

৭) হঠাৎ খুব ওজন বেড়ে বা কমে গেলে।

৮) হরমোনজনিত রোগ পিসিওএস হলে।

৯) থাইরয়েড রোগীদের।

১০) স্ত্রী রোগ যেমন-জরায়ুর পলিপ, ফাইব্রয়েড টিউমার, জরায়ুর প্রদাহ ও এন্ডোমেট্রোসিস রোগ হলে।

কখন ডাক্তারের কাছে যাবেন?

কয়েকদিন মাসিক এদিক ওদিক হলেই ডাক্তারের কাছে দৌড়ানোর দরকার নেই। অথবা সাবালিকা হওয়ার কয়েকবছর মাসিক দেরিতে দেরিতে হলেই ডাক্তারের কাছে যাওয়ার দরকার নেই।

কিন্তু নীচের সমস্যাগুলো থাকলে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। সমস্যাগুলো হলো-

১) হঠাৎ করে যদি মাসিকের চক্র পরিবর্তন হয় এবং রোগীর বয়স ৪৫ এর কম হয়।

২) ২১ দিনের চেয়ে কম সময়ে বা ৩৫ দিনের চেয়ে বেশি সময়ে মাসিক হলে।

৩) মাসিক ৭ দিনের চেয়ে বেশি থাকলে বা ৩ দিনের চেয়ে কম হলে।

৪) সর্বনিম্ন মাসিক ও সর্বোচ্চ মাসিক হওয়ার দিনের মাঝে ২০ দিনের অধিক তফাৎ থাকলে।

৫)অনিয়মিত মাসিক, কিন্তু বাচ্চা নিতে চান।

কেন মাসিক নিয়মিত হওয়া জরুরি?

অনিয়মিত মাসিক এর সাথে অনেক দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্য সমস্যা জড়িত বলেই মাসিক নিয়মিত হওয়া জরুরি। মেয়েদের পরিপাক, ঘুম, বাচ্চা হওয়া সবই এর সাথে সম্পর্কিত।

ডাক্তার কি করবেন?

অনিয়মিত মাসিকের রোগীদের গত ৬ মাসের মাসিকের ক্যালেন্ডার রাখতে বলা হয়। কি ধরনের মাসিকের সমস্যা তা ক্যালেন্ডার দেখলে বোঝা যায়। এছাড়া ডাক্তার রোগীর হিস্ট্রি, শারীরিক পরীক্ষা , কিছু রক্তপরীক্ষাসহ আলট্রাসাউন্ড করে জরায়ু ও তার আশপাশে কোন সমস্যা আছে কিনা তা নির্ণয় করবেন।

কিশোরীর অনিয়মিত মাসিক

কিশোরীদের অনিয়মিত মাসিকের কারণগুলো হলো-

১) ডিম্বাশয়ের অপরিপক্বতা, যার কারণে মেয়েলি হরমোন ইসট্রোজেন ও প্রজেস্টেরনের তারতম্য হয় এবং মাসিক যে পর্দা থেকে হয় সে পর্দা নিজেকে ধরে রাখতে পারেনা এবং ভাঙতে শুরু করে। (পরিপক্ব ডিম্বাশয় হলো সেটা যেটা থেকে প্রতি মাসে একটা করে ডিম্বাণু ফুটে বের হয়। কিশোরীর ডিম্বাশয় পরিণত হতে সাধারণত কয়েক বছর সময় লেগে যায়। এজন্য এ কয় বছর মেয়েদের মাসিক অনিয়মিত হয়, ওজন পরিবর্তন হয় ও মানসিক পরিবর্তন হয়।)

২) পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রম, যেখানে অনিয়মিত মাসিকের সাথে হাতে-পায়ে ও মুখে অবাঞ্ছিত লোম হয় এবং ঘাড়ে ও গলায় কালো দাগ পড়ে যায়। ওজন বেড়ে যায়।

৩) এছাড়া যেসব কিশোরীর থাইরয়েডের সমস্যা আছে।

যে সব কিশোরীর মাসিক অনিয়মিত তাদের চিন্তা থাকে কখন মাসিক হবে, কখন মাসিক হবে। তাদের মাসিক কখন হবে বোঝার জন্য কিছু লক্ষণ আছে।

সেগুলো হলো-

১) কোমরের পেছনে ক্রাম্পিং পেইন।

২) ব্রেস্ট ভার ভার লাগা।

৩) মাথা ব্যথা।

৪) ব্রণ।

৫) ঘুমের সমস্যা।

৬) মেজাজ পরিবর্তন।

৭) পেট ফাঁপা।

৮) নরম পায়খানা।

কিশোরীরা কিভাবে তৈরি থাকবে মাসিকের জন্য?

