১৭৬৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে দেওয়ানি হস্তান্তরের ফলে বাংলার অর্থনীতি ও শাসনব্যবস্থার উপর কি প্রভাব পড়েছিল?

১৭৬৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে দেওয়ানি হস্তান্তরের ফলে বাংলার অর্থনীতি ও শাসনব্যবস্থার উপর কি প্রভাব পড়েছিল?

শিক্ষা প্রশ্ন সমাধান

Google Adsense Ads

১৭৬৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে দেওয়ানি হস্তান্তরের ফলে বাংলার অর্থনীতি ও শাসনব্যবস্থার উপর কি প্রভাব পড়েছিল?


আদিকাল থেকে বাংলা ছিল ধনসম্পদে পরিপূর্ণ। বাংলার ধনসম্পদে আকৃষ্ট হয়ে আদিকাল থেকে অনেক বিদেশী ভারতবর্ষে আগমন করেছিল। এক্ষেত্রে কারো উদ্দেশ্য ছিল ধনসম্পদ লুণ্ঠন করে যাওয়া। কারো উদ্দেশ্য ছিল ব্যবসায়-বাণিজ্য সম্প্রসারণ করা। এ নিয়মে দেখা যায়, ১৭৫৭ সালে কোম্পানি বাংলার উপর কিছুটা নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করেন এবং ১৭৬৪ সালে বক্সারের যুদ্ধের মাধ্যমে সকল প্রতিবন্ধকতা দূর হয়। তাই কোম্পানি কৌশলে শাসন ক্ষমতায় প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করেন। এ প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার ইতিহাস হল বাংলার দেওয়ানি ক্ষমতা লাভ। এ দেওয়ানি লাভ কোম্পানির জন্য ছিল একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। কারণ, এক সময় তারা ছিলেন এদেশীয় শাসকদের কাছে কৃপা ও অনুগ্রহপ্রার্থী । কিন্তু এখন তারা কৃপা বিতরণের অধিকারী হন।

বাংলার অর্থনীতি ও শাসনব্যবস্থার উপর প্রভাব ঃ ১৭৬৫ সালে কোম্পানি মুঘল সম্রাট শাহ আলমের সাথে চুক্তির মাধ্যমে কিছু অর্থ দেওয়ার প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে বাংলার দেওয়ানি ক্ষমতা লাভ করেন। দেওয়ানি লাভ করার ফলে বাংলার অর্থনীতি ও শাসনব্যবস্থার উপর কি প্রভাব পড়েছিল তা আলোচনা করা হল :


ক. অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রভাব : মূলত অর্থনৈতিক কারণেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আবির্ভাব হয় ভারতে ১৬০০ সালে। ১৬০০ সাল থেকে ১৭৬৫ সালের পূর্ব পর্যন্ত তারা রাজস্ব শুধু দিয়ে এসেছে কিন্তু নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেন নি ১৭৬৫ সালে কোম্পানির দেওয়ানি লাভের মাধ্যমে তা পূরণ হয়। নিয়ে এ সম্পর্কে কিছু আলোচনা করা হল :


১. রাজস্বের উপর কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ : পূর্বে রাজস্বকার্যও নিয়ন্ত্রণ করতেন নবাব। কিন্তু ১৭৬৫ সালে দেওয়ানি লাভ করার পর কোম্পানি দিল্লির মুঘল সম্রাট শাহ আলমকে বাৎসরিক ২৬ লক্ষ টাকা এবং অযোধ্যার নবাবকে ৫০ ল টাকা প্রদানের শর্তে সমস্ত নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করেন। এতে কোম্পানির রাজস্ব আয়ের নিশ্চয়তা হয়। ফলে কোম্পানির পূর্বের যে অসুবিধা তা দূরীভূত হয়।


২. কোম্পানির একচেটিয়া ব্যবসায় : ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ছিল একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে তার মূল স্বার্থ ছিল কোম্পানির স্বার্থকে রক্ষা করা। তাই দেওয়ানি লাভের মাধ্যমে ব্যবসায় বাণিজ্য ক্ষেত্রে পূর্ব তাদের যে অসুবিধা ছিল তা দূরীভূত হয়। এছাড়া তাদের বাণিজ্য নীতির কারণে অন্যান্য বণিক সম্প্রদায়ের স্বার্থক্ষুণ্ণ হয়। ব্যবসায়-বাণিজ্যসহ সবক্ষেত্রে কোম্পানির একচেটিয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।


৩. বাংলার সম্পদ বিদেশে পাচার : ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পূর্বের কাজ ছিল বাণিজ্য ক্ষেত্রে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে মুনাফা লাভ করা। তাই এ উদ্দেশ্য সাধন করার জন্য তারা আপ্রাণ চেষ্টা করেন। তবে ১৭৬৫ সালে কোম্পানির দেওয়ানি লাভের ফলে তারা বাংলার বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করতে থাকেন। আর বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করার কারণে তারা মূল্যবান সবকিছু বিদেশে পাচার করতে থাকেন। ফলে বাংলা সম্পদ শূন্য হয়ে যায় ।


৪. অর্থনৈতিক শোষণ : কোম্পানির স্বার্থ ছিল অর্থনীতির ভিত্তিকে মজবুত করা। অর্থনীতির ভিত্তিকে মজবুত করার জন্য তারা যে কোন পন্থা অবলম্বন করতে দ্বিধা করত না। এ অর্থনৈতিক ভিত্তিকে মজবুত করার জন্য তারা দেওয়ানি ক্ষমতা নিজ হাতে গ্রহণ করেন। কারণ, অর্থনৈতিক ক্ষমতা তাদের হাতে থাকলে কোন অসুবিধা হবে না বিধায় তারা অর্থনৈতিক শোষণ ব্যবস্থা চালু করেন ।


৫. নবাবের বৃত্তি হ্রাস : কোম্পানির দেওয়ানি ক্ষমতা পাওয়ার সময় যে চুক্তি করেন তা বেশি দিন বজায় ছিল না। ১৭৬৫ সালে ‘ক্লাইভ মুঘল সম্রাট শাহ আলমকে যে ২৬ লক্ষ টাকা প্রদানের কথা বলেন তা বজায় রাখতে পারেন নি। এছাড়া কোম্পানি অযোধ্যার নবাবকে ৫৩ লক্ষ টাকা দেওয়ার শর্তে সন্ধি সম্পাদন করেছিলেন। কিন্তু রবার্ট ক্লাইভ এ শর্ত পালন করেন নি। তাই কিছু দিন যেতে না যেতেই শর্ত ভঙ্গ করে নবাব ও সম্রাটের বৃত্তি হ্রাস করেন ।


৬. ১৭৬৯-৭০ সালের দুর্ভিক্ষ : ১৭৬৫ সালে কোম্পানি দেওয়ানি লাভ করার পর যে নীতি চালু করেন তা ছিল আড়ালে থেকে নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা হাতে রাখা। এ নীতি চালু করার ফলে বাংলার অর্থনৈতিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে যায়। একদিকে প্রাকৃতিক দুযোর্গ অন্যদিকে কৃষকদের মধ্যে অর্থসম্পদ না থাকায় দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দেওয়ায় ফসলের উৎপাদনের ঘাটতি দেখা দেয়। একথা কোম্পানি জানতে পেরে কোম্পানির কর্মচারীদের জন্য মজুতদারি নীতি গ্রহণ করেন। এ মজুতদারি নীতির ফলে দুর্ভিক্ষের পটভূমি রচিত হয়।


খ. প্রশাসনিক ক্ষেত্রে প্রভাব : ১৭৬৫ সালে দেওয়ানি লাভের মাধ্যমে কোম্পানি বাংলার শাসন ক্ষেত্রে অঘোষিত প্রধান হন। আর এটাই ছিল তাদের রাজনৈতিক কৌশল। এ কৌশল প্রয়োগ করার কৃতিত্ব হল রবার্ট ক্লাইডের। নিম্নে এ বিষয়ে কিছুটা আলোচনা করা হল :


১. দ্বৈত শাসনব্যবস্থার প্রবর্তন : বক্সারের যুদ্ধে মীর কাসিমের সাথে সম্মিলিতভাবে অযোধ্যার নবাব সুজা-উদ- দৌলা ও মুঘল বাদশাহ শাহ আলম পরাজিত হন। ঠিক এ পরাজয়ের পর শাহ আলমের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক শূন্যতা দেখা দেয়। ঠিক এ সময় রবার্ট ক্লাইড কৌশল প্রয়োগ করে শাহ আলমকে অর্থ সাহায্যের প্রস্তাব দেন। তবে শর্ত ছিল যে, কোম্পানিকে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানি প্রদান করতে হবে। এর বিনিময়ে কোম্পানি সম্রাটকে রাজস্বের নিশ্চয়তা দেবে। ফলে শাহ আলমকে বাৎসরিক ২৬ লক্ষ টাকা প্রদানের বিনিময়ে কোম্পানি দেওয়ানি লাভ করেন। কিন্তু দেওয়ানি লাভ করার পর কোম্পানি এক অভিনব কৌশল প্রয়োগ করেন। কৌশল হল যে, কোম্পানি সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে যুক্ত হবে না। কারণ, তাদের ধারণা ছিল কোম্পানি প্রত্যক্ষ শাসন প্রবর্তন করলে ভারতে বাণিজ্যরত অন্য বণিকরা কোম্পানির সমালোচনা করবে। এছাড়া কোম্পানিকে ইংল্যান্ডের ডাইরেক্টর সভার কাছে জবাবদিহি করতে হবে। তাই ক্লাইভ এক অভিনব ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন, যা দ্বৈত শাসনব্যবস্থা নামে পরিচিত।