যেসব কিশোরীর অনিয়মিত মাসিক থাকে তাদেরকে যেন অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়তে না হয় সেজন্য নিজেকে তৈরি থাকতে হবে। একটা প্যাড এবং অতিরিক্ত একটা প্যান্টি সবসময় তাদের স্কুল ব্যাগে রাখতে পারে, যাতে হঠাৎ মাসিক হলে অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়তে না হয়।

চিকিৎসা

১) জীবনযাত্রা পরিবর্তন, যোগ ব্যায়াম, ওজন কমানোর জন্য ব্যায়াম ও খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন।

২) প্রজেস্টোরন ট্যাবলেট বা জন্ম নিয়ন্ত্রণ বড়ি।

৩) থাইরয়েড সমস্যার জন্য ওষুধ, যদি দরকার হয়।

বাচ্চা নিতে চান?

অনিয়মিত মাসিক অবস্থায় বাচ্চা আসা কঠিন। কেননা অনিয়মিত মাসিক মানে তার ডিম্বাশয় থেকে ডিম্বাণু ফুটছে না। ডিম না ফুটলে বাচ্চা হবে কোত্থেকে। তাই বাচ্চা নিতে হলে ওষুধ দিয়ে মাসিক নিয়মিত করতে হবে। তাতেও যদি বাচ্চা না আসে তবে ডিমফোটার ওষুধ দিতে হবে।

বাচ্চা নেওয়ার বয়সে অনিয়মিত মাসিক

সাধারণত বিভিন্ন স্ত্রী রোগের কারণেই বেশি হয় এ সমস্যা। তাই প্রথমে কোন স্ত্রী রোগ আছে কিনা তা আলট্রাসাউন্ড করে দেখতে হবে। যদি কোন সমস্যা থাকে, সে সমস্যার সমাধানে ওষুধে কাজ না হলে প্রয়োজনে অপারেশনও লাগতে পারে। যদি কোন স্ত্রী রোগ না থাকে তাহলে ধরে নিতে হবে হরমোনজনিত সমস্যা, যা হরমোন বা পিল দিয়ে ঠিক করা যায়। তবে মনে রাখতে হবে-যেকোনো অনিয়মিত মাসিকের ফলে রক্তশূন্যতা হতে পারে। তাই রক্তের হিমোগ্লোবিন পরীক্ষা করে কম থাকলে আয়রন দিতে হবে। থাইরয়েড সমস্যা থাকলে এর ওষুধ নিয়মিত সকাল বেলা খেতে হবে (কেননা এটা সারা জীবনের রোগ)।

এছাড়া পিসিওএস-যেটা খুব কমন একটা সমস্যা, এটাও সারাজীবনের রোগ। এদের জীবনযাত্রার পরিবর্তন না করলে, ওজন না কমালে, নিয়মিত ব্যায়াম না করলে নানা জটিল রোগ হতে পারে। এসব রোগীদের সাধারণত দেরিতে দেরিতে মাসিক হয়। সুস্থ থাকার জন্য বছরে কমপক্ষে চারবার মাসিক হওয়া উচিত। তাই কমপক্ষে তিন মাস অন্তর অন্তর মাসিক হওয়া জরুরি। প্রাকৃতিক নিয়মে না হলে, ওষুধ দিয়ে মাসিক করাতে হবে তিন মাস পরপর।

যাদের ঘন ঘন মাসিক হয় তাদের ক্ষেত্রে হরমোন বা পিল ২১ দিন করে কমপক্ষে তিন চক্র দিয়ে মাসিক নিয়মিত করাতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে আরও দীর্ঘদিন ওষুধ লাগতে পারে।

মেনোপজের আগে অনিয়মিত মাসিক

যদি কোন স্ত্রীরোগের কারণে অনিয়মিত না হয় তাহলে দুশ্চিন্তার কিছু নাই। দেরিতে দেরিতে হলে কোন চিকিৎসার দরকার নেই। তবে ঘন ঘন হলে বা একবার হয়ে বেশিদিন থাকলে হরমোন বা পিল কমপক্ষে তিনমাস খেয়ে মাসিক ঠিক করাতে হবে। তবে এতেও যদি সমাধান না হয় তাহলে জরায়ুর সবচেয়ে ভেতরের লেয়ার থেকে মাংস নিয়ে পরীক্ষা করে দেখতে হবে কোন সমস্যা আছে কিনা। সমস্যা থাকলে সমস্যা অনুযায়ী চিকিৎসা নিতে হবে।

যে বয়সেই অনিয়মিত মাসিক হোক না কেন, এটা মেয়েদের জন্য বিশাল দুশ্চিন্তার ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। মেয়েদের মাসিক শুরু হওয়ার সময় থেকে মাসিক উঠে যাওয়ার আগ পর্যন্ত প্রজননতন্ত্রের সুস্থতার মূল লক্ষণ হলো নিয়মিত মাসিক। এর ব্যত্যয় হলে অবশ্যই গাইনি রোগের চিকিৎসকের কাছে গিয়ে যাচাই করতে হবে কোন রোগ আছে কিনা। কেননা সঠিক সময়ে চিকিৎসা করলে অনেক জটিল সমস্যা এড়ানো সম্ভব।

লেখক:

সহকারী অধ্যাপক,

গাইনি বিভাগ, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ।

সূত্র/ইত্তেফাক/এএএম

Leave a Comment