Google Adsense Ads


২. শাসন ক্ষেত্রে কোম্পানির মর্যাদা বৃদ্ধি পূর্বে কোম্পানি ছিল মাত্র একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। কিন্তু দেওয়ানি লাভ করার পর কোম্পানি শুধু আর বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ছিল না। তারা শাসন ক্ষেত্রেও পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন। ফলে পূর্বের থেকে কোম্পানির মর্যাদা বৃদ্ধি পায় ৷


৩. দেশীয় শাসনের কুফল তুলে ধরার সুবিধা দেওয়ানি লাভ করার মাধ্যমে কোম্পানি কৌশলে দেশীয় শাসন যে ভারতবাসীর মঙ্গল সাধন করতে পারে না, একথা তুলে ধরেন। ফলে দেখা যায়, জনসাধারণ অন্তর্নিহিত তাৎপর্য বুঝতে চেষ্টা না করে দেশীয় শাসনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হন।


৪. মুঘল সম্রাট ও নবাবের ক্ষমতা খর্ব : ১৭৬৫ সালে কোম্পানির দেওয়ানি লাভের মাধ্যমে ইংরেজরা মুঘল সম্রাট শাহ আলম ও অযোধ্যার নবাব সুজা-উদ-দৌলাকে পুতুল সরকারে পরিণত করেন। কারণ, তারা কোম্পানির সাথে চুক্তির মাধ্যমে অর্থনৈতিক ক্ষমতা কোম্পানিকে দিয়ে দেন। তাই অর্থের জন্য তাদেরকে কোম্পানির উপর নির্ভর করতে হতো। সামরিক দিক থেকে নবাবের কোন ক্ষমতা ছিল না। সকল ক্ষমতা ছিল কোম্পানির হাতে।


৫. প্রশাসনিক জটিলতা বৃদ্ধি ঃ ১৭৬৫ সালে কোম্পানির দেওয়ানি লাভের মাধ্যমে প্রশাসনিক ক্ষেত্রে কোম্পানি হস্ত ক্ষেপ করেন। কারণ, সম্রাট ছিলেন পূর্বে সর্বেসর্বা। কিন্তু কোম্পানি দেওয়ানি লাভ করলে সম্রাট দেওয়ানির হাতের পুতুলে পরিণত হয়। কারণ, কোম্পানির হাতে অর্থ ও দেশ রক্ষা ক্ষমতা ছিল। ফলে প্রশাসনের ক্ষেত্রে অস্থিতিশীলতা দেখা দেয় । তাই দীর্ঘ দিন থেকে- এখন বাংলার নবাব কোম্পানি না অন্য কেউ? এ প্রশ্নের সমাধান হয় নি।


৬. কোম্পানির দুর্নীতি বৃদ্ধি : দেওয়ানি লাভ করার মাধ্যমে কোম্পানি অন্যায়ভাবে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার স্বীকৃতি লাভ করেন। তাই তারা নিজ নিজ স্বার্থ হাসিলের জন্য দুর্নীতির আশ্রয় গ্রহণ করেন। এ দুর্নীতির কারণে জনসাধারণের দুর্ভোগ বেড়ে যায়। ফলে একদিকে দেশীয় জনসাধারণের দুর্ভোগ অন্যদিকে কোম্পানির অত্যাচার শোষণ নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়। ৭. আইনশৃঙ্খলার অবনতি : ১৭৬৫ সালে কোম্পানির দেওয়ানি লাভের মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি হয় । আইনশৃঙ্খলার অবনতিতে প্রেরণা যোগান কোম্পানি। কারণ, এক্ষেত্রে কোম্পানির স্বার্থ ছিল যে, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটলে দেশীয় শাসকদের প্রতি জনসাধারণ বীতশ্রদ্ধ হবে। যার ফলে জনমত ইংরেজদের অনুকূলে যাবে। সুতরাং, এ ধরনের উদ্দেশ্য থেকে তারা দেওয়ানি লাভ করার পর কৌশলে এ কাজ করতে থাকেন।


উপসংহার : অতএব বলা যায় যে, কোম্পানির দেওয়ানি লাভ ছিল ব্রিটিশ ভিত্তিকে মজবুত করার ক্ষেত্রে, অনেকটা প্রয়োজনীয়। কারণ, একদিন বাণিজ্য প্রতিনিধি দল হিসেবে তারা যখন ভারতে আসেন তখন তারা ছিলেন এ দেশীয় শাসকদের কাছে কৃপা বা অনুগ্রহ প্রার্থী। তাই তারা সকল প্রকার শর্ত মুখ বুজে সহ্য করেন। কিন্তু ১৭৬৫ সালে সে কোম্পানি বাংলার নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা হাতে পান। ফলে বণিকের মানদণ্ড রাজদণ্ডে পরিণত হয়। আর এটাই তো ইতিহাসের চরম সত্য। তাই ইতিহাসের যে চিরন্তন নিয়ম তা প্রতিষ্ঠিত হয়। তাই বলা যায়, ভাঙা গড়াই ইতিহাসের ধর্ম।

Google Adsense Ads

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *